রবিবার,৯,নভেম্বর,২০২৫
26 C
Dhaka
রবিবার, নভেম্বর ৯, ২০২৫
প্রচ্ছদসম্পাদকীয়মুক্তমতবামপন্থীদের নতুন যুক্তফ্রন্ট: একটা পর্যালোচনা

বামপন্থীদের নতুন যুক্তফ্রন্ট: একটা পর্যালোচনা

সম্প্রতি রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কনভেনশনে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন,  বামপন্থীদের নতুন যুক্তফ্রন্ট দরকার। তিনি আরও বলেন, যারা বিপ্লবে বিশ্বাস করেন তাদেরই দরকার যুক্তফ্রন্ট গঠন করা। তাঁর মতে,  এই যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের মতো নয়, কারণ,  ঐ ফ্রন্টের মাধ্যমে নেজামী ইসলামের উত্থান হয়েছিল;  ঐটা ছিল একটা ভুল যুক্তফ্রন্ট। বর্তমানের যুক্তফ্রন্ট হবে সমাজবিপ্লবে বিশ্বাসীদের নিয়ে। তিনি এই যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সিপিবিকে দায়িত্ব নিতে বলেন কারণ তাঁর মতে,  সিপিবি বৃহৎ দল। তিনি শেষে বলেন, এই যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে না জিতলেও জনগণ জানবে তাদের একটা দাঁড়াবার জায়গা আছে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর এই বক্তব্য বামপন্থীদের মধ্যে বেশ ইতিবাচকভাবে প্রচার হয়েছে। কিন্তু তাঁর বক্তব্য সহজ ও সরল মনে হলেও তা তেমন ইতিহাস ও বাস্তবতা নির্ভর নয় বলে মনে হয়। কারণ তিনি তাঁর এই বক্তব্য এমন এক সময়ে বলেছেন এবং এমন একটি দলকে কেন্দ্র করে বলেছেন যে দলটি চব্বিশের চেতনা নিয়ে তার কংগ্রেস সমাপ্ত করেছে। বাংলাদেশের সমাজ বিপ্লবে এই দলটি সবসময় বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসানের পর থেকে  রাজনৈতিক চিন্তা ও নীতির পরিবর্তন করে চলেছে।  এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত পরে বলা যাবে।  তার আগে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সম্পর্কে অধ্যাপক চৌধুরীর মন্তব্য সম্পর্কে কিছু বলা দরকার।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের পশ্চাৎপটে ছিল পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক ক্ষমতা কাঠামো এবং নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়।  সেই সময়েের রাজনৈতিক বিবেচনায় যুক্তফ্রন্ট একটা গুণগত পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিল। এই গুণগত পরিবর্তন হলো, যুক্তফ্রন্টের বিজয় পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি এবং ভাষা আন্দোলনের মূল বক্তব্যকে সামনে নিয়ে এসেছিল।  যুক্তফ্রন্টের বিজয় এক কথায় বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অভিমূখ নির্দিষ্ঠ করে দিয়েছিল। কথা না বাড়িয়েও বলা যায়, অধ্যাপক চৌধুরীর বক্তব্য ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক অর্জনকে অস্বীকার করেছে।  এখানে প্রসঙ্গত বলা যায়, সেই সময় স্বায়ত্তশাসন অর্জনের বিষয়টাই মূখ্য ছিল। ফলে কমিউনিস্ট পার্টির যুক্তফ্রন্ট গঠন ভুল ছিল-এটা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বেশ বিভ্রান্তিমূলক।
তিনি আরও বলেছেন, এখন যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে হবে সমাজ বিপ্লবকে লক্ষ্য করে। এবার আসা যাক, বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা কিভাবে কাজ করবে। বাস্তব পরিস্থিতি হলো, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে  যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রেজিম চেইঞ্জের নামে যে কালার রেভ্যুলেশন বা ছাত্র অভূত্থান হয়েছে তারই রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এর মধ্যেই ঘটে গেছে  যুক্তরাষ্ট্র- সেনাবাহিনী – জামাত-বিএনপি জোটের উত্থান। এতে সরাসরি যুক্ত ছিল সিপিবি – বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ। এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আওয়ামী লীগের শাসনকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে নতুন স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, মূলনীতির