মঙ্গলবার,১৯,মার্চ,২০২৪
32 C
Dhaka
মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪
Homeশিক্ষা সংস্কৃতিইতিহাসঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের ৬৫ বছর

ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের ৬৫ বছর

রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্রোতধারার মোহনা

নতুন কথা ডেস্ক ॥ পাকিস্তানকে ‘আসসালামু আলাইকুম’-বলে পূর্ব বাংলার (বাংলাদেশ) স্থায়ত্বশাসনের দাবি তুলেছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৫৭ সালে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে তিনি এমন সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন। ভাসানীর সেই সাহসী উচ্চারণ ও টাঙ্গাইলের কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক মাইলফলক। মূলত কাগমারী সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলন দানা বাঁধে। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের ৬৫ বছর।
২০১৭ সালে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত কবি গবেষক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ-এর ‘কাগমারী সম্মেলন: মওলানা ভাসানীর পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম’ নামে গ্রন্থটি কাগমারী সম্মেলনের অন্যতম লিখিত দলিল। পূর্ববাংলা, পশ্চিম পাকিস্তান, ভারত এবং অন্যান্য দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের উচ্ছ্বাসিত অংশগ্রহণে মওলানা ভাসানী যে সাংস্কৃতিক সম্মেলন সফল করেছিলেন সেদিন, বাংলার ইতিহাসে এর আগে বা পরে এ রকম মেধা ও বুদ্ধিমত্তার লড়াই আজ পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারে নি।
কাগমারী সম্মেলনের এক ফাঁকে গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দোপ্যাধায়কে ভাসানী বলেছিলেন,“পূর্ব বাংলা একদিন স্বাধীন হবেই। ১২ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হবে।” চৌদ্দ বছর পরে ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তে বিশ্ব মানচিত্রে সত্যি’ই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হলো।
ভারতবর্ষে অনেক রাজনৈতিক দল ও নেতা ছিলেন। কিন্তু পৃথকভাবে বাংলার স্বাধীনতার কথা যারা ভেবেছেন ভাসানী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি সর্বপ্রথম বাঙালি জাতিসত্তার অনুকূলে পৃথক একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নবীজ বপণ করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে ক্ষমতা লাভের পর আওয়ামী লীগকে পুরনো পথে হাঁটতে দেখে বিস্মিত হয়ে তিনি আয়োজন করলেন কাগমারী সম্মেলনের। ’৫৭-র ৭, ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের অজপাড়াগাঁ সন্তোষ-কাগমারীতেই তিনি ডাক দেন আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের। আওয়ামী লীগ প্রধান হিসেবে নয় বরং সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তি উদ্যোগে আয়োজিত এবং অনুষ্ঠিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন বাংলাদেশের প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক কাম রাজনৈতিক সম্মেলন। এই সম্মেলনে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর তার সাংস্কৃতিক চৈতন্যোদয়ের ডাক দেন। এই সম্মেলনে ভাসানী কেবল স্বাধীনতার আগাম ঘোষণাই দেন নাই; একটি স্বাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দর্শনও উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। আসলে সম্মেলনটি নামে সাংস্কৃতিক সম্মেলন হলেও সেখানে ভাষা, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি, ভূমিব্যবস্থা, কৃষি, রাসায়নিক শিক্ষা, নারীসহ বিষদ বিষয় ছিল আলোচনার বিষয়বস্তু। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রায় সকল বয়সের প্রগতিবাদী লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার, সংগীতাজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ ভারত, ব্রিটেন, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহন করেছিলেন সেই সম্মেলনে।
কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মানুষকে প্রত্যক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি, মজলুম মানুষের জন্য সাম্য ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি প্রতিচ্ছবি তিনি আঁকতে চেয়েছিলেন ওই কাগমারীতে বসেই। সম্মেলনে একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রবল প্রকাশ ঘটেছিল। রাজনীতি আর সংস্কৃতির স্রোতধারাকে এক মোহনায় টেনে এনেছিলেন। যে পথ ধরে হেঁটে হেঁটেই এসেছে এদেশের স্বাধীনতা। তাই কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক।

সর্বশেষ