শুক্রবার,১৯,এপ্রিল,২০২৪
36 C
Dhaka
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়কমরেড জ্যোতি বসু’র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি - বাঙালির মনে চিরজীবী হয়ে থাকবেন

কমরেড জ্যোতি বসু’র প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি – বাঙালির মনে চিরজীবী হয়ে থাকবেন

।। রাশেদ খান মেনন ।।

কমরেড জ্যোতি বসুকে প্রথম দেখি মুক্তিযুদ্ধের সময়। মুক্তিযুদ্ধের সহায়তার জন্য সিপিআই(এম) তখন সহায়তা কমিটি গঠন করেছে। পশ্চিম বাংলায় আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থী ছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বামপন্থী সংগঠন ও ব্যক্তিদের সংগঠিত হতেও তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ঢাকায় পঁচিশে মার্চের গণহত্যার কালরাতের পর আমরা তখন ঢাকার অদূরে নরসিংদীর শিবপুরে চলে এসেছি। সেখানে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। খবর এলো মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত ভূমিকা গ্রহণ করতে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সংগঠনসমূহের এক বৈঠক আহ্বানের পরামর্শ দিয়েছে সিপিআই(এম)। তারা এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। এই খবরের ভিত্তিতে ভারতের আগরতলা হয়ে কলকাতায় গেলাম। সেখানে সিপিআই(এম)-এর পক্ষ থেকে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। সেখানেই প্রথম পরিচয় হলো সিপিআই(এম)-এর সর্বভারতীয় ও পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্বের সাথে। আর এই সুবাদেই কমরেড জ্যোতি বসুর সাথে প্রথম দেখা। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর ব্যক্তিত্বের পরিচয় পেয়ে।
দেশে থাকতেই কমরেড জ্যোতি বসু সম্পর্কে এক প্রবল আগ্রহ ছিল। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত হয়েছি। তার স্বল্প পরেই বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে ঐতিহাসিক বিতর্ক শুরু হয়। তাতে দেশে দেশে ভাগ হয়ে পড়েন কমিউনিস্ট কর্মীরা। কেউ মস্কোর পক্ষে, কেউ চীনের পক্ষে। এ ধরনের এক সময়ে খবর এলো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে গেছে। চীনাপন্থী নামে পরিচিতরা সিপিআই (মার্কসবাদী) গঠন করেছেন। এই ভাগাভাগিতে কমরেড জ্যোতি বসুর অবস্থান কি জানার প্রবল আগ্রহ ছিল। পরে জেনেছি যে তিনি সিপিআই(এম)-এর নেতা।
সে সময় পূর্ব পাকিস্তান, আজকের বাংলাদেশে, ভারতের রাজনীতি, বিশেষ করে কমিউনিস্ট রাজনীতি সম্পর্কে খুব কম খবরই পাওয়া যেত। এদেশে সোভিয়েত-চীনের বই ও পত্র-পত্রিকা বাজারে আসা শুরু হয়েছে। কিন্তু ভারতের সাথে বৈরী সম্পর্কের কারণে সে দেশের বই বা পত্র-পত্রিকা এদেশে আসত না। তবে ‘উল্টোরথ’ জাতীয় সিনেমা ম্যাগাজিন আসত এবং সে সবের বহু ভক্ত পাঠক ছিল।
যাক সে সব কথা। বস্তুত ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে আমাদের প্রজন্মের মানুষদের প্রকৃত পরিচয় ঘটে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। অবশ্য তার আগে সিপিআই(এম)-এর উদ্যোগে পশ্চিমবাংলার খাদ্য আন্দোলন সম্পর্কে খবর এদেশে পৌঁছেছে। পৌঁছেছে সেখানে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সংবাদও। জেনেছি যে জ্যোতি বসু ও পশ্চিমবাংলার বামপন্থীদের উদ্যোগে ভূমি সংস্কার সাধিত হচ্ছে। এর পুরোভাগে রয়েছে সিপিআই(এম)। এর কিছুদিন পর নকশাল আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছে এদেশে বামপন্থী কমিউনিস্টদের উপর। এখানকার তরুণ কমিউনিস্ট কর্মীরা প্রবলভাবে প্রভাবিত হচ্ছেন তার দ্বারা। আমরা নিজেরাও প্রভাবিত হয়েছি। গোপন পথে সিপিআই(এম-এল)-এর পত্রিকা ‘দেশব্রতী’ও আসা শুরু করেছে। এপার বাংলায় তখন প্রবল জাগরণ ঘটছে জাতীয়তাবাদী চেতনার। কমিউনিস্টরাও তার বাইরে নয়। বরং এখানে বিতর্ক, কোন পথে বাংলাদেশে স্বাধীনতা আসবে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আগেই দেশে আওয়াজ উঠেছে ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধর, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর।’ আর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর এটাই আমাদের প্রধান আওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মস্কো ও চীনাপন্থী পার্টির বাইরে আমরা তখন ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ গঠন করেছি। প্রথমদিকে পশ্চিম বাংলার নকশালপন্থীদের সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান উজ্জীবিত করলেও অচিরেই আমরা বুঝে ফেলেছিলাম যে নকশাল আন্দোলনের ব্যক্তি হত্যার পথ, গণসংগঠন বিলুপ্ত করা, এসব আমাদের পথ নয়। বরঞ্চ জনগণকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানীদের সাথে সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে কিভাবে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা যায় সেটাই আমাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। আমরা তখন ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র স্লোগান দিয়ে দেশের সর্বত্র সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছি। আর সে কারণে পঁচিশে মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার পর অস্ত্র হাতে প্রতিরোধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে আমাদের এতোটুকু সময় লাগে নি।
সে সময় বাংলাদেশের বামপন্থীদের সাহায্য প্রদান করতে সিপিআই(এম)-এর হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় আমরা বিরাট আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলাম। কারণ যে চীনাপন্থীদের অনুসারী হিসেবে আমাদের পরিচিতি ছিল, সেই চীনের মুক্তিযুুদ্ধবিরোধী অবস্থান আমাদের হতাশ করে তুলেছিল। আর ভারতে গিয়ে নকশালপন্থী আন্দোলনের যে চেহারার সাথে পরিচিত হলাম তাতে তাদের তথাকথিত বিপ্লববাদ সম্পর্কে যে সামান্য মোহ ছিল সেটাও কেটে গেছে।
লিখতে বসেছি জ্যোতি বসুকে নিয়ে। সেখানে নিজেদের কথা এসে গেল। এর প্রাসঙ্গিকতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাতে সিপিআই(এম) ও কমরেড জ্যোতি বসুর সাথে পরিচয়ের সূত্র হিসেবে। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের বামপন্থী আন্দোলনকে সিপিআই(এম) ও কমরেড জ্যোতি বসু যে সহায়তা দিয়েছিলেন তার ঋণ শোধ করা যাবে না। এদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণ ভারত সরকার সন্দেহের চোখে দেখতো। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গিও একই ছিল। সে সময় যদি সিপিআই(এম)-এর আশ্রয় ও সহযোগিতা না পাওয়া যেতো তবে বামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ খুবই দুরূহ হতো। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে দেশের অভ্যন্তরে চৌদ্দটি স্থানে যে প্রতিরোধ কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল তার সমন্বয় করা যেতো না। আমাদের হয় দেশের অভ্যন্তরে ফিরে যেতে হতো অথবা ভারতে শরণার্থী হয়ে দিন কাটাতে হতো।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই সূচনালগ্নে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে কমরেড জ্যোতি বসু যে বক্তৃতা দেন তা অনন্য। তিনি সরাসরি ভারত সরকারকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান জানান এই বক্তৃতায়। মুক্তিযুদ্ধের সহায়তার জন্য তাঁর নেতৃত্বেই সিপিআই(এম) বড় ধরনের তহবিল সংগ্রহ করে- যা আমাদের সহায়তার জন্য ব্যবহৃত হতো।
১৯৭১-এর জুন মাসে সিপিআই(এম)-এর সহযোগিতায় কলকাতার বেলেঘাটায় একটি স্কুলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বামপন্থী কমিউনিস্ট ও অন্যান্যদের নিয়ে একটি সভা হয় এবং সেখানে মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতিতেই তাঁকে আহ্বায়ক করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। এর আগে আমরা কমরেড জ্যোতি বসুর পরামর্শ নিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি ও কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত আমাদের সর্বপ্রকার সহায়তার কথা বললেও আমাদের কর্মসূচি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিজেদেরই স্থির করতে বলেন। তাঁরা জানান যে তাঁরা কেবল তাঁদের অভিজ্ঞতার কথাই বলতে পারেন। যা কিছু করার তা আমাদেরই করতে হবে। অপর দেশে পার্টি ও আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ বা নিজেদের মত চাপিয়ে না দেয়ার এই নীতি সিপিআই(এম) সবসময়ই অনুসরণ করেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসকালীন এই সময়ে কমরেড জ্যোতি বসুর সাথে বিভিন্ন সময় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সিপিআই(এম)-এর দপ্তরে তাঁর ছোট ঘরে বসে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এ সময় তাঁর বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা এবং বিশেষ করে আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে কাজ করছিলাম তাদের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ লক্ষ করেছি। আমরা তখন বয়সে একেবারেই তরুণ। ফলে সিপিআই(এম)-এর তরুণ কর্মীদের সাথে আমাদের যে সখ্য গড়ে উঠেছিল সেখানে কমরেড জ্যোতি বসুর সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে তাদের ঈর্ষাকাতরতা দেখতাম মাঝে মাঝে।
কমরেড জ্যোতি বসু বাংলাদেশকে কতো ভালবাসতেন তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি পরবর্তীকালে গঙ্গার পানি নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে তাঁর ভূমিকা নিয়ে। তখন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের শাসন। দিল্লী গেছি বেড়াতে। দিল্লীতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার আমাদের বললেন যে তিনি গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে পশ্চিমবাংলায় যাচ্ছেন কমরেড জ্যোতি বসুর সাথে আলোচনা করতে। আমরা যেন তার আগে তাঁর সাথে দেশে ফেরার পথে কলকাতায় গিয়ে প্রাথমিক আলাপ করে একটা ইতিবাচক ক্ষেত্র প্রস্তুত করি। আমার মনে আছে, কলকাতায় নেমে আমি, রনো আর কর্নেল আকবর (পরে বিএনপির মন্ত্রী) সিপিআই(এম) অফিসে গিয়ে কমরেড জ্যোতি বসুর কাছে গঙ্গার পানির প্রশ্নে বাংলাদেশের দাবির ন্যায্যতার বিষয়ে বেশ সময় ধরে আলাপ করি। তিনি আমাদের কথা খুব মন দিয়ে শোনেন এবং আলোচনার ভিত্তিতে এর একটি ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য কেন্দ্রকে বলবেন বলে আশ্বাস দেন। পরদিন হাইকমিশনার তাঁর সাথে দেখা করলে তিনি তাকেও গঙ্গার পানির ন্যায়সঙ্গত সমাধানের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন এবং আকাশবাণী সে কথা প্রচার করলে আমাদের আনন্দ রাখার জায়গা ছিল না। এর ধারাবাহিকতায় কমরেড জ্যোতি বসুর বিশেষ উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আন্তর্জাতিক গঙ্গার পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এরই ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে এর কিছুদিন আগে তিনি কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য ও অসীম দাশগুপ্তকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। এর কিছু আগেই কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছে এবং দিল্লীতে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছে। সে সময় কথা উঠেছিল কেবল নয়, একেবারে স্থির নিশ্চিত ছিল যে কমরেড জ্যোতি বসু ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি তাতে মত দেয় নি। দিল্লীর কেন্দ্রে একজন বাঙালি প্রধানমন্ত্রী-এ ধরনের একটি ঐতিহাসিক সম্ভাবনার অপমৃত্যুতে এদেশে আমরা নিদারুণভাবে হতাশ হয়েছিলাম। তার পরপরই তিনি বাংলাদেশে আসেন। এ ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থান নিয়ে বিশেষ কৌতুহলী ছিলাম। তবে এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করার কোনো সাহস ছিল না। কিন্তু ঘটনা এমন দাঁড়াল যে আমাদের পার্টির দেয়া সংবর্ধনা সভায় নিয়ে আসার জন্য কমরেড রনো তাঁকে আনতে গেলে তিনি নিজে থেকেই বিভিন্ন বিষয় আলাপ করতে গিয়ে তাকে বলেন, তাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে না দেয়া ছিল একটি ‘ঐতিহাসিক ভুল’। কমরেড রনোর কাছ থেকে এটা জানার পর আমরা বিস্মিতই হয়েছিলাম। তবে তিনি আমাদের মনের কথাই প্রতিধ্বনিত করেছিলেন। এদেশে আমরা মনে করি, কমরেড জ্যোতি বসুকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে না দেয়া কেবল ঐতিহাসিক ভুলই ছিল না, এর ফলশ্রুতিতেই বিজেপি পরবর্তীতে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করতে পেরেছে। এ সম্পর্কে আমাদের মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে ভারতের বামপন্থী আন্দোলনের সাথে উপমহাদেশের বামপন্থী আন্দোলনের যুক্ততা আছে। ভারতে বিজেপি সরকার ও তার রাজনীতি বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থাকেই তাদের কর্মকা- দ্বারা বিশেষ সুবিধা করে দেয়।
সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কমরেড জ্যোতি বসুর বাংলাদেশের প্রতি পক্ষপাতিত্বের আরো প্রমাণ আমরা পাই তিন বিঘা করিডোর সমাধানে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকার ঘটনায়। এ ক্ষেত্রে তাঁকে বামফ্রন্টের শরিক আরএসপির কিছু নেতার চরম বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু তিনি তার পরোয়া করেন নি। সম্প্রতি তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির রাজ্য সরকারের যে বিরোধিতা আমরা দেখেছি সেটা জ্যোতি বসু বা বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবাংলার ক্ষমতায় থাকলে হতো না।
কমরেড জ্যোতি বসু কেবল একজন ভালো কমিউনিস্ট নেতা বা তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন না, তিনি ছিলেন দক্ষ প্রশাসক। পশ্চিমবঙ্গের ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, শিল্পোন্নয়ন-এসব ক্ষেত্রেই তাঁর সরকারের অনন্য সাধারণ ভূমিকা ছিল।
কমরেড জ্যোতি বসু অনলবর্ষী বক্তা ছিলেন না, ছিলেন ধীরভাষী। কিন্তু তাঁর বক্তৃতা ও আলাপকালে যে দৃঢ়তা ফুটে উঠত তাতে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কলকাতায় কিউবা সংহতি সম্মেলনের সময় তাঁকে দেখেছি ডিটেইলাস-এ যাওয়া নেতা হিসেবে। ঐ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা যে হোটেলে থাকতেন তার ব্যবস্থা কি রকম সেটা তাঁকে নিজে গিয়ে খোঁজ নিতে দেখেছি।
তাঁর সাথে আমার ছিল শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্ক। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সময় তো বটেই, পরেও যখনই কলকাতায় গেছি তার সাথে দেখা না করে আসি নি। তিনি আমাকে রাশেদ না বলে রশীদ বলে সম্বোধন করতেন। আমি তাঁকে কখনই ভুল ধরিয়ে দিই নি। তাঁর সাথে গড়ে ওঠা এ সম্পর্ক আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তাই আমাদের পার্টি- বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা কমরেড অমল সেনের মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে তাঁর মহাপ্রয়াণের খবর যখন পেলাম তখন সেই অনুষ্ঠান শুরু করেই ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত হওয়ার ব্যবস্থা করতে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গিয়েছিলেন সেই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে। তার সাথী হয়ে কমরেড জ্যোতি বসুকে শেষ দেখার সুযোগ আমার ঘটে। সেটা আমার জীবনের পরম শান্তি।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার সুযোগ ঘটেছে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে কাজ করার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যও পেয়েছি। এগুলো আমার জীবনের পরম সম্পদ। ছাত্র আন্দোলনের নেতা হিসেবে কমরেড চৌ-এন-লাইয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছে। কমরেড ফিদেল ক্যাস্ত্রো ও কমরেড কিম ইল সুংয়ের সাথে মুখোমুখি আলাপ করার সুযোগ হয়েছে। তবে একজন কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে প্রকৃতই যিনি আমাকে মোহাবিষ্ট করেছেন তিনি কমরেড জ্যোতি বসু। কেবল আমার নয়, তিনি সকল বাঙালির মনেই চিরজীবী হয়ে থাকবেন। কমরেড জ্যোতি বসু লাল সালাম।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

সর্বশেষ