“পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যকার সীমান্ত আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলিতে ইতোমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন বহু সেনা। চরম উত্তেজনার এই পরিস্থিতি শুধু দুই দেশের সম্পর্ক নয়, গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যও নতুন শঙ্কা তৈরি করেছে”
আফগান তালেবান সরকারের দাবি, পাকিস্তানের একটি বিমান হামলার জবাবে তারা সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে পাল্টা প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়। তালেবান মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ জানান, ওই হামলায় পাকিস্তানের অন্তত ৫৮ সেনা নিহত হয়েছে। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে ইসলামাবাদ ভিন্ন দাবি করেছে। পাকিস্তান বলছে, তাদের ২৩ সেনা নিহত হলেও পাল্টা অভিযানে তারা ২০০ জনেরও বেশি তালেবান ও তাদের সহযোগী ‘সন্ত্রাসী’কে হত্যা করেছে।
সাম্প্রতিক এই সহিংসতার সূত্রপাত ৯ অক্টোবর রাতে, যখন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল ও পাকতিয়া প্রদেশে পরপর কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। আফগান কর্তৃপক্ষ এই বিস্ফোরণের জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে। তাদের অভিযোগ, পাকিস্তান আফগান ভূখণ্ডে ঢুকে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসলামাবাদ এ অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার না করলেও সরাসরি স্বীকারও করেনি। তবে পাকিস্তানের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে জানান, তাদের এই বিমান হামলার লক্ষ্য ছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিগোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) শীর্ষ নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ। আফগান পক্ষ বলছে, সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের এই ঘটনার পর তারা বাধ্য হয়েই জবাব দিয়েছে। আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ভবিষ্যতেও যদি পাকিস্তান এমন হামলা চালায়, তাহলে আরও কঠোর জবাব দেওয়া হবে।
তালেবান সরকারের বক্তব্যের জবাবে পাকিস্তান বলছে, আফগানিস্তান এখন সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। ইসলামাবাদের দাবি, আফগান ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়ে টিটিপির সদস্যরা পাকিস্তানে একের পর এক হামলা চালাচ্ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর পাকিস্তানে টিটিপির হামলায় ২ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ২০২৪ সালেও এই সংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার ৫০০। সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, এই হামলার মাত্রা বেড়েই চলেছে, যা ২০২৫ সালকে পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছরে পরিণত করতে পারে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সময় তালেবান সরকারের মধ্যস্থতায় টিটিপির সঙ্গে পাকিস্তান সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে যেতে সক্ষম হয়েছিল। তবে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেই যুদ্ধবিরতি ভেঙে যায়, এবং হামলার মাত্রা বাড়তে থাকে। এরই প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সীমান্তবর্তী আফগান এলাকাগুলোতে বিমান হামলা বাড়ায়। ইসলামাবাদ বলছে, এসব হামলার লক্ষ্য ছিল কেবল টিটিপি ঘাঁটি।
এই সংঘর্ষের বিষয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ তালেবান বাহিনীর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি শুধু উসকানিমূলক নয়, বরং একটি স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে স্পষ্ট আগ্রাসন। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নাকভি বলেন, তালেবান বাহিনী বেসামরিক লোকজনের ওপরও গুলি চালিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তালেবান সরকারের পক্ষ থেকেও পাল্টা প্রতিক্রিয়া এসেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, তাদের ভূখণ্ডে পাকিস্তানের হামলার কোনও যৌক্তিকতা নেই। নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা প্রয়োজনীয় জবাব দিতে বাধ্য হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও নজর পড়েছে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের দিকে। ইরান, কাতার ও সৌদি আরব—তিনটি দেশই দুই পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এই উত্তেজনা প্রশমিত না হলে পুরো অঞ্চল আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। কাতার ও সৌদি আরব কূটনৈতিক পথে সংকট সমাধানের আহ্বান জানালেও ভারত এখনো এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংঘাত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি নয়। কারণ সামরিক শক্তিতে পাকিস্তান তালেবানের তুলনায় অনেক এগিয়ে। তবে, যদি টিটিপির ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা না হয়, তাহলে সীমান্তে উত্তেজনা অব্যাহত থাকবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাবেক কূটনীতিক ও আফগান বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আসিফ দুররানি মনে করেন, দুই দেশের সংকটের মূল কেন্দ্রে রয়েছে টিটিপি। তালেবান সরকার নিজেদের ভূখণ্ডে টিটিপির উপস্থিতি অস্বীকার করায় সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব হচ্ছে না।
সূত্র: আল জাজিরা



