বৃহস্পতিবার,২৫,এপ্রিল,২০২৪
38 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতডেটলাইন ছয়’ই জানুয়ারি মার্কিন গণতন্ত্রের এসিডটেস্ট

ডেটলাইন ছয়’ই জানুয়ারি মার্কিন গণতন্ত্রের এসিডটেস্ট

।। ড. শ্যামল দাস ।।

নতুন বছরের ছয়’ই জানুয়ারি গণতান্ত্রিক আমেরিকার ইতিহাসে দুই বিপরীতমুখী সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার এবং দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়ে থাকবে। এদিনটি এদেশের ইতিহাসে একটি কালো দিন বলেই পরিগণিত হবে বলে আমার বিশ্বাস; আবার এই একই দিনকে হয়ত স্মরণ করা হবে গণতন্ত্র রক্ষার একটি স্বর্নালী উদাহরণ হিসেবে। আড়াইশো বছরের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় এমন দিন আমেরিকার জনগন কখনো দেখেনি। যে দেশের এক প্রেসিডেন্টের দেয়া গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আজো সবচেয়ে নন্দিত, ব্যবহৃত, এবং গৃহীত হয় সে দেশটিতে এমন ঘটনা ভাবা যায়না। গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার এমন ঘটনা যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই আধুনিক সময়ে সম্ভব তা এদেশ কেন পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষেরাও ভাবতে পারেনি বা পারেনা। তারপরও এটি ঘটেছে। ক্ষমতালিপ্সা মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা, কিন্তু একে সহনীয় করে সাধারন মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার এবং তাদের মধ্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের মাধ্যমে একে সিদ্ধ করার একটা সিস্টেম হচ্ছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। ছয়’ই জানুয়ারী এবং এর পরবর্তী অনেক ঘটনা মোটামুটিভাবে প্রমান করে যে, কিছু মানুষের ক্ষমতালিপ্সা আধুনিক গণতান্ত্রিক সভ্যতার সকল মানদ-কে অতিক্রম করে যেতে পারে, কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দেশে শেষাবধি গণতন্ত্রের যে সৌন্দর্য তা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সকল কুৎসিত উপাদানের প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করে দেয়। এইটিই আমরা দেখলাম গত ক’দিনের আমেরিকার রাজনৈতিক পরিম-লে।
আমার নিজের ধারনা, ইতিহাসের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন দেশ বা জাতিকে ঐতিহাসিক হিরোদের পাশাপাশি তাৎপর্যপূর্ণ ভিলেনদেরও মোকাবেলা করতে হয় বিশেষ সামাজিক বা রাজনৈতিক এপিসোডের প্রেক্ষাপটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন সেরকম একটি সময়কাল বা সোশ্যাল এপিসোড পার করছে। দেশটির ইতিহাসে ডোলাল্ড ট্র্যাম্প নামের এমন ঐতিহাসিক ভিলেন আর দেখা যায়নি যে ভিলেন গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোন নিয়ম কানুন, মানুষের সেন্টিমেন্ট, আমেরিকান সংস্কৃতির আইডিয়াল উপাদান কোন কিছুরই পরোয়া করেননা শুধু নিজের ক্ষমতালিপ্সাকে চরিতার্থ করার জন্য। এমন ঘটনাই মার্কিনীদের যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা সেটিকে এক চরম নৈতিকতার সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো। সিএনএন বলেছে, এ ঘটনাটি আমাদের পাকিস্তান, তাইওয়ান এবং এ জাতীয় দেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে সমালোচনা করার নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। ডোনাল্ড যেন রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সেই শিশু অভিনেতা যে নাটকে তার মৃত্যুদৃশ্যের অভিনয়ের সময় এ দৃশ্যে অংশ নিতে অস্বীকার করে। এ ধরনের অভিনেতা নাটকের জন্য সবসময়ই হুমকিস্বরূপ, এবং নাটকের সফল মঞ্চায়নের জন্য তাকে বহিষ্কার করাটাই নিয়ম।
