বৃহস্পতিবার,২৫,ডিসেম্বর,২০২৫
15 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৫, ২০২৫
প্রচ্ছদসম্পাদকীয়মুক্তমতকফি আনান থেকে গুতারেস: রোহিঙ্গা প্রত্যাবসান সুদূরপরাহত!

কফি আনান থেকে গুতারেস: রোহিঙ্গা প্রত্যাবসান সুদূরপরাহত!

কফি আনান থেকে গুতারেস: জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিতে রোহিঙ্গা সমস্যা : তিন দিন ব্যাপী সম্মেলনে চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য : বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও আশিয়ান দেশের সম্পৃক্ততার গুরুত্ব :

রোহিঙ্গা প্রত্যাবসান সংকটে ও সুদূরপরাহত!

২০১৭ সালে জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গা বিষয়ে একটা কমিশন গড়ে দিলে জাতিসংঘের পরোক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ সংযুক্তি শুরু হয়। এই সময় আরাকানে ভয়াবহ বৌদ্ধ ও আরকানী মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা হচ্ছিল। সেই পরিপ্রক্ষিতে কফি আনান রোহিঙ্গা প্রত্যাবসান ও আরকানে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় বেশ কিছু সুপারিশ করে। রোহিঙ্গা সমস্যা শুরু হয়েছিল তারও আগ থেকে।

১৯৭৮ সাল থেকে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব একপ্রকার প্রত্যাহার করে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে আখ্যায়িত করলে সংকটের শুরু হয়। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে আখ্যায়িত করে এবং তাদের মিয়ানমারের আদি কোনো জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে।

অন্যদিকে রোহিঙ্গারা আরকানকে স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত এলাকায় পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেয়। ষাটের দশকে রোহিঙ্গা জাতীয়তাবাদী নেতারা মূল ভূখণ্ডের নাগরিক হিসেবে রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় ছিল কিন্তু মিয়ানমার সরকারের নানা নিপীড়নমূলক নীতির কারণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে ইসলামিক রোহিঙ্গা রাষ্ট্র গঠনের দাবি বৃদ্ধি পায় এবং সৌদি আরব ও অন্যান্য রাষ্ট্রের সহযোগিতায় সশস্ত্র যুদ্ধে লিপ্ত হয়।

তখন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক ভাবে কাজ করে এবং কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা স্বদেশে ফেরত যায়।

বর্তমানে সমস্যা বেশ জটিল। মিয়ানমার অভ্যন্তরীণ জাতিগত যুদ্ধে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে এখন।

বাংলাদেশ কাল থেকে তিনদিনের একটা আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে সম্মেলন শুরু করে। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশ অংশ গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও সম্মেলনের সফলতা কামনা করা হয়।

কিন্তু রোহিঙ্গা প্রত্যাবসান সহজে শুরু হবে মনে হয় না। কারণ চীনা রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, যেকোনো প্রত্যাবসানে সংশ্লিষ্ট দুটি দেশের সমঝোতা লাগবে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা অতিথি, মিয়ানমার তাদের মাতৃভূমি। এই দুই দেশের সমঝোতা জরুরি। তিনি ইঙ্গিত দিয়ে বলছেন, অনেকে হয়তো মনে করছেন, মিয়ানমার সরকার দূর্বল। তাদের সাথে কথা বলে বেশি কাজ হবে না। অপেক্ষা করা ভালো। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মিয়ানমার একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র।

চীনা রাষ্ট্রদূত আরও যোগ করেন, আরাকান আর্মিকে কারা অর্থ, অস্ত্র ও তথ্য প্রদান করে তাও জানতে হবে। চীন এসবের সাথে যুক্ত নয়। তাই সকল পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে আসতে হবে।

চীনের প্রস্তাব তাই, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, জাতিসংঘ ও আশিয়ান দেশগুলোকে একসাথে কাজ করে একটা ক্ষুদ্র অংশকে ফেরত নিয়ে, তার মডেলে কাজ করতে হবে।

আরাকানে যেমন রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে তেমনি খাদ্য সংকটও তীব্র হচ্ছে। কিন্তু আরাকানে এখন রোহিঙ্গাদের সংখ্যা তিন লাখে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৪ লক্ষের কাছাকাছি। এরমধ্যেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ইউএস সহায়তা কমে এসেছে। জনপ্রতি ১৮ ডলার থেকে তা ৬ ডলারে নেমে এসেছে। কয়েক মাসের খাদ্য আছে। এই ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য সংকট তীব্র হবে।

মাদক, হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ ক্যাম্পগুলোতে দিন দিন বাড়ছে। অবৈধ অভিবাসন, নারী পাচার বাড়ছে। বাড়ছে ডাকাতি, মুক্তিপণ ও সশস্ত্র কর্মকান্ড।

আর বাড়ছে, আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, বাংলাদেশের স্থানীয় নাগরিকদের সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া এবং তাদের সাথে রোহিঙ্গাদের সম্পর্ক সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে। ক্যাম্পে কর্মরত স্থানীয়দের চাকরিও চলে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা একটা বিস্ফোরণের দিকে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা জাতিসংঘের আহবান পর্যন্ত এবং রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র একদিন বিপদে পড়বে যদি রোহিঙ্গাদের মর্যাদা ও মানবাধিকার সহ ফেরত পাঠানো না যায়। তাই বাংলাদেশকে চেষ্টা করতে হবে, মিয়ানমার রাষ্ট্র যাতে দ্বিপাক্ষিক ভাবে এই কাজে সম্মত হয়।

এই সম্মেলনে যদি রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তার অঙ্গীকার পাওয়া যায় তবে সম্মেলন সফল বলে বিবেচিত হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক- শরীফ শমশির

লেখক ও গবেষক

সর্বশেষ