।। মিনা মিজানুর রহমান ।।
সাংস্কৃতিক অঙ্গনের আমাদের প্রিয় অচিন্ত্য’দা চলে গেলেন মহা প্রস্থানের পথে! ২৮ মে’২১ শুক্রবার রাত ১১. ২০ মিঃ সময়ে খুলনার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্হায় তাঁর চিরবিদায়।প্রফেসর অচিন্ত্য কুমার ভৌমিক আজীবন শিক্ষকতা আর শিল্প-সাহিত্যের মধ্যে নিজেকে সমর্পিত রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন সাদাসিধা প্রকৃতির আটপৌরে একান্ত বাঙালিয়ানায় সিদ্ধ একজন সাহিত্য প্রেমী মানুষ। লোভ, বিলাসিতা, কৃত্রিমতা কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।
জীবনভর প্রচুর লিখেছেন, একাধারে গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, ছোটগল্প লেখক এমনি শিল্প-সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে অচিন্ত্য’দার ছিল অবাধ বিচরণ। রম্য রচনায় তাঁর ছিল সিদ্ধহস্ত। বাংলাদেশ বেতার খুলনা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত দুই বাংলার শ্রোতাদের কাছে সমাদৃত তাঁরই রচনা রম্য নাটিকা “আয়না” র কথা সবাই জানেন।আধুনিক গান, গণসঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান এবং নানা ধরণের লেখালেখির মধ্যে অচিন্ত্য’দার প্রয়োজনীয়তা আমরা স্মরণ করতে পারি। তাঁর এই প্রস্হানে আমাদের যে সংকট, তা পূরণ করে চলা নিশ্চই কঠিন হয়ে গেলো! আজীবন তিনি সমাজের নীচুতলার শ্রমজীবী মানুষের কথা, সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষের কথা ভেবেছেন,যার বহিঃপ্রকাশ আমরা পাবো কিছু নাটকে,ছোট গল্পে আর গণসঙ্গীতে। কলেজ জীবন থেকেই তিনি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির স্পর্শে ছিলেন। পরবর্তীকালে একটি বাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বিশেষ করে গোপালগন্জের ভাটিয়াপাড়ায় তাঁর জন্ম হলেও দীর্ঘদিন থেকেই খুলনার ফুলতলা দামোদর গ্রামে থাকতে শুরু করেন এবং পরবর্তীতে সেখানে ঘর সংসার করে বসত বাটি গড়ে তোলেন এবং এই এলাকায় দীর্ঘকাল থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির একটি প্রভাব সব সময় তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। অচিন্ত্য”দা এলাকায় বামপন্হী মহলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ধীরে ধীরে সখ্যতা গড়ে তোলেন। কৃষকনেতা কমরেড কামরুজ্জামান লিচু(প্রয়াত), কমরেড হাফিজুর রহমান ভুঁইয়া (প্রয়াত), এইসব মানুষের সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং বাম ঘরানার মধ্যেই তাঁর বসবাস, সে কারণে তাঁর মনস্তাত্ত্বিক জগতেরও পরিবর্তণ লক্ষনীয়, যা তাঁর শিল্প সাহিত্য চর্চাকেও প্রভাবিত করে। তিনি কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকেরও অত্যন্ত প্রিয়ভাজন ছিলেন। কথা সাহিত্যিক হাসান স্যারের বাড়ীও এই ফুলতলায় আমরা জানি।
উল্লেখ্য যে, সরকারি বি এল কলেজের স্বনামধন্য সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপিকা মুক্তি মজুমদার ও প্রফেসর মুহম্মদ কায়কোবাদ ঘটনাচক্রে যখন ফুলতলায আরণ্যক নামের বাড়ী করে বসবাস শুরু করেন, তখন ওই পাড়াগাঁয়ের মধ্যে এক ধরণেন প্রাণ চান্চল্য শুরু হয়ে যায। আরণ্যকে প্রতিনিয়ত সঙ্গীতানুষ্ঠান, সাহিত্যাসর, আলোচনা, সঙ্গীতের নিয়মিত চর্চা,পত্রিকা প্রকাশনা এমনি মুক্তি’দির তত্বাবধানে শিশু-কিশোরসহ সর্বস্তরের মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয় আরণ্যক। বড় বড় অনুষ্ঠান, পহেলা বৈশাখ, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী,আরো কত অনুষ্ঠামালা।এসব কার্যক্রমে অন্যদের সাথে অচিন্ত্য’দার সব সময়ই একটি মূখ্য ভুমিকা ও আগ্রহ লক্ষ্যনীয় ছিল। অচিন্ত্য’দা খুলনার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, ফুলতলার এক সময়ের শতদল শিল্পী গোষ্ঠী,সর্বজন শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানীর উদ্যোগে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্হা যখন গঠিত হয় তখন খুলনায় সংগঠনের শাখা গঠনের বিষয়ে তখন ১৯৮৪ সালে শিল্পী সংগ্রামী সাধন সরকার ও অন্নান্যদের সঙ্গে অচিন্ত্য’দার ভুমিকা ছিল অত্যন্ত দায়িত্বশীল, সর্বশেষে তিনি গণশিল্পীর কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম উপদেষ্টাও ছিলেন। আমরা যখন ফুলতলায় দক্ষিনডিহিতে রবীন্দ্রকমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা নিয়ে নানা কার্যক্রমের মধ্যে, তখন প্রতিনিয়ত তাঁর একটি জোরালো ভুমিকা ছিল।অচিন্ত্য’দার ৭৮ বয়সে এই চলে যাওয়ার শুন্যতা কি পুরণ হবার! অচিন্ত্য’দার বাবা স্বর্গীয় ডাঃপ্রফুল্ল কুমার ভৌমিক, মা স্বর্গীয়া রেনুকা ভৌমিক। তাঁরা পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোন। দাদা,ভালো থাকবেন।খুলনার মানুষ আপনার কথা মনে রাখবে আপনার কর্ম, মানসিকতা আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য। খুলনাকে দেশকে অনেক দিয়েছেন, আপনার স্মৃতির প্রতি অনেক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর অনেক অনেক শুভ কামনা, আপনার অন্তিম যাত্রা আরো বেশী শুভ হোক।।,২৯ মে’২১,রাত্র ১.৫৮ মিঃ,খুলনা।।
লেখক : সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সভাপতি, খুলনা জেলা ওয়ার্কার্স পার্টি