৩১ মে। বাংলাদেশের প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি এবং সাম্রাজ্যবাদ-মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতা ও সন্ত্রাসবাদবিরোদী আন্দোলনের ইতিহাসে দিনটি এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। ১৯৮৮ সালে যখন সারাদেশে বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী স্বৈরশাসক এরশাদের আনীত ‘রাষ্ট্রধর্ম’ বিলের বিরুদ্ধে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে একাধারে ‘স্বৈরশাসক এরশাদ হটাও’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী’ আন্দোলনকে এগিয়ে নিচ্ছিলো। ঠিক সেই সময় স্বৈরাচার এরশাদের পরোক্ষ মদদপুষ্ট হয়ে আজকের দিনে নতুন করে মরণ কামড় বসিয়েছিলো একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলাম ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির। তাদের প্রশিক্ষিত সশস্ত্র সন্ত্রাসীবাহিনী প্রকাশ্য দিবালোকে মেইন হোস্টেলের সামনে ৩০-৩৫ জন শিক্ষকের সামনেই উপর্যুপরি কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেধাবী ছাত্র ডাঃ জামিল আকতার রতনকে। দিনটিকে সকল প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো ‘সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়ে থাকে।
ঘটনার সূত্রপাত ১৯৮৮ সালের ৩০ মে রাতে। শিবির মিছিল করে মহড়া দিচ্ছে। তখন মেডিকেল কলেজে সব মিলিয়ে কয়েক’শো ছাত্রের আবাস। শিক্ষার্থীরা মারাত্মক কিছুর আশংকা করছিল, ভীত ছিল। যদিও সে সময়ের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক রেষারেষি থাকলেও, সেটা খুন পর্যন্ত গড়ানো একেবারেই অস্বাভাবিক ছিল। প্রধান ছাত্রাবাসের (বর্তমানে শহীদ কাজী নুরুন্নবী ছাত্রাবাস) সাধারণ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাকর্মীদের সকলেই শিবিরের গতিবিধি লক্ষ্য রাখছিলেন। সে সময় রাজশাহী মেডিকেল কলেজে শিবির সমর্থন করতো সব মিলিয়ে বড়জোর ৩০-৪০ জন ছাত্র।
হঠাৎ শিবিরের সেই মিছিলে এসে জুটলো বহিরাগত শতাধিক জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার, সবার হাতেই দেশীয় অস্ত্র। সেই অস্ত্র নিয়ে তারা সারারাত চালালো মধ্যযুগীয় মহড়া এবং তারা সকলেই প্রধান ছাত্রাবাসের পশ্চিম-উত্তর ব্লকে অবস্থান নেয়। ৩১ মে আনুমানিক সকাল ১১টায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিছিল নিয়ে অধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে অবগত করে যে ওই ছাত্রাবাসের কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে অস্ত্রসহ শিবিরের অনেক বহিরাগত অবস্থান করছে। এতে করে সাধারণ ছাত্ররা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আর পুরো ছাত্রাবাসে থমথমে ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে মেডিকেল কলেজ প্রশাসনের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
ততক্ষণে একাডেমিক কাউন্সিল এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের জন্য একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় বসে গিয়েছেন। ছাত্রদের কথা শুনে একাডেমিক কাউন্সিল সরেজমিনে গিয়ে সত্যতা যাচাই করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মিটিং থেকেই অধ্যক্ষসহ একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য ও অন্যান্য শিক্ষকের একটি প্রতিনিধিদল ছাত্রাবাসে যান। শিক্ষকদের সাথে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্র মৈত্রীর তৎকালীন সভাপতি ডা. জামিল আকতার রতনসহ আরো কয়েকজন ছাত্রও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। শিক্ষকবৃন্দ দুইটি ব্লক দেখে যখন পশ্চিম-উত্তর ব্লকে ঢুকতে যান, তখনই বাধা আসে সেখানে অবস্থানরত শিবিরের ক্যাডারদের কাছে থেকে। শিবিরের ক্যাডারদের মধ্য থেকে কয়েকজন শিক্ষকদের সাথে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচারণ করলে পঞ্চম বর্ষের ছাত্র ডাক্তার জামিল তার তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ করেন।
হঠাৎ এক অপার্থিব তীব্র হুইসেলের শব্দ বাজিয়ে “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহু আকবার” স্লোগান দিয়ে শিবিরের শতাধিক অস্ত্রসজ্জিত সন্ত্রাসী শিক্ষকদের সামনেই কাপুরুষের মত নিরস্ত্র জামিলকে ধাওয়া করে এলোপাতাড়িভাবে কোপাতে থাকে। এসময় তার হাত-পায়ের রগ কেটে দেয় একাত্তরের ঘাতক আলবদরের কায়দায়। জামিলের মৃত্যু নিশ্চিত করে শিবিরের ক্যাডাররা পরস্পরের সাথে আলিঙ্গন করে, পরস্পরকে চুম্বন করে উল্লাস প্রকাশ করে। পরে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হলে সেখানেই তিনি মারা যান। পরবর্তীতে মেডিকেল কলেজ প্রশাসনের পাঠানো বিবৃতিতে সম্পূর্ণ ঘটনা উঠে আসে। বিবৃতির মাধ্যমে জানা যায়, ডাঃ জামিলকে হত্যাকালে বেশকিছু গাড়ি ভাঙচুর ও বোমা বিস্ফোরণ করে শিবিরের সন্ত্রাসীরা। স্বৈরচার এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম বিল বিরোধী আন্দোলনের প্রথম শহীদ ডা. জামিল আকতার রতন।
শহীদ জামিল জানতেন সেই মুহূর্তের প্রতিবাদের ফল কি হতে পারে। কিন্তু তিনি ভীত হন নি। শহীদ জামিলের প্রতিবাদ কোন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিলো না, বরং তা ছিলো অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে গড়ে ওঠা এক সচেতন প্রয়াস। শহীদ জামিলের সচেতন আত্মত্যাগের অগ্নিশিখা মশাল হয়ে আজো পথ দেখায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রায়।