বিপরীতে একটা রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে জামাত আর তাকে ভিন্নরূপে সিপিবি উপস্থাপন করেছে, চব্বিশের চেতনা নামে। এই চব্বিশ ও একাত্তরের চেতনার দ্বন্দ্ব নিয়ে সিপিবি তার কংগ্রেস শেষ করেছে। এরপর ঐকমত্য কমিশনেও সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ বেশ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু এক পর্যায়ে ঐকমত্য কমিশনের মার্কিনী এজেন্ডা জনগণের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ  জাসদ ঐকমত্য কমিশনে যাওয়া বিরতি দেয়। কিন্তু মাঠে তারা যে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে তা বিএনপির মুখপাত্রের অনুরূপ। জনগণের সামনে মৌলবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কোনো আন্দোলন তারা তৈরি করতে পারেনি। ফলে বাস্তবে এখন যা হচ্ছে তা চব্বিশের চেতনার একটা নির্বাচন। ফলে কোনো অর্থেই সমাজবিপ্লবের লক্ষ্য বা আকাঙ্খা নয়।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব সিপিবিকে নিতে হবে বললেও সিপিবির লক্ষ্য একটা বামগণতান্তিক জোট অর্থাৎ, তারা গনতন্ত্র মঞ্চের সদস্যদেরও জোটভুক্ত করতে চায় যদিও,   এরা চলে গেছে বিএনপির বলয়ে। ফলে সিপিবির চিন্তায় আছে  বামফ্রন্ট এবং যুক্তফ্রন্টের একটা মিশ্রিত রূপ। বলা বাহুল্য, চব্বিশের পর সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ যেমন ক্ষমতার অংশ হিসেবে নিজেদের উপভোগ করেছে  তা এখন কমেডিতে পরিণত হয়েছে। এখন নির্বাচন হবে জামাত,  এনসিপি ও বিএনপির ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্য । আর এদের  মোড়ল হলো যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান। এই পরিস্থিতি তৈরির দায় এখন সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদেরও কাঁধে আছে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্যের মূল ফ্যালাসি বা ফাঁকটা হলো সমাজবিপ্লবের অভিমূখী নির্বাচনী জোট হলেও তা হবে বামপন্থীদের জোট, যুক্তফ্রন্ট কেনো? এই ফাঁকটাতো সিপিবির রাজনীতিতেও আছে।  তারাও নির্বাচন করতে চায় বাম গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে, এখানে বিপ্লবের কোনো এজেন্ডা নেই।  বাংলাদেশে চব্বিশের আগে রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে একটা রাজনীতি ছিল।  কিন্তু চব্বিশের মেটিক্যুলাসলি ডিজাইনড অভূত্থানে তা চাপা পড়ে যায়।  কিন্তু এখন  বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল ও গোপন ভূমিকা  স্ফটিক স্বচ্ছ। যাইহোক, বাংলাদেশে গনতন্ত্র পূনরুজ্জীবন ও সমাজতন্ত্রের লড়াইকে জোরদার করতে হলে দরকার গরীব মানুষের সংগ্রামকে শক্তিশালী করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সমর্থীত ইন্টেরিয়াম সরকার ও  মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে একটা বৃহত্তর বামগণতান্ত্রিক ঐক্য।  বলা বাহুল্য, সামনের নির্বাচনে বিএনপি জামাত এনসিপি একই লাইনে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে থেকে নির্বাচনী লড়াই করবে।  কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিকে বজায় রাখতে চায় তাকে অবশ্যই বৃহত্তর পরিসরে সকল বামপন্থী ও গনতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়েই এগুতে হবে। নচেৎ বিএনপি- জামাতের  স্যাটেলাইটেই ঘোরপাক খেতে হবে।
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মতামত তাই একটা ইতিহাসের ভুল পথ বাতলে দেওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এতে চব্বিশের চেতনা প্রসার ছাড়া আর কিছু হবে না।  বাংলাদেশকে এগুতে হবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও সংবিধানের মূলনীতির উপর দাড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদ-মৌলবাদ বিরোধী কর্মসূচি নিয়েই। আর জনগণের মুক্তি ও বিপ্লব এখানেই নিহিত।
লেখক- শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক

সর্বশেষ