খুবি ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন
বিশেষ প্রতিনিধি : একাত্তরের গল্লামারীর খুলনা রেডিও সেন্টার, পাক হানাদার বাহিনীর অন্যতম প্রধান নির্যাতন কেন্দ্র। সামনের অবিকৃত টিনের ছাউনিও ছিল টর্চার সেল। গল্লামারী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার খাল-বিল হাজারো শহীদের রক্তমাংশের স্মৃতি চিহ্ন। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও সংরক্ষিত হয়নি এসব স্থান, এমন কী মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মরণে নির্মিত গল্লামারী বধ্যভূমির’ ‘স্বাধীনতা সৌধ’ অর্থাভাবে পূণাঙ্গ রূপ পায়নি। ফলে অনেকটাই হতাশ মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারানো পরিবারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে কাজ করা মানুষেরা।
তারা বলেছেন, হাজার বার দাবি জানালেও বর্তমান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সেই রেডিও সেন্টার ও টিনের টর্চার সেল সংরক্ষণ হয়নি। বরং একতলা বিশিষ্ট রেডিও সেন্টারটি দ্বিতীয় তলার রূপ পেয়েছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিলেই এই স্থাপনাগুলো জাদুঘরের রূপ দেয়া সম্ভব হতো।
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্তরিক। এ নিয়ে তাদের পরিকল্পনা রয়েছে।
সাংবাদিক ও গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ নামক বইয়ের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় গল্লামারীতে ময়ুর নদীর ওপর কোন সেতু ছিল না, পোল ছিল। তখন খুলনা সাতক্ষীরা সড়কও হয়নি। এলাকাটি ছিল নির্জন। রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করা ও এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে হানাদাররা তৎকালীন সময়ের এই রেডিও সেন্টারের দখল নেয় এবং তাদের টর্চার সেলে পরিণত করে। মানুষকে ধরে নিয়ে এখানে ঘর ও ঘরের সামনে থাকা গাছে ঝুলিয়ে রেখে নির্যাতন করা হত। নির্যাতনের ফলে অনেকে মারা যেতেন। আবার অনেকে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অথবা জবাই করে হত্যা করা হত। পরে তাদের লাশ গল্লামারী এলাকার বিলের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়া হত। স্বাধীন হওয়ার পর রেডিও সেন্টারের ভবন ও টিনসেটের ওই ঘরে অনেকেই নির্যাতিতদের রক্তমাখা জামা কাপড় ও ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্র দেখেছেন।’
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাকহানাদার বাহিনীর হাতে নিখোঁজ শহীদ মোক্তার হোসেনের ছেলে মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, ‘গল্লামারী এলাকা ও এখনকার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার প্রতিটি মাটির কনা, জলে আমাদের স্বজনদের রক্তমাংশ মিশে আছে। দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প হয়, কিন্তু গল্লামারী স্বাধীনতা সৌধ পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলেই পুরনো রেডিও সেন্টার, টর্চার সেল সংরক্ষণ করতে পারতো। ওই বধ্যভূমিতে আবার বাবার দেহের অংশ পড়ে রয়েছে। আমরা একটু হলে স্বস্তি পেতাম। কিন্তু তা হয়নি।
আবেগাপ্লুত টুটুল আরও বলেন, ‘শুধু নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন সংরক্ষণই নয়, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি স্থাপনার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামকরণ করার দাবি জানাই। তাহলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সর্ম্পকে জানতে পারবে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খুবি)’র জনসংযোগ ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) আতিয়ার রহমান বলেন, ‘পুরনো রেডিও সেন্টারটি ছিল একতলা, সেটি এখন দ্বিতল ভবন। প্রথম এটি একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন হিসেবে ব্যবহার হলেও। বর্তমানে মর্ডান ল্যাংগুয়েজ, আইআর’র ক্লাস নেয়া হয়। এছাড়া বেশকয়েকটি দপ্তর রয়েছে। টিনের চালার ঘরটি পরিবহন পুলের সেড হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তবে এটি অবিকৃত রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে এদুটি স্থাপনা সংরক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা রয়েছে। এগুলো জাদুঘর বা আর্কাইভ আদলে গড়ে তোলা হবে।’
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির খুলনা জেলা সাধারণ সম্পাদক মহেন্দ্র নাথ সেন বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরের দুটি স্থাপন সংরক্ষণের জন্য বলেছি। কিন্তু সেটি আলোর মুখ দেখেনি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আন্তরিক হলেই মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম স্মৃতি চিহ্ন হতো খুলনা। নতুন প্রজন্ম পাকহানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের ইতিহাস জানতে পারতো।’
বর্তমানে স্মৃতিময় কিছু কথা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় গেটের বাইরে একাত্তরের আর্কাইভ ও জাদুঘরের উদ্দ্যোগে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে।