জন্ম ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের ফরিদপুরে।
প্রয়াত কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় ও মীরা গঙ্গোপাধ্যায়ের ঘরে জন্ম নেয়া সুনীল মাত্র চার বছর বয়সেই কলকাতায় যান। সেখানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, দম দম মতিঝিল কলেজ ও সিটি কলেজে লেখাপড়া করেন। কলেজের পাঠ চুকানোর পর ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি নেন তিনি।
এরই মধ্যে লেখালেখির সঙ্গে সম্পৃক্ততা গড়ে ওঠে সুনীলের। ১৯৫৩ সাল থেকে তার সম্পাদনায় প্রকাশ হতে থাকে সাহিত্য পত্রিকা কৃত্তিবাস। আর এই পত্রিকাই পরবর্তীতে হয়ে ওঠে নতুন কাব্যধারার অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সুনীলের লেখা ‘নিখিলেশ’ আর ‘নীরা’ সিরিজের কবিতাগুলো তরুণদের মুখে মুখে ছিল বহুদিন।
সুনীলের প্রথম কবিতা ‘একটি চিঠি’ প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালে, দেশ পত্রিকায়। বয়স তখন ১৭ বছর। সে বছরই ‘আগামী সাহিত্য’ নামের একটি সাহিত্যপত্রের সম্পাদনা শুরু করেন।
১৯৫৩ সালে প্রকাশিত ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’য় তার লেখা ‘তুমি’ কবিতাটি প্রকাশের পর আলোচনায় উঠে আসেন সুনীল। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে তরুণ সুনীল পর্যন্ত খ্যাতিমান কবিদের কবিতা ঠাঁই পায় ওই সঙ্কলনে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে। একই নামে পরে একটি উপন্যাসও লিখেছেন তিনি। প্রথম কবিতার বই প্রকাশের প্রায় এক দশক পর ১৯৬৬ সালে বাঙালি পাঠকের হাতে আসে সুনীলের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’।
সুন্দরের মন খারাপ মাধুর্যের জ্বর, সেই মুহূর্তে নীরা,স্মৃতির শহর, সুন্দর রহস্যময়, আমার স্বপ্ন, আমি কি রকম ভাবে বেঁচে আছি, ভালোবাসা খণ্ডকাব্য, নীরা, হারিয়ে যেও না, অন্য দেশের কবিতা, ভোরবেলার উপহার, সাদা পৃষ্ঠা তোমার সঙ্গে, হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভু কাব্যগ্রন্থগুলো এখনো পাঠকপ্রিয়।
পাঠক সুনীলের কাছ থেকে পেয়েছে শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ, সেই সময়, প্রথম আলো ও পূর্ব পশ্চিমের মতো প্রায় দুই শতাধিক গ্রন্থ। দুই বাংলায় তুমুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি সাহিত্য সমালোচকদেরও মনোযোগ কেড়েছে বইগুলো।
ঊনিশ শতকের ভারতবর্ষে বাঙালি নবজাগরণের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘সেই সময়’ উপন্যাসের জন্য ১৯৮৫ সালে সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার পান সুনীল। প্রথম প্রকাশের পর দীর্ঘদিন সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের মর্যাদা ধরে রাখে তার ওই উপন্যাস।
একই ঘটনা ঘটে ইতিহাস নির্ভর ‘প্রথম আলো’ ও ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসের ক্ষেত্রেও। ১৯৪৫ সালের দেশভাগের পটভূমিতে লেখা পূর্ব-পশ্চিমে উঠে আসে পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গের তিন প্রজন্মের অভিজ্ঞান।
সুনীলের কলম থেকে বেরিয়ে আসা গোয়েন্দা কাহিনী ‘কাকাবাবু-সন্তু’ কিশোর বয়সীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৭৪ সালের পর থেকে এই সিরিজের ৩৫টি উপন্যাস লেখেন তিনি।
নীললোহিত, সনাতন পাঠক, নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে সুনীল লিখে গেছেন ভ্রমণ কাহিনী, গোয়েন্দা গল্প, কখনোবা শিশুতোষ সাহিত্য। ভারতের জাতীয় সাহিত্য অ্যাকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর অ্যাকাদেমির সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
সাহিত্যে সার্থকতার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮২ সালে বঙ্কিম পুরস্কারের পাশাপাশি ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে দুই বার আনন্দ পুরস্কার পান। ২০১১ সালে দ্য হিন্দু লিটারেরি পুরস্কারসহ জীবনভার বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন সুনীল।