ট্র্যাম্প ছয়’ই জানুয়ারিকে বেছে নিলেন কেন? কী ছিলো এদিন আমেরিকায়? নিয়ম অনুযায়ী আজই কথা ছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩রা নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সার্টিফাই করার। এটি সিনেটের মাধ্যমে করা হয়। এই সিনেটে আবার রিপাবলিকানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ট্র্যাম্প শুরু থেকেই ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়াটিকে দেরী করিয়ে দিতে চাইছিলেন। তিনি বারবারই বলে আসছিলেন, এ যাত্রায় ক্ষমতা হস্তান্তর হবেনা, কারন নির্বাচনটি তাঁর এবং আমেরিকানদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে। তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রাতিষ্ঠানিক রুটিন কর্মকাণ্ডটি করা হয় সেটিকে বিলম্বিত করে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন কোর্টে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। সর্বশেষ তিনি জর্জিয়ার সেক্রেটারী অব স্টেটকে ম্যানিপুলেট করতে চেয়েছেন; সেটিও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ধরে নেয়া যায় যে, ৫ই জানুয়ারী জর্জিয়ার দুই সিনেট নির্বাচনে বিশ বছর পর ডেমোক্র্যাটদের জয়ের পেছনে এই ব্যপারটি ভোটারদের কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছে। সহজভাবে বলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক দেশের সচেতন ভোটাররা যারা সংখ্যায় কম হলেও নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারে তারা এতটা নির্লজ্জ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাকে মেনে নেয়নি, এবং আমার ধারনা এই ভোটাররা ঐতিহ্যগতভাবে রিপাবলিকান অঞ্চলকে ডেমোক্র্যাটদের হাতে তুলে দেয়ার কাজকে সহজ করেছে। এতে রিপাবলিকানরা সিনেটে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে, এবং এটি ঘটেছে একজন মানুষের অবিমৃশ্যকারিতা এবং ক্ষমতালিপ্সার জন্য।
যদিও ট্র্যাম্প নির্বাচন নিয়ে অসত্য বক্তব্যটি দিয়ে যাচ্ছিলেন নভেম্বরের তিন তারিখ থেকেই, এর চরম প্রকাশটি ঘটেছে ছয়’ই জানুয়ারি। ট্র্যাম্প ভেবেছিলেন, সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রিপাবিলকানদের দিয়ে তিনি নির্বাচনের সার্টিফিকেশান প্রক্রিয়াটি বিলম্বিত করবেন, বা সম্ভব হলে এটিকে বাতিল করাবেন। যতদূর জানা যায় সিনেটের সভাপতি দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে তিনি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী দিয়েছিলেন, কিন্তু পেন্স খুব সম্ভবত এ বিষয়ে তাঁর অবস্থানটি ট্র্যাম্পের কাছে পরিষ্কার করেননি, এবং ট্র্যাম্প সন্দিহান হয়ে ওঠেন। এ কারনেই তিনি রায়টারদের উৎসাহিত করেছিলেন যেন তাদের কর্মকা- সিনেটকে সার্টিফিকেশানের কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য করে। তিনি রায়টারদের র্যালীতে সরাসরি বলেছেন, তোমরা পেন্সিলভ্যানিয়া এভিনিউতে নেমে এসো; আমাদের বিজয় যারা ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের প্রতিহত কর। অন্য অনেক রায়টারের মত জেনা নামে এক রায়টার বলেছেন, আমরা ট্র্যাম্পকে অনুসরণ করছি (“উই আর লিসনিং টু ট্র্যাম্প”)। এ যেন হিটলারের সেই মন্তব্যের মত