নিতাই চন্দ্র রায়
বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ চর্চার একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। বিংশ শতাব্দির তিরিশের দশকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক কালে এই চর্চা শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ম্যানোফেস্টোতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গিকার ব্যক্ত করা হয়। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রজনতাসহ মধ্যবিত্ত সমাজের বড় অংশ সমাজতন্ত্রকে আগ্রহ ভরে গ্রহণ করে। সে আগ্রহের প্রতিফলন ঘটে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে। সমাজতন্ত্রের রূপ ,ধরন ও চরিত্র নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও বিরোধী বা সরকারি সকল রাজনৈতিক দল লক্ষ্য হিসেবে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করে। পরবর্তী কালে নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বিশেষ করে সামরিক শাসনামলে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রচ- ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সমাজতন্ত্রের সমর্থক দলগুলি একদিকে যেমন ছিল নানা উপদলে বিভক্ত অন্যদিকে সামরিক শাসকদের নির্যাতন ও প্রলোভনে পড়ে অনেকেই সমাজতন্ত্রের নীতি ও আদর্শ পরিত্যাগ করে সরকারি সুযোগসুবিধা ভোগের অংশীদার হন। আর এভাবেই বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাধাগ্রস্ত হয় । বাম দলগুলি সমাজতন্ত্রের কথা প্রচার করলেও তা জনগণে কাছে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানোফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন এবং প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জের জনসভাগুলিতে সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, তখন তা মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় এবং শ্রমজীবী মানুষের মনে নতুন আশা-আকাঙ্খার সঞ্চার হয়।
১৯৩৬ সাল। কলকাতা মেডিকেল কলেজে গ্লুকুমা রোগে আক্রান্ত বালক মুজিবের দু’চোখে অপারেশন করা হয়। তখন তিনি ছিলেন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। ডাক্তারের পরামর্শে কিছু দিন লেখাপড়া বন্ধ রেখে চশমা পড়তে হয়। চোখের চিকিৎসার পর তিনি মাদারিপুর চলে আসেন। মাদারিপুরের ঘরে ঘরে সে সময় স্বদেশীদের দুর্গ। ইংরেজ বেনিয়াদের প্রতি তাঁর তীব্র ক্ষোভ । ওদের এদেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে। যুদ্ধ করতে হবে। এসব চিন্তা-চেতনা ও বিপ্লবী ভাবনা তাঁকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর একনিষ্ট ভক্ত বানিয়ে ফেলে। সুযোগ পেলেই তিনি গোপালগঞ্জ ও মাদারিগঞ্জে চলে যান। জ¦ালাময়ী বক্তব্য শোনেন। স্বদেশী আন্দোলনের লোকজনের সাথে দেখা করেন। তখনই তাঁর বালক মনে দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি সৃষ্টি হয় অসীম মমত্ব বোধ ও নিখাদ ভালোবাসা। পরবর্তীতে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর চুম্বকীয় আকর্ষণ তাঁকে লৌহখন্ডের মতো টেনে নিয়ে আসে ছাত্র রাজনীতিতে।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় দিনরাত অনাহারি মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মতো মহৎ কাজে তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হয় মানুষের প্রতি অসীম মমত্ব বোধ। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। কলকাতা, নোয়াখালি ও আসামের সাম্প্রদায়িক দাঙার ভয়াবহ দৃশ্য তাকে বিচলিত করে এবং মানবিক গুণে গুণান্বিত হতে উৎসাহিত করে। সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই- এই সত্য প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করে।
ধর্ম ভিত্তিক যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য শেখ মুজিব ও তার অনুসারিরা আন্দোলন করেন. সেই পাকিস্তান হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যেই তাদের মোহ ভাঙতে শুরু করে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানীরা যে বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে জাতিকে মুকবধির বানাতে চায়। বাঙালির শিল্প, সাহিত্য , ইতিহাস ঐতিহ্য ধ্বংস করে পঙ্গু জাতিতে পরিণত করতে চায়- এটা তার বুঝতে বাকি রইলো না। তারপর ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিদ্ধের মাধ্যমেই বাঙালির আসল আত্মপরিচয় ও বেঁচে থাকার দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রকাশ ঘটে ।
উল্লেখিত প্রতিটি আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার জন্য যে লোকটি সারাটা জীবন জেল খাটেন, সংসার ত্যাগ করে কারাগারের নির্জন সেলে জীবন কাটান তিনিই বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব। তিনি কৃষক, শ্রমিক ও মেনতী মানুষের বন্ধু। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্ট্রা। আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চের মধ্যরাতে। তিনিই ৭ই মার্চে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ মানুষের সমাবেশে দাঁড়িয়ে বজ্রকষ্ঠে ঘোষণা করেন- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম ্ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতান সংগ্রাম।
