।। ড. সুশান্ত দাস ।।
রাজনীতি তো ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা নয় যে, জিতলে মিষ্টি খাওয়া হবে আর হারলে মন খারাপ করে সংসার ত্যাগী হতে হবে। দার্শনিকভাবে রাজনীতি হলো গভীর সামাজিক প্রক্রিয়া, যাকে ভিত্তি করে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সমাজকে আরো উন্নত এবং মানুষের কল্যাণ হওয়ার দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়। এই প্রক্রিয়ায় কেউ পরিবর্তন বা কল্যাণের এর পক্ষে, কেউ তার বিপক্ষে। তবে এই পরিবর্তন হওয়া বা না হওয়ার প্রক্রিয়ায় মানুষই নির্ধারক। মানুষের চেতনা, সংগঠন কি অবস্থায় আছে তার ওপর নির্ভর করে কতটুকু এগিয়ে যাওয়া যাবে, কতটুকু পরিবর্তন হবে। আজ এটা কারুর অস্বীকার করার উপায় নাই যে, উৎপাদন ব্যবস্থা ও তার ওপর ভিত্তি করে উৎপাদিত সম্পদ মানুষের মধ্যে বন্টনই হলো মানুষের ভালো থাকার চাবিকাঠি। এ নিয়ে মোটাদাগে যে বিতর্ক তাহলো উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকানা ব্যক্তিগত থাকবে না সামাজিক হবে। দীর্ঘ সামাজিক ইতিহাস এটাই বলে যে অধিকাংশ ঐতিহাসিক কাল ধরেই ব্যক্তিগত মালিকানাই প্রধান ছিল আর তার ফলে সমাজের যে বৈষম্য আর দ্বন্দ তৈরি হয়েছে তার মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতায় বিভিন্ন স্তর এগিয়েছে, আজো তাই হচ্ছে। এটা আজ প্রায় সর্বজনস্বীকৃত যে সমাজে ব্যক্তিমালিকানার ফলেই তৈরি হয় বৈষম্য আর সংকট। ব্যক্তিমালিকানা অক্ষুন্ন রেখে এই বৈষম্য দূর হয়, এটা আর কেউ বলতে পারে না। যারা ব্যক্তিমালিকানা রাখার পক্ষে তারাও সংকট যাতে না বাড়ে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায় তারজন্যে এই বৈষম্য কমানোর প্রস্তাব বা চেষ্টা করে। আর একটা সমাধান তাহলো, উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা। গোটাবিশ্ব আজ এই দুই চিন্তায় বিভক্ত। কিন্তু, রাজনীতি হলো এই ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংগ্রাম। এটা খুব সহজ এবং সরল নয়। যে কথাগুলো অতি সহজে তাত্ত্বিকভাবে বলা হলো, এটা মানুষের কাছে সহজে বোধগম্য নয়। আর এই ব্যবস্থা গড়ে তোলার এই লড়াইয়ে দুইপক্ষ আছে এটা তো বোঝাই যায়। তবে পক্ষগুলো সব সময় বোঝা যায় তাও নয়। বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন চেহারায় তারা পক্ষে বিপক্ষে থাকে। যতদিন মানুষ তার অভিজ্ঞতা আর সংগঠিত অবস্থা দিয়ে এই পক্ষ বিপক্ষ না বোঝে, এই বৈষম্য আর শোষণ এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারে ততদিন তার বিজয় অসম্ভব। তাকে প্রভাবিত, প্রতারিত করার বহু পথ থেকে যায়। তার শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, প্রচলিত ধারণা বহু বিষয় মানুষকে আটকে রাখে। তার পিছিয়ে পরা চিন্তা তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ে। মানুষ নিজেই নিজের মধ্যে বন্দী থাকে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার লড়াইটাই সার্বিক অর্থে রাজনৈতিক লড়াই। মানুষকে তার নিজস্ব মুক্তির পথে নিয়ে আসাটাই প্রগতিশীলতা, আর তার বৈষম্যের ঘেরাটোপে বেঁধে রেখে ব্যক্তিমালিকানার বাস্তবতা অক্ষুন্ন রাখার প্রক্রিয়াই প্রতিক্রিয়াশীলতা। মানুষকে এই অবস্থায় রেখে দেবার স্বার্থ হলো ব্যক্তিমালিক এবং তাদের সহযোগীদের। এই লড়াই অত্যন্ত জটিল। যারা সরাসরি রাজনীতি করে তারাও এই লড়াইয়ের অংশীদার, যাদের জনগণ বলা হয়, স্বার্থটাতো তাদেরই। রাজনীতি প্রত্যক্ষভাবে যারা করেন, জনগণের অংশ না হলেই তারা বিজয়ে উল্লসিত হন আর পরাজয়ে ভেঙে পড়েন। আসলে এ লড়াই তো নিরন্তর লড়াই এর অংশ। মন খারাপ হতে পারে, অনেক সময় জনগণ নিজেই নিজের স্বার্থ না বুঝে উঠতে পারে, অথবা তার নিজের মত করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এমনকি যারা তাদের প্রতারিত করছে, তাদের দ্বারা আচ্ছন্ন হতে পারে, তাতে লড়াইটা কঠিন হয়। কিন্তু, জনগণের সঙ্গে নিরন্তর যুক্ত থাকলে, জনগণ তা বুঝতে পারে এবং তার মধ্য দিয়ে জনগণকেও বোঝা যায়। পরিবর্তন এর এই লড়াইটাই বিপ্লবী প্রক্রিয়া।
লেখকঃ পলিটব্যুরোর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।