চৈত্রমাসে হঠাৎ তিস্তানদীতে এতো জল! রসায়ন’টা কী?

৬ এপ্রিল ২০২১, তিস্তার দুইতীরের তিস্তা আন্দোলনের নেতা,কর্মীরা আমাকে ফোন করে বলছিলেন,’ স্যার চৈত্রমাসে তিস্তায় জল বাড়ছে।’ বললাম, কী কারণে এই জলের প্রবৃদ্ধি! (?)।অনেকেই বললেন,তিস্তা আন্দোলনের এটা নাকি এক ধাপ অগ্রগতি।আমি এই রসায়ন’টা খুজলাম।খুজে যা দেখলাম- এটা পশ্চিমবঙ্গ বাজ্য নির্বাচনের ভোটের জল! ভারতের গজলডোবা বাঁধ বন্ধ রাখা হয় ডিসেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত। ছয়মাস। এই ছয়মাসে আমাদের অংশের তিস্তায় কোন পানি প্রবাহ থাকেনা। এ খরাকালে বালুরঢিপি বুকে নিয়ে তিস্তা মরাকাঠ হয়ে ঘুমিয়ে থাকে।বর্ষাকালে ওপেন থাকে গজলডোবা ব্যারাজ।তিস্তাপারের মানুষ বলেন, “খরাকালে যখন পানির দরকার তখন হামরা পানি পাইনা।বর্ষাকালে পানির দরকার হয়না তখন ওমরা সব পানি ছাড়ি দেয়।হামরা ভাসি যাই”।বর্ষা নেমে গেলে এক/দেড়মাস পর পানিতে টান পড়ে।তিস্তা বারোমাসি নয়,তিনমাসি নদীর রূপ নেয়।চৈত্রে হঠাৎ তিস্তায় পানি- এই শীরনামে ৬ এপ্রিল দৈনিক ইত্তেফাক সচিত্র প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে।চৈত্রে তিস্তার যৌবনে আমাদের তিস্তাপারের জেলে,মাঝি,কৃষক সবাই মহাখুশি এসব বর্ণনা ইত্তেফাকের ওই রিপোর্ট -এ এসেছে।তিস্তা আন্দোলনের নেতা আমাদের সতীর্থ নদী – প্রকৃতি ও পাখি প্রেমিক ড.তুহিন ওয়াদুদ তো মহাখুশি।তিনি হঠাৎ যৌবনা তিস্তার রূপকে ক্যামেরাবন্দী করতে ছুটে গিয়েছিলেন তিস্তা নদীতে। চৈত্রে শোভিত তিস্তার এছবি তাঁরই হাতে তোলা।বিশ্লেষণ জরুরি, বালুময় তিস্তার রূপ পাল্টে গেল কেমনে।এরই মধ্যে কাউনিয়া তিস্তা পয়েন্টের নেতা সামছুল ভাই টেলিফোন করে জানালেন,তিস্তায় পানি যা বেড়েছিল তা আবার শুকিয়ে যাচ্ছে।এ যেন এক আলোআঁধারি খেলা।এ খেলার রসায়ন’টা কী!(?)। ইতেমধ্যে শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যসভা নির্বাচন।এই নির্বাচনকে ঘিরে তিস্তা ইস্যুটাও সামনে এসেছে।মমতা বন্দ্যেপাধ্যায় নির্বাচনী জনসভায় চিৎকার করে বলেছেন,’ তিস্তা উত্তর বাংলা-কা হক।পশ্চিমবঙ্গের উত্তোরাঞ্চলের সেচের জন্য তার জল দরকার’।তিনি তিস্তার জল বাংলাদেশকে দিতে পারবেননা। তিনি আমাদের বিকল্প পথ খোজার কথা বলেছেন।এক্ষেত্রেবিজিপির সরকার শুধুশুধু প্রদেশের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কেন্দ্রীয় কর্তব্যকে এড়িয়ে চলছেন।বারেবারে ভোট আসে ভোট যায়।কিন্তু তিস্তা সমস্যা বালুচরেই আটকে থাকে।এবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে তিস্তা ইস্যুতে, তিস্তার জলপ্রাপ্তির দাবিতে গজলডোবার ভাটির মেখলিগঞ্জ,জলপাইগুড়ি ও হলদিবাড়ি জেলার ২০ লাখ মানুষ সোচ্ছার হয়েছেন।মানুষের এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেখানকার পরিবেশবাদী এবং নদী আন্দোলনের সংগঠনগুলো।তারা বলছেন,তিস্তা নদীতে ব্যারাজ দেওয়া হয়েছে গজলডোবায়।গজলডোবা থেকে ভাটিতে ৭২ কিলোমিটার পথবেঁয়ে বুড়িগ্রাম হয়ে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায় তিস্তা বাংলাদেশে ঢুকেছে।গজলডোবায় ব্যারাজের ভাটির অংশের ৭২ কিলোমিটারের অবস্হা আর বাংলাদেশের অবস্হা একই এবং ভয়াবহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।তিস্তা বাঁচাও,নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার নদী আন্দোলনের এক নেতা আমাদের জানিয়েছেন, “গজলডোবা ব্যারাজ থেকে ডাইভারশন ক্যানেল দিয়ে সব জল সেচের কাজে তুলে নেওয়ায় ভাটিতে আমাদের অংশের ২০ লাখ মানুষের জীবন জীবীকা নষ্ট হয়েছে।” বাস্তুতন্ত্রের নিয়মে নদীর জীবনই তার প্রবাহমনতা।প্রবাহমান নদীর জল সেচ ও বিদ্যুতে্র জন্য তুলে নেওয়ার কারণে ভাটির( বাংলাদেশ-ভারত)তিস্তা শুকিয়ে গেছে।তারা আরো বলেন,’ এপারের তিস্তার গতি অব্যাহত রাখতেই খরাকালে বাংলাদেশকে জল দেওয়া ছাড়া তিস্তার প্রবাহমানতা,তার জীবন রক্ষা করা যাবে না।’একই মতামত দিয়েছিলেন ভারতের পানি বিশেজ্ঞ কল্যান রুদ্র।২০১৩ সালে মমতা ব্যানার্জিকে কল্যান রুদ্র কমিশন জানিয়েছিলেন এসব কথা( আনন্দবাজার পত্রিকা ২৮ ফেব্রুয়ারি,২০১৩,)।১০- ১৭ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যবিধান সভার চতুর্থ দফার নির্বাচন।মেখলিগঞ্জ,মাথাভাঙ্গা, কোচবিহার,হলদিবাড়ি,জলপাইগুড়িসহ অনেক এলাকার অবস্হান গজলডোবার ভাটিতে।ভোটার,আসনসংখ্যা, জনসংখ্যা ওইসব অঞ্চলে অনেক।গজলডোবার ভাটির লাখো মানুষের আকুতি- ” তিস্তার জল আমাদেরও দাও। ভোট নাও”।চতুর্থ দফার ভোটের রসায়নের কারণে পশ্চিমবঙ্গ সরকার গজলডোবার ভাটিতে তাদের অংশের তিস্তায় জল দিতে সদয় হয়েছেন।একারণে আমাদের অংশের তিস্তায় চৈত্রমাসে পানি ঢুকেছে।আমি নিশ্চিত ২/ ৪ দিন পরেই আমাদের অংশের তিস্তার পানিতে টান পড়বে।বর্ষাকাল অবধি এ টান ছাড়বে না।আমরা তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ থেকে২০১৫ সাল থেকে তিস্তা নদী সুরক্ষার দাবিতে সাংগঠনিকভাবে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছি।বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর প্রায় ১১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত।১ নভেম্বর ২০২০, তিস্তা নদীর দু’তীরে ২৩০ কিলোমিটার মনববন্ধন করেছি।সরকারের ” তিস্তা নদী সার্বিক ব্যবস্হাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প( মহাপরিকল্পনা) দ্রুত বাস্তবায়ন,তিস্তা চুক্তি সইসহ ছয় দফা দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচিতে তিস্তাপারে লাখোলাখো মানুষ শামিল হয়েছিলেন।ঘটেছে অভূতপূর্ব জাগরণ।ভারতের প্রধানমন্রী নরেন্দ্রমোদির বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে ২৪ মার্চ ২০২১ একই দাবিতে আমরা তিস্তাতীরের সকল হাট-বাজার- বন্দরে ১০ মিনিট স্তব্ধ এবং প্রধানমন্ত্রী বরাবরে একলাখ গণস্বাক্ষর প্রদান কর্মসূচি সফল করেছি।ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগদিতে দু’দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন।তাঁর সফর ঘিরে দু’দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে দৃঢ় করার স্বার্থে এবং দু’দেশের জনগনের রক্তের মেলবন্ধনকে মজবুত করার আশা নিয়ে আমরা এই সফরেই তিস্তা পানিচুক্তি সম্পন্ন করার দাবি তুলেছিলাম।দাবি তুলেছিলাম নরেন্দ্রমোদির আগমনকে স্বাগত জানিয়ে, শান্তিপূর্ণভাবেই।কিন্তু আমাদের দু:খ তিস্তা সুরক্ষা এবং তিস্তা চুক্তির দাবিতে কোন রাজনৈতিক দলকে এ বিষয়ে সোচ্চার হতে দেখলাম না।যা দেখলাম তা দুইদেশের সংখ্যালগু সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অশুভ খেলা।দেখলাম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,অর্জন এবং অগ্রগতিকে ধ্বংস করার বর্বরোচিত মহড়া।তিস্তা আমাদের উত্তরের জীবন রেখা।প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এ নদীর ওপর দেশের দুই কোটি মানুষ নির্ভরশীল।এই মানুষ মুসলিম- হিন্দু- বৌদ্ধ- খৃষ্টান সব ধর্মের সব বর্ণের।জাতি ধর্ম,বর্ণ, নারি-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই।তিস্তা নদীটি বাংলাদেশ- ভারত অভিন্ন নদী। তিস্তার উজানে ড্যাম,ব্যারাজ,বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সেচখাল নির্মাণের কারণে তিস্তার প্রবাহমানতা থেমে যাচ্ছে।নদীটির জীবন হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। তিস্তা এখন মরানদী।দুই দেশের পরিবেশ ও নদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠক’রা এবং দু’ই দেশের নদী বিশেষজ্ঞ’রা তিস্তার মরণদশায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।তাঁদের অভিমত তিস্তার প্রবাহমানতা ঠিক রেখে দুই দেশকেই নিজনিজ জায়গায় তিস্তা পরিচর্যার ওপরমনোযোগ দেওয়া জরুরি।উজানে বাঁধ দিয়ে তিস্তার ভাটিতে পানির প্রবাহ বন্ধ করলে ভারতের অংশের তিস্তাও বাঁচবেনা- একথা স্পষ্টত বলেছেন ভারতের পানি বিশেষজ্ঞ কল্যান রুদ্র।এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত খরাকালে অন্তর্বর্তীকালীন তিস্তা চুক্তি সই করার পাশাপাশি তিস্তায় পানি প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য ” যৌথ নদী ব্যবস্হাপনা” গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।আমাদের তিস্তাপারের মানুষের জীবন-জীবীকা রক্ষায়দেশীয় ব্যবস্হাপনা এখন সবচেয়ে জরুরি।দেশীয় ব্যবস্হাপনার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার ” তিস্তা নদী সার্বিক ব্যবস্হাপনা ও পুনরুদ্ধার” শীর্ষক মহাপরিকল্পনা গ্রহন করেছেন।এই মহাপরিকল্পনার কাজটি দ্রুত বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।রংপুর অঞ্চলের বৈষম্য ও দারিদ্র্য নিরসনে ” তিস্তা মহাপরিকল্পনা” ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।দেশীয় ব্যবস্হাপনায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি তিস্তা চুক্তি সই করাও জরুরি।

লেখক: নজরুল ইসলাম হক্কানী,সভাপতি,তিস্তা বাঁচাও,নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ।