।। ড. সুশান্ত দাস ।।
এ বছর মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৫০ বছর। ইতিহাসের বিপুল সময়ের স্রোতে এই সময় হয়তঃ কিছুই নয়। কিন্তু একজন মানুষের জীবন বিচারে এ সময় কম নয়। যে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী জীবনকে বাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আজ তাদের বিদায় নেবার পালা। অনেকেই বিদায় নিয়েছে, অনেকে দিন গুনছে। শেষ বিকেলে তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়, যে আকাক্সক্ষা আর স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল, বাঙালি জাতি এই ৫০ বছরে তাকি বাস্তবে অর্জন করেছে? করলেও কতটুকু করেছে আর কতটুকু করে নি। না করতে পারলে কেনই বা তা পারে নি। জীবন সায়াহ্নে এসে সে হিসাব তারা করতেই পারে। করাও উচিত। কার’র বা কালের কোনো ব্যর্থতার দায় দিয়ে আজো যারা মুক্তিযুদ্ধকে বা মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকেই নস্যাত করার খেলায় নিত্যদিন তৎপর, তাদের কাছে হেরেই কি তাঁদের পাশে শহীদ হওয়া লক্ষ সাথীর আত্মত্যাগকে ব্যর্থ হতে রদবে, নাকি ব্যর্থতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সামনের পথে আলো দেখানোর চেষ্টা করে যাবে।
আমরা যারা নিজের কানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছিলাম, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-তাঁদের কাছে বঙ্গবন্ধু শুধু আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন না, ছিলেন স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতির প্রতিভূ। দলের নেতা হিসেবে দলগতভাবে আওয়ামী লীগ তাকে নেতা হিসেবে স্মরণে রাখতেই পারে, রাখা উচিত, কিন্তু যে মুজিব বাঙালি জাতির ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী, গোষ্ঠী, দল অতিক্রম করে ইতিহাসের প্রতিভূ হয়ে উঠেছেন, তাকে শুধু দলের করে রাখতে গিয়ে, তাদের দলের কতটুকু লাভ হয়েছে আর জাতি হিসেবে বাঙালির কতটুকু লাভ হয়েছে তার হিসেব ইতিহাস চাইতে’ই পারে।
কিছুটা পিছু ফিরে দেখা যাক। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ একদিনের ঘোষণার যুদ্ধ নয়। ইতিহাস তার সাক্ষী। আসলে এ যুদ্ধ ছিল দীর্ঘ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের চুড়ান্ত নির্যাস। যে দ্বি-জাতিতত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের ‘জনক’ জিন্নাহর বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি না দেবার ঘোষণা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বাংগালি দ্বি-জাতিতত্বের মোহ থেকে বেরিয়ে এসে, তার স্বকীয় জাতিস্বত্তা, ভাষা, সংস্কৃতির দাবিতে জীবন বাজী সংগ্রাম শুরু করে। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক সংগ্রামের সূচনা হয়। ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট গঠন, ২১ দফা ঘোষণা, নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয়ের মধ্য দিয়ে কেবল স্বায়ত্বশাসনের দাবি’ই নয়, স্বাধীকার অর্জনের ভ্রুণও রোপিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল স্বার্থ রক্ষার জন্য যে নিপীড়ণের রাস্তা গ্রহণ করে, ষাটের দশকের শুরুতেই জেনারেল আয়ুব খানের সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে তা চুড়ান্ত রূপ নেয়। ’৬২ ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, সব শেষে ১১ দফার ভিত্তিতে, ’৬৯ এর গণআন্দোলন ও তার বিজয়ের মধ্য দিয়ে জাতিস্বত্ত্বার এই চেতনা রাজনৈতিক রূপ নেয়। যার মূল ভিত্তি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান, জাতি হিসেবে বাঙালি ও বাংলাদেশের ভূখ-ের অধিবাসি সকল জাতিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক স্বাধীকার অর্থাৎ গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন। এবং শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয় নয়, বাংগালি জাতির ধর্ম, বর্ণ, সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার সকল সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে মৌলিকভাবে ধারণ করে এক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ নির্মানের আকাক্সক্ষা, যা ছিল তথাকথিক দ্বি-জাতিতত্বের মতাদর্শিক চিন্তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরু।
’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মদান, ৩ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। ৫০ বছর পর এই কথাগুলো বা শব্দগুলো বহু বহুবার উচ্চারিত সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। তাই আজ থেকে ৫০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গোটা জাতির যে আবেগ, উচ্ছ্বাস, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর অশ্রু কান্না কালের গর্ভে বিলীন হয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তো তা কোনোদিনও একই তাৎপর্য নিয়ে ধরা দেবে না। হয়তো কালের নির্মোহ বিচারে কাটাছেঁড়া হবে, মুক্তিযুদ্ধে কি ঠিক ছিল, কি বেঠিক ছিল। কিন্তু তাই বলে ঐ ঐতিহাসিক বাস্তবতা তো মিথ্যে হয়ে যাবে না, সে আকাক্সক্ষার অনেক কিছুই অপূর্ণ রয়েছে বলেই তো সেই আকাক্সক্ষা আর প্রত্যাশা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় না। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল সেই ধরণের অগ্নিগর্ভ আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ যা ইতিহাসের কোলে বাঙালি জাতির স্বত্বাকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে। উদ্গীরিত লাভার উত্তাপ না থাকতে পারে, তাই বলে সেই উদ্গীরিত বাস্তবতার মর্মববস্তু মিলিয়ে যায় না। বরং তা অগ্নেয় শিলার কাঠিন্যে ভবিষ্যতের অর্জনের জন্য স্তুপীকৃত হয়ে থাকে, তাকে অর্জন করার লড়াই অব্যাহত রাখতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধ একটি স্বাধীন মানচিত্র দিয়েছে, লাল-সবুজের পতাকা দিয়েছে, দিয়েছে জাতীয় সংগীত যা বাঙালির আবহমান সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে। এটা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য যে, ’৭২ সালেই জাতি তার প্রত্যাশিত একটি সংবিধান পেয়েছিল, যা মৌলিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙক্ষা আর চেতনাকে অনেকাংশেই ধারণ করেছে। যে সংবিধান বিগত দশকের পর দশক ধরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সাংস্কৃতিক লড়াই এবং প্রায় ১০ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আকাঙক্ষার প্রতিফলন হিসেবে সংবিধানের ৮ম অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ কে। কিন্তু গত ৫০ বছরে সেই সংবিধানের সংশোধন বা কাটাছেঁড়া হয়েছে ১৬ বার। বহুবার সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ইতিহাসের উল্টোযাত্রা। ’৭২ এর সংবিধানকে ফিরিয়ে আনতে আনতেও আনা যায় নি। রাষ্ট্রধর্মের বিধান যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা বহাল রয়েছে। এই ধারার মধ্য দিয়ে এদেশের অন্য সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সাংবিধানিকভাবে সমানাধিকার বহির্ভূত অবস্থায় নেওয়া হয়েছে, যদিও সংবধানের ২ক ধারায় সকল ধর্ম পালনের সমাধিকার বিধান গৃহীত রয়েছে। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এ প্রশ্ন উঠতেই পারে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোন ধারা সংবিধানে থেকে যাবে কিনা।
চার মূলনীতির অন্যতম নীতি ‘জাতীয়তাবাদ’কে বিকৃত করার চেষ্টা হয়েছে। এখনো নিরন্তর হয়, দ্বি-জাতিতত্বের নয়া সংস্করণ ‘ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে’ নিয়ে যাবার। মাঝে মাঝে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের শ্লোগানও শোনা যায়। আবার অন্যদিকে উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের সংমিশ্রনের জোশে এই স্বাধীন ভূ-খন্ডে বসবাসকারী সকল আদিবাসী, নৃ-জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিস্বত্তা, নিজ সম্পত্তি ও বাসের অধিকার থেকে উৎখাত আর উচ্ছেদের প্রতিনিয়ত ঘটনা চলে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের পাহাড়ী ও সমতলের আদিবাসীরা আজ নিজভূমে পরবাসী হয়ে পড়ছে, যা মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ সকল ঘটনা কোনক্রমেই মুক্তিযুদ্ধের অর্জন হিসেবে চিত্রিত করা যায় না।
সংবিধানের মূলনীতিতে সন্নিবিষ্ট ‘সমাজতন্ত্র’ কথাটি কিন্তু বাত কি বাত বসে যায় নি। ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটি বহু আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। সমাজতন্ত্র অর্জন বা গঠন নিয়ে মতভেদ আছে, বিতর্ক আছে। কিন্তু যারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে বা বিপক্ষে সবাই একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে, সমাজতন্ত্র কথাটি ‘বৈষম্যহীন সমাজ’ তৈরির শাব্দিক রূপ। সমাজতন্ত্র এমন একটি ধারণা যা নির্দেশ করে সকল অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক বৈষম্যের নিরসন। খুব সহজ কথায় বললে বলতে হয়, সমাজের অভ্যন্তরে কেউ কাউকে শোষণ করতে পারবে না, সবাই তার সামর্থ অনুযায়ী তার বাঁচার অধিকার পাবে-এটাই সমাজতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর আজ এটা স্পষ্ট যে গোটা সমাজ বৈষম্যহীণ নয়, বৈষম্যময় হয়ে উঠেছে। একসময় ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটিকে সংবিধান থেকে বিদায় করা হয়েছিল, যাতে সাংবিধানিকভাবে বৈষম্য প্রতিষ্ঠাকেই জায়েজ করা যায়। আজ তা প্রতিস্থাপিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কার্যককারিতা হারিয়েছে। অর্থনৈতিক সূচকে দেখলে দেখা যাবে দেশের ‘গিনি সূচক’ এখন ০.৫ শতাংশ, যা চুড়ান্ত বৈষম্যের পরিচায়ক। দেশ এমডিজি, এসডিজি সূচক অর্জনে সাফল্যে দেখিয়েছে, তা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর অবস্থা নির্দেশ করে না। এটা ঠিকই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাড়ার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলারের উপরে, মাথাপিছু আয় ২০০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে, ‘উন্নয়নশীল’ দেশের তকমা অর্জিত হয়েছে, কিন্তু বৈষম্যের সূচক যা নির্দেশ করছে তা দিয়ে বোঝা যায়, সম্পদের সিংহ ভাগ গুটিকয়েক লোকের হাতে পুঞ্জিভূত হয়েছে। আর রাষ্ট্র ও ক্ষমতাসীন সকল সরকারই সংবিধানকে উপেক্ষা করে সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখছে। সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে মালিকানার নীতি নির্ধারিত। তাতে বলে হয়েছেঃ ‘(ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা, অর্থাৎ অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান ক্ষেত্র লইয়া সুষ্ঠু ও গতিশীল রাষ্ট্রায়ত্ত সরকারি খাত সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা; (খ) সমবায়ী মালিকানা, (গ) ব্যক্তিগত মালিকানা, অর্থাৎ আইনের দ্বারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে ব্যক্তির মালিকানা। ‘খুব স্পষ্টতঃই দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাই মালিকানার প্রধাান ধরণ। কিন্তু বাস্তবতা বিপরীত। রাষ্ট্র এবং ক্ষমতায় গিয়ে সকল সরকারই সংবিধান নির্দেশিত বিধান লংঘন করছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে নস্যাত করে ব্যক্তিমালিকানার স্বার্থটাকেই প্রধান করে দেখা হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে জুট, চিনি শিল্প নিয়ে বর্তমান সরকারের সাম্প্রতিক গৃহীত সিদ্ধান্তও সংবিধান পরিপন্থী। দেশের স্বার্থ বৈশ্বিক নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতির হাতে সমর্পণের সুস্পষ্ট প্রয়াস। বৈষম্যহীন সমাজ বা অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তা সাযুজ্যপূর্ণ নয়-যা মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার বিপরীত।