জনগণ তার আহবানে অস্ত্র হাতে নেয়। নয় মাস যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে। মুক্ত ম্বদেশে লাল সবুজের পতাকা উড়ায়। লাভ করে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত মানচিত্র। ২ লাখ মা বোনের অশ্রু আলপনায় আঁকা সবুজ স্বদেশ। সেই দেশের কোনো বাঙালি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারে- এটা তিনি মোটেই বিশ^াস করতেন ন্ া। বিদেশী গুয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে তাঁকে এব্যাপারে একাধিক বার সতর্ক করা হলে তিনি তাতে কর্নপাত করেননি । কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যদিও চিলির আলেন্দে, কঙ্গোর লুমুম্বা, তুরস্কের কামাল আততুর্ক, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন ও ভারতের মহাত্মা গান্ধীর হত্যার করুণ ইতিহাস তার অজানা ছিল না।
তারপরও ঘটলো ১৫ আগষ্টে সপরিবারে জাতির জনক হত্যার কলঙ্কজনক ঘটনা। ক’জন বিপদগামী সেনা সদস্য এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে- যাই বলা হোক না কেন- এর পেছেনে ছিল দেশী-বিদেশী গভীর ষড়যন্ত্র। খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর , শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো আওয়ামী লীগার, স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানী ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এদেশের দালালেরা। জাসদ নামে অতি বিপ্লবীদের – এব্যাপারে কম ভূমিকা ছিল না। মুজিব হত্যার বিচার হলেও এই হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের এখনো বিচার হয়নি। জাতির কাছে প্রকাশ হয়নি তাদের স্বরূপ। ১৯৭৪ সালে তথাকথিত বিপ্লবীদের খুন, থানা লুট, বোমা হামলা, যেখানে সেখানে অস্ত্রের ব্যবহার , সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বিদেশী দুতাবাস আক্রমণের মতো ন্যাক্কার জনক ঘটনা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ^াসী একটি সংগঠন অবলীলা ক্রমে যখন ঘটিয়ে যায়, তখন স্বাধীনতার পক্ষের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে বাকশাল গঠন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরনের নামে জেলা গভর্নর নিয়োগ ক্ষেপিয়ে তুলে পাকিস্তানী ভাবধারার আমলাদের। সমবায় পদ্ধতিতে যান্ত্রিক চাষাবাদের মাধ্যমে তিনি যখন আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রয়াস চালান,ঠিক তখনই তাকে নির্মমভাবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব, তাঁর ছোট ভাই শেখ নাসের, পুত্র কামাল, জামাল, শিশু রাসেল সহ ১৮ জনকে।অথচ কী আশ্চর্যের বিষয় সিড়িতে জাতির জনকের রক্তের দাগ শুকানোর আগেই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের নেতারাই মন্ত্রীত্বের শপথ গ্রহণ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত অবহেলা ও অনাদরে টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত গ্রামে সমাহিত করা হয় হয়। তার মৃত্যুর সংবাদে স্তম্ভিত হয়ে যায় সারা বিশে^র শান্তিকামী মানুষ। অশ্রুর বন্যায় ভেসে যায় বাংলাদেশ।মানুষের কাঁন্নার ধ্বনীতে , অশ্রুর উত্তাপে বিষণœ বিমর্ষ হয়ে উঠে প্রকৃতি কারবালার কুয়াচ্ছন্ন প্রান্তের মতো।
বাকশাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, হয়তো শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। এজন্য পরোয়া করি না। ওই মৃত্যু আমার জীবনে অনেক বার এসেছে। একসিডেন্টলি আজো আমি বেঁচে আছি। অবশ্যই আমাকে মরতে হবে। মৃত্যুর ভয় আমার নেই। জনগণ যদি বোঝে আমার আইডিয়া ভালো, তাহলে তারা তা গ্রহণ করবে। আমার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। আমার একটি বড় শান্তনা আছে। যুদ্ধের সময় জনগণের সাথে আমি থাকতে পরিনি। জনগণ আমার আদেশ ও নির্দেশে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধিন করেছে। আজকের এই শোষণমুক্ত সমাজতন্ত্র বা অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লবে আমি যদি নাও থাকি তা হলে আমার দৃঢ় বিশ^াস আমার বাঙালিরা যে কোনো মূল্যে আমার রেখে যাওয়া আদর্শ ও লক্ষ্য একদিন বাংলার বুকে বাস্তবায়ন করে ছাড়বে ইনশাল্লাহ। এ থেকে পরিস্কারভাবে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু আদর্শ ছিল শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। যেখানে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিকানা থাকবে জনগণের হাতে। আর রাষ্ট্র সকল মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্তান ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।