যেখানে তিনি জার্মানদের শ্রেষ্ঠত্ত্ব প্রমানের ডাক দিয়েছিলেন। একটি চমৎকার বিষয় দেখা গেলো গত কয়েকদিন ধরে; অ্যামেরিকার অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বলেছেন, ট্র্যাম্প অনেকটাই ওসামা বিন লাদেনের প্রতিরূপ যিনি মুসলমানদের শ্রেষ্টত্ত্ব প্রমানে জীবন দিতে আহবান জানিয়েছিলেন তাঁদের। এ ব্যাপারটি নিয়ে ভবিষ্যতে আরো গবেষনা হবে, কিন্তু ট্র্যাম্পবাদ মার্কিন মননে একটি ক্ষত হিসেবেই বিবেচিত হবে ভবিষ্যতে। আরেকটি কথা; বিন লাদেন শক্তিশালী ছিলেন; তিনি তাঁর কমিউনিটি বা উম্মাহর জন্য কিছু করতে চেয়েছেন যেটি পথ হিসেবে অবশ্যই ঘৃন্য। কিন্তু ট্র্যাম্প? তাঁর যুদ্ধ কাদের জন্য এবং কাদের বিরুদ্ধে? তিনি শুধু দেশকে বিভক্ত করেননি; তাঁর নিজের দলও বিভক্ত হয়েছে প্রচন্ডভাবে; প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; আমেরিকান আইডিয়াল নামের প্রতিরূপটির ন্যাকারজনক চেহারা বেরিয়ে এসেছে যেন। এটি কি শুধুই নিও লিবারেল প্রনোদনা? আমার কাছে এটি একটি নতুন দিক উন্মোচিত করেছে রাজনীতি এবং সমাজবিজ্ঞানের গবেষনায়। ট্র্যাম্পের ফ্যাকশনাল রাজনীতি কতটা সফল হবে ভবিষ্যতে জানিনা; আপাতত এটি মার্কিনীদের বড় অংশটি প্রত্যাখ্যান করেছে এটাই বাস্তবতা। এরপরও আয়রনি হলো এই যে, অর্ধেকের বেশী রিপাবলিকান সিনেটর এবং প্রতিনিধিরা বলেছেন, তাঁরা আবারো ট্র্যাম্পকে নমিনেট করবেন সুযোগ থাকলে। এটি কি রিপাবলিকান দলে নের্তৃত্ত্বের শুন্যতার ফল নাকি অর্থের ঝনঝনানির বিজয়ডঙ্কা? ঘটনাটি ভবিষ্যতে ঘটবে কিনা জানিনা, তবে ট্রাম্পবাদ যে আমেরিকার রাজনীতিতে একটি জায়গা করে নিতে পেরেছে এ মনোভাব তারই নিদর্শন। এটাই ড্যামেজ দেশটির জন্য।
আসলে মার্কিন রঙ্গমঞ্চের শিশুসুলভ অভিনেতা চেয়েছিলেন একটি ক্যু করে তাঁর মৃত্যুদৃশ্যকে জীবিত হয়ে ওঠার দৃশ্যে রূপান্তরিত করতে; হননি তিনি সফল, যদিও এর প্রভাব এবং প্রতিফলন রেখে গেছেন দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে। ট্র্যাম্পের শিশুসুলভ চেষ্টাটিকে আমি ক্যু বলে মনে করি। কেন করি তার প্রক্রিয়াগত ছোটখাট কিছু ব্যখ্যা দেয়া যায়। ট্র্যাম্প নির্বাচনের সময় থেকেই বলে আসছিলেন নির্বাচনের ফলাফল অন্যরকম হতেই পারেনা, এবং এটি ঘটলে তিনি মানবেন না। এ বিষয়টিকে আসলে তাঁর প্রতিপক্ষ বা আমেরিকার বেশীরভাগ সাধারন মানুষ খুব একটা পাত্তা দেয়নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পঁচা শামুকে পা কেটেছে আমেরিকানদের। পরবর্তীতে ওয়াশিংটন ডিসিতে যে রায়টটি ঘটে গেছে তার মূল এবং প্রধান ইন্ধন এসেছে ট্র্যাম্পের নির্বাচন নিয়ে অসত্য এবং অসংলগ্ন বক্তব্য থেকে। উচ্ছৃঙ্খল জনতার মন (মব সাইকোলজি) বা আচরনের বিভিন্ন পর্যায়কে ব্যখ্যা করার যে তত্ত্ব তা থেকে বোঝা যায় ছয়’ই জানুয়ারীর ঘটনাটিকে ক্ষমতার শীর্ষ থেকে ফ্রেম করা হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়ত এ নিয়ে সিরিয়াস গবেষনা হবে। তবে যা গড় আমেরিকানদের কাছে পরিষ্কার নয় তাহলো এত বড় একটি ঘটনা ঘটে গেলো অথচ তা জানতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ইন্টিলিজেন্স বা হোমল্যান্ড সিকিওরিটির বেশ কয়েকটি সংস্থা সবাই এক সঙ্গে ব্যর্থ হল কিভাবে? এখন পর্যন্ত একজন মহিলা এবং দু’জন পুলিশসহ ছয়জন গুলিতে নিহত হয়েছেন; এখনো পরিষ্কার জানা যায়নি এঁদের কারা গুলি চালিয়েছিলো। এ গুলি কোত্থেকে এলো? আমি নিজেও অনেকটাই বিস্মিত। এটি কী করে হয়? এ ধরনের স্যাবোটাজ যদি ট্র্যাক করা না যায় তবে হোমল্যান্ড সিকিওরিটির অর্থ কী তা বোধগম্য নয় মোটেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রতো তৃতীয় বিশ্বের কোন ছদ্ম গণতন্ত্রের (“সিওডো ডেমোক্রাসি”) দেশ নয় যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনেক সময়ই সরকারের অশুভ নিয়ন্ত্রনে থাকে পুরোটাই; অথচ ডিসির ঘটনাটি অনেকটাই যেন ক্ষমতার থার্ড ওয়ার্ল্ড সিন্ড্রোমকে তুলে ধরেছে। মার্কিন মিডিয়া যেসব দেশকে এধরনের ঘটনার উর্বর ভূমি মনে করে সেই পাকিস্তানেও পার্লামেন্ট ভবন আক্রমনের ঘটনা ঘটেনি; কোন দেশেই এটি ঘটেনি। এ লজ্জা আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানতো বটেই, দেশের জন্যও একটি বিরাট ব্লো। কারন, এদেশটি পৃথিবীর অন্য সব দেশকে গণতন্ত্রের সবক দিয়ে থাকে নিয়ত।
এর আগে কেবলমাত্র ১৮১২ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে ব্রিটিশ সেনাদের দ্বারা সিনেট আক্রান্ত হয়েছিলো, আর এই ২০২১ সালের ছয়’ই জানুয়ারী একই ব্যপার ঘটলো স্বদেশীদের দ্বারা। রায়টারদের কাছে বর্ণবাদী কনফেডারেট ফ্ল্যাগ দেখা গেছে যথেচ্ছা; এই ফ্ল্যাগ ওড়ানো দেখে মনে হয়েছে এরা যেন ফিরে যেতে চায় সিভিল ওয়ারের বা নিদেনপক্ষে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের আগের সময়ে; কনফেডারেট ফ্ল্যাগ এদেশে রেডনেক বা বর্ণবাদী গোষ্ঠীর একটি সিম্বল বিশেষ আজকের আমেরিকায়। অনেক জায়গায় এই ফ্ল্যাগ ওড়ানোর ঘটনাটি বিচ্ছিন্নভাবে ঘটলেও ছয়’ই জানুয়ারি ক্যাপিটল বিল্ডিং এর সামনে আমেরিকান গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় আইডিয়ালকে নস্যাৎ করার যে সিম্বল সেই কনফেডারেট ফ্ল্যাগ প্রদর্শন এতটা নির্বিঘ্নে কিভাবে সম্ভব হল সেটাই আমার মত মানুষদের মাথায় আসছেনা। আমারতো মনে হয়না বাংলাদেশে কোন রাজনৈতিক মিছিলে পাকিস্তানের পতাকা প্রদর্শন করা সম্ভব, কিন্তু মার্কিন দেশে এটি দম্ভের সাথে দেখিয়েছে রায়টররা। এটি কি শুধুই উদারতাবাদ? তাহলে কি ট্র্যাম্পের সমর্থনে ছয়’ই জানুয়ারীর রায়ট আসলে সিভিল ওয়ার পূর্ববর্তী সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে শুধু? এটি কি সিভিলওয়ার-পূর্ববর্তী ন্যারেটিভের ফিরে আসা? আমার কাছে অন্তত এটিকে সে সময়ের একধরনের সিম্বলিক প্রতিনিধিত্ব (“সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেশান”) মনে হয়েছে। ট্র্যাম্প এবং তাঁর প্রশাসন সিভিল রাইটস আন্দোলনের ইতিহাস স্কুলে যেভাবে পড়ানো হয় তার সমালোচনা করেছেন; তাঁরা এদেশে মার্টিন লুথার কিং দিবসকে “স্বদেশপ্রেম দিবস” বা প্যাট্রিয়টিক ডে” হিসেবে দেখানোর কথা বলেছেন। মোটা দাগে এটিও ট্র্যাম্পের একটি বর্নবাদী আদর্শকে প্রতিফলিত করে। কাজেই আজ আমরা যে ট্র্যাম্পবাদের কথা বলি এটি তারই একটি অনুষঙ্গ মাত্র।
ছয়’ই জানুয়ারী এবং তদপরর্তী ঘটনাবলীতে একটি আয়রনী দেখা গেলো মার্কিন ইতিহাসে । ১৯৪১ সালের ছয়’ই জানুয়ারী প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট বলেছিলেন, আমেরিকার জনগণ চারটি মৌলিক অধিকার সবসময়ই ভোগ করবে। এ চারটি অধিকারের মধ্যে প্রথমটিই হচ্ছে কথা বলার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, এবং শেষটি হচ্ছে ভীতি থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতা। প্রথমটিরই অন্যতম বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে, এবং এই যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সেটি ভয় থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতাকেও নিশ্চিত করে অনেকটাই। অথচ আশী বছর পর ২০২১ সালের ছয়’ই জানুয়ারী এ দুটি অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার একটি প্রবল চেষ্টা হয়েছে এক মহাভিলেনের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লিপ্সা থেকে; এ লিপ্সা এ জাতির সমস্ত অর্জনকে অস্বীকার করেছে চরম ঔদ্ধত্ত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে। ছটি তাজা প্রান ঝরে গেছে এ রায়টে। এখন পর্যন্ত আশিটির বেশী চার্জ গঠিত হয়েছে এবং তিনশ’র বেশী রায়টারকে গ্রেফতার করা হয়েছে যদিও এখনো পর্দার অন্তরালের কুশীলবদের বিরুদ্ধে সরাসরি চার্জ দেয়া হয়নি বলে আমার ধারনা।
তাহলে ছয়’ই জানুয়ারি কি আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য শুধুই কালো দিন? না, অবশ্যই নয়। এই দিনটি দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদেশের গণতন্ত্রের সৌন্দর্যটিও তুলে ধরেছে যা থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। আমেরিকার মিডিয়াতো বটেই, কংগ্রেসের উভয় কক্ষের প্রতিনিধি এবং সিনেটাররা এই ঘটনার বিরুদ্ধে যে অবস্থানটি নিয়েছেন সেটি আসলেই দেখার মত। আমি এখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতাদের বক্তব্য দিচ্ছিনা, কারন তাঁদের অবস্থানটি অনুমেয়। আমার সবচেয়ে বেশী দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের একটি ছোট্ট মন্তব্য যা তিনি সিনেট প্রেসিডেন্ট হিসেবে দিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে পেন্স ট্র্যাম্পের প্রতিবিম্ব মাত্র; অন্য কথায়, ট্র্যাম্পের কথার বাইরে যাওয়া তাঁর রীতি এবং স্বভাববিরুদ্ধ। সেই পেন্স সিনেটের স্থগিত হওয়া সেসান শুরুর আহবান জানিয়ে সিনেটরদের উদ্দেশ্যে বললেন, “ভায়লেন্স কখনোই বিজয়ী হতে পারেনা; স্বাধীনতাই কেবল জয়ী হয়; আসুন আমরা আমাদের কাজ (“২০২০ সালের নির্বাচন সার্টিফিকেশান”) শেষ করি।“ সিএনএন কর্তৃক প্রকাশিত জিওপি’র এক বিবৃতিতে দেখা যায়, তাঁরা সরাসরিই বলেছেন, “ট্র্যাম্প আসলে উন্মাদের মত আচরন করছেন (“হি ইজ আউট অফ হিজ মাইন্ড”)।
সিনেটে মেজরিটি নেতা ম্যাককোনেল যিনি একজন প্রথিতযশা রিপাবলিকান এবং ট্র্যাম্পের নির্বাচন সম্পর্কিত অনেক বক্তব্যের সমর্থক তিনিও আজ খুব শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। সিনেটে তাঁর বক্তব্যে ম্যাককোনেল জানিয়েছেন, তাঁরা ইতিহাসে ভিলেন হিসেবে পরিগণিত হতে চান না, এবং আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে তাঁরা ধ্বংস হতে দিতে পারেন না। একটু বড় হলেও তাঁর মন্তব্যের চুম্বক অংশটুকু এখানে না দেয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা। ম্যাককোনেল পরিষ্কার করে বলেছেন, “সিভিল ওয়ারের সময় তারা আমাদের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চেয়েছিলো, কিন্তু পারেনি, এবং আমরা আমাদের কাজ করে গেছি; তারা ব্যর্থ হয়েছিলোৃআমরা অবশ্যই ২০২০ সালের নির্বাচনকে সার্টিফাই করবো; অপরাধমূলক কার্যকলাপ কখনোই গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করতে পারেনা; আমাদের এর বিচার করতে হবে; কোন অনুকম্পা নয়; এরা টগ, লুণ্ঠনকারী এবং সম্পত্তিবিনষ্টকারী” (অনুবাদটি আমার নিজের)। সাবেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ বলেছেন, এ ধরনের বিদ্রোহ আমাদের প্রতিষ্ঠানের চরম ক্ষতি (“গ্রেভ ড্যামেজ”) করে দেবে; একে প্রতিরোধ করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্বাসে আমেরিকার জনগন সবসময়ই দুইভাগে বিভক্ত, এবং দেশটি অনেক রকমভাবে স্তরায়িত, কিন্তু একটি সমাজের টিকে থাকার জন্য এর প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে যে একতা বা সলিডারিটি দরকার হয় সেটি প্রকাশিত হয়েছে আজকের আমেরিকার বিভিন্ন পর্যায়ে। সিএনএন বা এমএসএনবিসিসহ উদারনৈতিক মিডিয়াতো বটেই ফক্সের মত কট্টর রিপাবলিকান সমর্থক চ্যানেলও নির্দ্বিধায় দাঁড়িয়ে গেছে এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধ্বে। তারা পরিষ্কার বলেছে, নির্বাচন নিয়ে ট্র্যাম্পের দাবীর যদি বিন্দুমাত্র সত্যতাও থাকে তবে তা নির্ধারিত হওয়ার উপায় এটি নয় কিছুতেই। আরো কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়টি হল এই যে, ফেসবুক, টুইটার, এবং ইউটিউব ট্র্যাম্পের একাউন্ট সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে। এটিও আমেরিকান গণতন্ত্রের একটি প্রণিধানযোগ্য দিক। অন্যদিকে শুধু জিওপি নয়, রিপাবিলকান সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকান ম্যানুফ্যাকচারার এসোসিয়েশানের নেতারা মাইক পেন্সকে আহবান জানিয়েছিলেন ট্র্যাম্পকে সংবিধানের ২৫ এমেন্ডমেন্ট ব্যবহার করে ক্ষ্মতাচ্যুত করতে। এ ধরনের আহবানও আমেরিকার ইতিহাসে আর ঘটেছে কিনা জানিনা।
সর্বশেষ যা ঘটেছে তা হল ট্র্যাম্প মার্কিন ইতিহাসের একমাত্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বারের মত অভিশংসিত হন নিম্নকক্ষে, এবং এটি সিনেটে উঠেছে, কিন্তু এখন নতুন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় এ বিষয়টি আপাতত স্থগিত আছে। ট্র্যাম্পের অভিশংসন যদি সিনেটের অনুমোদন পায় তবে তিনি আর দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না। শোনা যাচ্ছে সিনেটে ১৭ জন রিপাবলিকান ডেমোক্র্যাটদের সাথে যোগ দেবেন ট্র্যাম্পকে অভিযুক্ত করার ক্ষেত্রে। সাংবাদিক জিমি কস্টার ভাষায়, “তিনিই একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি নিজেকে এবং তাঁর প্রশাসনকে ক্রমাগত এমনকি শেষ সময়েও অপমান করে গেছেন”।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, ছয়’ই জানুয়ারী ২০২১ এর ঘটনাটি ছিলো আমেরিকার গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় পরীক্ষার দিন। মোটামুটিভাবে বলা যায় একটি সাংস্কৃতিক আইডিয়াল হিসেবে গণতন্ত্র কতটা শক্ত এদেশে সেটিরও একটি পরীক্ষা হয়ে গেলো। দেশটির সামাজিক কাঠামোর মাঝে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের যে অবস্থান তার সাথে দেশটির অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের একটি সুদৃঢ় মিথস্ক্রিয়াই প্রমাণ করে আমেরিকান গণতন্ত্রের ভীত কতটা শক্ত। এইটি মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যও বটে, তবে আগামীতে ট্র্যাম্পবাদ বা এ ধরনের নীতির সমর্থক আদর্শের গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করবে দেশটির গণতন্ত্রের ভবিষ্যত। ছয়’ই জানুয়ারি এ কারনেই মার্কিনীদের জন্য একটি এসিডটেস্টও ছিলো।
লেখক : প্রফেসর, হোমল্যান্ড সিকিওরিটি এবং সমাজবিজ্ঞান, এলিজাবেথ সিটি স্টেট ইউনিভার্সিটি, নর্থ ক্যারোলাইনা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
(নিবন্ধে প্রকাশিত অভিমত লেখকের একান্তই নিজস্ব ও ব্যক্তিগত। এটি সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নাও হতে পারে- সম্পাদক)

সর্বশেষ