গণতন্ত্র’ বহুচর্চিত, বহু আলোচিত শব্দ এবং ’৭২ এর সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি। গণতন্ত্র কি, তার সমাজতাত্ত্বিক বা অভিধানিক অর্থের বিতর্কের মধ্যে না যেয়ে ‘গণতন্ত্রে’র কিছু বোধগম্য নির্দিষ্ট রূপের কথা বলা যায়। সহজ কথায়, সংক্ষেপে গণতন্ত্র হলো, বাক-স্বাধীনতা, ভোটাধিকার, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা পাবার অধিকার, আইনের শাসন পাবার অধিকার, ন্যায্য বিচার পাবার অধিকার, কাজ পাবার অধিকার, ন্যায্য মজুরি পাবার অধিকার, নারী পুরুষের সমানাধিকার থাকার অধিকার, যেকোনো বিচারে সংখ্যালঘু মানুষের সকল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক নিশ্চয়তা ও স্বাধীনতা পাবার অধিকার। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, এ সবই ‘গণতন্ত্রের বা গণতান্ত্রিক অধিকারের নির্দিষ্ট রূপ। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর আমরা কি দেখছি? দশকের পর দশক এ সকল অধিকার ভূলুন্ঠিত হয়েছে। দেশের জনগণ লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে, তা পুনরুদ্ধারের জন্য। তা অর্জিত হয়েছে আবার হাতছাড়া হয়ে গেছে। আজ সহজ সত্য হলো গণতন্ত্র সুদূর পরাহত। বাক স্বাধীনতা নেই, কখনো রাষ্ট্র ও সরকার তা রুদ্ধ করছে, কখনো সমাজের অভ্যন্তরে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি রুদ্ধ করছে। নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড চলছে, রাষ্ট্র সেই সাংবিধানিক দায় নিচ্ছে না। ভোটাধিকার প্রহসনে পরিণত হয়েছে, ধ্বংসের পথে ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠান। সবাই তা জানছে। এর জন্য কারা কখন দায়ি তাও জানছে কিন্তু কেউ স্বীকার করছে না। তাই মুক্তিযুদ্ধের ‘সুবর্ণজয়ন্তীকালে’ এটা বলাই যায়, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেনি বা চায় নি তাদের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত ‘সংবিধান’ রক্ষা করা বা মেনে চলার দায় নেই, তারা সেই দায় স্বীকারও করে না। বরং তারা ক্ষমতায় যেয়ে ‘সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করবে এবং করেছে। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক দায় বহন করে বলে দাবি করে, তাদেরকে তো সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে এবং ‘সংবিধান’ নির্দেশিত পথে রাষ্ট্র ও দেশকে পরিচালিত করতে হবে। তারা যখন এই কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হন, তখন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি সেই সুযোগটা গ্রহণ করে। যা অতীতেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও যে হবে না তার নিশ্চয়তা নেই। ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর।
সব শেষে বলা জরুরি, ইতিহাসের ক্রান্তিকালে, সমসাময়িক প্রজন্ম ইতিহাসের দায় তুলে নেয়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে একটা প্রজন্ম সেই দায় তুলে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে অর্জন করেছিল। পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাকে রক্ষা করতে না পারলে সে দায় তারা অস্বীকার করতে পারে না। তাই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যা অর্জন, সে সংবিধানই হোক বা আরো কোন সোনালী ভবিষ্যতই হোক সে দায় তো এই প্রজন্মকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ‘সুবর্ণজয়ন্তী’তে এটাই ইতিহাসের দায়।
লেখক: পলিটব্যুরোর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।