১৯৫১ সালে শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন ভ্রমণে সময় তিনি বলেন, আমি নিজে কমুনিষ্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ^াস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ^াস করিনা। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হবে না। পুজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ^ যুদ্ধ লাগাতে বদ্ধ পরিকর।
চারিত্রিক দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ কোনো সমাজতান্ত্রিক দল নয়। মুসলীম লীগের একটি প্রগতিশীল অংশ মওলানা ভাসানি ও তরুণ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলীম লীগ নামে একটি দল গঠন করে। আওয়ামী লীগে এখন আর তাজউদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল আলম খান, আসম আব্দুর রব, আঃ রাজ্জাক, শাহজাহান সিরাজের মতো প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন নেতারা নেই। ছাত্র সংগঠনে নেই কোনো রাজনৈতিক পাঠচক্র । নেই প্রতিযোগিতা অন্য ছাত্র সংগঠনের সাথে বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। হচ্ছে না নিয়মিত ছাত্র সংসদের নির্বাচন। সরকারি মিল কারখানার শ্রমিক নেতারা আগের মতো সমাজতন্ত্র কায়েমের কথা চিন্তাই করেন না। তাহলে সে আদর্শ কীভাবে বাস্তবতার মুখ দেখবে তা একমাত্র ভবিষ্যতই বলতে পারবে। আওয়ামীলীগের ম্যানিফেস্টোতে আছে- আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শোষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমান শোষণ, বৈষম্য অবিচার ও দুর্দশার হাত হতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব বলে আওয়ামী লীগ বিশ^াস করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা কল্পে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামী লীগের চূরান্ত লক্ষ্য। এই আদর্শ হচ্ছে একটি বিপ্লরী আদর্শ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া এই আদর্শ নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে কি? চীন , রাশিয়া, কিউবায় বিপ্লবের মাধ্যমে পুরাতন ব্যবস্থা বদলানো হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে নতুন ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু খোন্দকার মোহামম্দ ইলিয়াসের সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেন, এ দেশে যুগ যুগ ধরে শোষিত হয়েছে কৃষক, শোষিত হয়েছে শ্রমিক, শোষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সকল মেহনতি মানুষ। এ দেশের জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শোষণ। শোষণ চলে উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ। এ দেশের সোনার মানুষ এ দেশের মাটির মানুষ শোষণের একবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কি/ এই প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে তিনি পথের সন্ধান পান। তাঁর কোনো কোনো সহযোগি রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন, শ্রেণি সংগ্রামের কথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলেন জাতীয়তাবাদের কথা। জিন্নাবাদ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। তবে জবাবে তিনি বলেন, যার যার ধর্ম তার তার- এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা। সেই সঙ্গে বলেন, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা। শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র অফরিহার্য। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়- গণতান্ত্রিক পন্থায়। সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন, যুগোশ্লাভিয়া প্রত্যেকে নিজ নিজ পথে , নিজ নিজ অবস্থা মোতাবেক গড়ে তুলেছে সমাজতন্ত্র। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা , গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চারটি মূল সূত্রধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে।
মার্কসের মতে, ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেণির শোষণ ও দারিদ্র্য যত বাড়বে, তত তীক্ষè ও তীব্রতর হয়ে উঠবে সামাজিক বিরোধ। মুক্তি আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণীর দায়িত্ব বেড়ে যাবে। এই বিরোধ ও সংকট শান্তিপূর্ণ সমন্বয়ে মেটে না; একমাত্র বিপ্লব ছাড়া এ বিরোধের জন্য কোনো উপায় নেই। মার্কস দেখালেন- শোষণ, দারিদ্র্য, শ্রেণীবৈষম্য পুঁজিবাদের অপরিহার্য অঙ্গ। সুতরাং এই শোষণ, দারিদ্র্য ও শ্রেণীবৈষম্য দূর করতে হলে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার মূলে যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা তাকে একেবারে ভেঙ্গে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা চেতনা ও ভাবনার সাথে কার্ল মার্কর্স , লেলিন ও মাওসেতুং-এর বাস্তব চিন্তার এখানেই মৌলিক পারতক্য এবং পথ ও পদ্ধতির ভিন্নতা।
লেখকঃ মহাব্যবস্থাপক(কৃষি),বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন।