রবিবার,৯,নভেম্বর,২০২৫
28 C
Dhaka
রবিবার, নভেম্বর ৯, ২০২৫
প্রচ্ছদসীমানা পেরিয়েচীনে সমাজতন্ত্রের ৭৬ বছর

চীনে সমাজতন্ত্রের ৭৬ বছর

কেউ বলেন মাও থেকে শি জিন পিং : কেউ বলেন সমাজতন্ত্র থেকে বাজার সমাজতন্ত্র : কেউ বলেন দেঙ শিয়াও পিংয়ের বিড়ালের ইঁদুর ধরা : কেউ বলেন রাষ্ট্রীয় পুজিবাদ: চীন বলে চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্র তাদের স্বপ্ন : যুক্তরাষ্ট্র- পশ্চিমা বিশ্ব বলে: এক পার্টির কর্তৃত্ববাদ: চীনা জনগণ বলেন : আমরা সমৃদ্ধ হতে চাই!
চীনে যখন হাজার বছর আগে তার সভ্যতার জন্ম দিচ্ছিল তখন তার জ্ঞান বিজ্ঞান উন্নত হলেও জনগণ ছিল শোষণে জর্জরিত, বিদেশি আক্রমণে রক্তাক্ত  এবং দরিদ্র। আর এখন আজ চীন অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের দুই নম্বর দেশ। একটা ক্রমবর্ধমান সুপার পাওয়ার। বিশ্বের অন্য সব সুপার পাওয়ার পুজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশ। আর চীন শাসনতান্ত্রীকভাবে সমাজতান্ত্রিক দেশ।  এর আগে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন (১৯১৭-১৯৯১) নব্বইয়ের দশক থেকে প্রজাতান্ত্রিক রাশিয়া। রাশিয়ার পতনকে অনেকে সমাজতন্ত্রের পতন হিসেবে বলার চেষ্টা করেছে। চীন ও কিউবা সমাজতন্ত্রের পতাকা ধরে রাখার চেষ্টা করছে।  সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকলো না, চীন কিভাবে এগুচ্ছে।  মার্কসীয় অর্থনীতির অনেক প্রভাবশালী অধ্যাপকও চীনের সমাজতন্ত্রকে একটু নিচুস্তরের মনে করেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন জীবিত থাকার সময়েও এই ধরনের সমালোচনা ছিল।
যাইহোক,  চীনের তিয়েনমান স্কোয়ারে গত ১ লা অক্টোবর সমাজতন্ত্রের ছিয়াত্তর বছর উদযাপন উপলক্ষে লাল পতাকা উড়েছে।
১৯৪৯ সালের এই দিনে মাও সে তুঙের নেতৃত্বে  কমিউনিস্ট পার্টি চীনে একটা গনতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত করে। প্রথমে নয়া গণতান্ত্রিক রাজনীতি ছিল এখন চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সমাজতন্ত্রের নির্মাণ চলছে। তবে পথ সরল ও মসৃন ছিল না।  প্রথম বিরোধ পঞ্চাশের দশকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে।  তারপর গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড,  সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও দূর্ভিক্ষ। মাও ও চার নেতার আর্বিভাব। মাওয়ের মৃত্যুর পর দেঙ শিয়াও পিংয়ের উত্থান।  তিনি বলেন,  বিড়াল কালো কিংবা ধলা বড় প্রশ্ন নয়, আসল কথা হলো বিড়াল ইঁদুর ধরতে পারে কীনা।  সমাজতন্ত্র যদি মানুষকে খাওয়াতে পড়াতে না পারে তাহলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য।  চীনের এই নতুন জনকের হাত ধরেই সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতির পথ চলা শুরু।  এর প্রথম পদক্ষেপ ছিল,  কৃষকের হাতে কিছু জমি ফিরিয়ে দেওয়া।  কৃসক তার উৎপাদিত ফসল ভোগ করবে এবং বাড়তিটা বাজারে বিক্রি করতে পারবে। অন্যটি হলো, কোনো কোনো অর্থনৈতিক অঞ্চল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়া।  তারপর আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য পদ গ্রহণ।  চীনের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় পুঁজির পাশাপাশি ব্যক্তি পুঁজির প্রবাহ ও সঞ্চয় বাড়তে থাকে।  সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও অর্থনীতিতে অংশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি হলো। শি জিন পিং এর আমলে সেই দেশ এখন বিশ্বের দুই নম্বর অর্থনৈতিক দেশ। পরিবর্তনটা বৃহদাকার,  টেকসই ও ক্রমবর্ধনশীল।
 চাঁদের আলো পৃথিবীতে মোলায়েম হলেও চন্দ্রপৃষ্ট কিন্তু  পাথরময়,  কর্কশ।
সমাজতন্ত্রের এই বৈশিষ্ট্য নিজ দেশে প্রবৃদ্ধি সমৃদ্ধি আনার পর বৈশ্বিক পরিমন্ডলে তার পুঁজির প্রবাহ নানা প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে। এশিয়া ও আফ্রিকায় চীনের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নানা সংঘাত তৈরি করছে।  বিশেষ করে আফ্রিকায় তার বিনিয়োগ একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এনে দিচ্ছে যা আফ্রিকা পছন্দ করছে আবার শঙ্কিতও হচ্ছে।  এশিয়া আফ্রিকা ও ইউরোপ পর্যন্ত তার বেল্ট এন্ড রোড প্রকল্প একটা রাজনৈতিক বিনিয়োগ হিসেবেও অনেকে দেখছেন। দেখা যায়,  চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজির সাথে পশ্চিমা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ও রাষ্ট্রের সাথে তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে যা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান,  উইঘুর,  তিব্বত ও মানবাধিকার প্রশ্নে চীনের সাথে একটা যুদ্ধাবস্থা তৈরি করছে। এখনতো শুল্কযুদ্ধ চলছেই।
চীনের চোখ এখন ২০৪৯ সালের শক্তিশালী সমাজতন্ত্র নির্মানের দিকে,  যুক্তরাষ্ট্রের চোখ চীনকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়া। চীনকে মোকাবিলা করতে হবে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব,  জাপান ও ভারতকে। চীনের যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে সাউথ চায়না সাগরে,  তাইওয়ানের জলসীমায়, ফিলিপাইনের দ্বীপপুঞ্জে এমনকি কোরিয়া সীমান্ত হয়ে আফগান সীমান্তে আফ্রিকার বন্দরে বন্দরে।
চীন বৈশ্বিক ভাবে ডলারের বিপরীতে অন্য মুদ্রার পৃথিবী গড়ে তোলার নানা প্রতিষ্ঠান ও জোট তৈরি করে বিশ্বমিত্র বাড়াচ্ছে। চীনের স্বপ্ন : তারা এমন একটা পৃথিবী তৈরি করবে যেখানে পৃথিবী ভালো থাকলে চীন ভালো থাকবে আর চীন ভালো থাকলে পৃথিবী ভালো থাকবে।
চীন বাংলাদেশের জন্য একটা অর্থনৈতিক আশীর্বাদ।  বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীন একটা ভালো সহযোগী। বাংলাদেশ চীনের সাফল্যের ফল ভোগ করতে পারে।  তবে এক্ষেত্রে বড় বাধা হবে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দোপ্যাসিফিক ও বার্মা প্যাক্ট,  কোয়াড বা টিকফা চুক্তি বা শুল্ক চুক্তির নন ডিসক্লোজার শর্তসমূহ।
অর্থনীতিবিদ সামির আমিন বলেছেন,  পৃথিবীর ভবিষ্যত অর্থনেতিক বিশ্ব চীনের হাতে যেখানে চীন ডলারের বিপরীতে একটা বিকল্প বিশ্ব তৈরি করছে।  উন্নয়নশীল দেশগুলো সেখানে নিজেদের উন্নয়নের খোরাক ও স্পেস পাবে এবং হয়তো ডলারের নিষ্ঠুর শোষণের বিরুদ্ধে,  আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটা অর্থনৈতিক বিশ্বও গড়ে উঠবে।  চীনের স্বপ্ন পূরণ হোক: বাংলাদেশ তার ডিভিডেন্ড পাক।
বিশ্লেষক- শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক

সর্বশেষ