বরেণ্য এই কথা সাহিত্যিককে ২০০২ সালে সাম্মানিক পদ ‘কলকাতার শেরিফ’ হিসাবে নিয়োগ দেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
সুনীলের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে, দেশ পত্রিকায়।
আক্রমণাত্মক ও সোজাসাপ্টা কথা বলার ঢংয়ের কারণে সে সময় বেশ বিতর্কের জন্ম দেয় উপন্যাসটি। সুনীল পরে নিজেও স্বীকার করেন, বিতর্কের মাত্রা দেখে ‘আতঙ্কে’ তিনি কয়েক দিন কলকাতার বাইরেও কাটান সে সময়।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তরুণ ‘সুনীল’ একজন ভবঘুরে। কলকাতায় বেড়ে ওঠা এই ব্যতিক্রমী চরিত্রের তরুণকে ঘিরেই গড়ে ওঠে উপন্যাসের জমিন।
আত্মপ্রকাশের পর অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, কবি ও নর্তকী, একা এবং কয়েকজন, স্বর্গের নীচে মানুষ, আমিই সে, মেঘ বৃষ্টি আলো, রক্তমাংস, দুই নারী, স্বপ্ন লজ্জাহীন, সোনালী দুঃখ, প্রথম প্রণয় প্রকাশিত হয়।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে সুনীল লেখেন স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজী। ‘শাজাহান ও তার নিজস্ব বাহিনী’, ‘আলোকলতার মূল’ নামে দুটি গল্পগ্রন্থও রয়েছে তার।
‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ ও ‘রাশিয়া ভ্রমণে’ তুলে এনেছেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।
সুনীলের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসকে চলচ্চিত্রের রূপ দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। আর লালনকে নিয়ে লেখা সুনীলের ‘মনের মানুষ’ এর চলচ্চিত্রায়ন করেছেন গৌতম ঘোষ।
অপর্ণা সেনের ইতি মৃণালিনী চলচ্চিত্রে ‘গান হয়ে’ দর্শকের কানে বাজে সুনীলের কবিতা স্মৃতির শহর। কাকাবাবু সিরিজের দুটি কাহিনী নিয়েও চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে।
পরিণত বয়সের একটি দীর্ঘ সময় কলকাতার প্রকাশনা জগতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান আনন্দবাজার গ্রুপের বিভিন্ন প্রকাশনায় যুক্ত ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
১৯৫৪ সালে স্নাতক ডিগ্রি নেয়ার পর ইউনেস্কোর বয়স্ক শিক্ষা প্রকল্পে কাজ শুরু করলেও মাত্র তিন মাসের মাথায় তিনি ইস্তফা দেন। ওই বছরই নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্স কোম্পানিতে ট্রেইনি অফিসার হিসেবে যোগ দিলেও কাজের ধরণ ধাতে না সওয়ায় ছেড়ে দেন সেটিও।
এরপর শুরু হয় প্রাইভেট টিউশনি। টিকে থাকার সংগ্রামে দীর্ঘদিন ছাত্র পড়িয়ে উপার্জনই ছিল তার একমাত্র আয়ের উৎস। এরপর ১৯৭০ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় সাব-এডিটর হিসেবে সাংবাদিকতার জীবন শুরু হয় এই সাহিত্যিকের। সর্বশেষ সম্পৃক্ত ছিলেন ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে।
১৯৬৭ সালে স্বাতী বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সুনীল। তাদের একমাত্র সন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম সেবছরই। ১৯৭৭ সাল থেকে তারা বসবাস করে আসছিলেন কলকাতার ২৪ মান্দেভিলে গার্ডেনসে।
এক জীবনে যখন যাই করেছেন, কবিতাই ছিল সুনীলের অনেকটাজুড়ে। সে কথা তিনি লিখে গেছেন কবিতায়ও।
সুনীল বলেছেন, “শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম,/ শুধু কবিতার/ জন্য কিছু খেলা,/ শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা/ভুবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য/…
“শুধু কবিতার জন্য, আরো দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।/ মানুষের মতো ক্ষোভময় বেঁচে থাকা, শুধু/ কবিতার জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।”



