বুধবার,২৪,ডিসেম্বর,২০২৫
16 C
Dhaka
বুধবার, ডিসেম্বর ২৪, ২০২৫
প্রচ্ছদসম্পাদকীয়মুক্তমতপাটকল বন্ধ: জাতীয় সম্পদ ধ্বংস ও বেকারত্ব

পাটকল বন্ধ: জাতীয় সম্পদ ধ্বংস ও বেকারত্ব

বাংলাদেশে পাট কেবল একটি কৃষিপণ্য নয়; এটি দেশের অর্থনীতির প্রাণ। স্বাধীনতার আগে-পরে কয়েক দশক ধরে পাটকে বলা হতো “সোনালি আঁশ”—যার মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রায় সত্তর শতাংশ আসত। অথচ আজ এই শিল্প ধ্বংসপ্রায়, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো বন্ধ, হাজারো শ্রমিক বেকার, আর কারখানার বহুমূল্য সম্পদ অপচয় হচ্ছে।
পাটকল বন্ধের পটভূমি- 
পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের পাট ছিল প্রধান রপ্তানি পণ্য। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনা হয় ৭৮টি পাটকল। শুরুতে সাফল্য থাকলেও ধীরে ধীরে আমলাতান্ত্রিক  ব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে মিলগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্তে পাটকলে প্রথমে গোল্ডেন হ্যান্ডশ্যাক ও পরে  সংস্কার কর্মসূচি চালু হয়। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্প কমানো, শ্রমিক ছাঁটাই এবং বেসরকারিকরণের চাপ তৈরি হয়। ফলাফলে—শিল্প দুর্বল হয় এবং শ্রমিকরা চাকরি হারায়।
আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা ও বাংলাদেশের অবস্থান- 
বিশ্বে প্লাস্টিক দূষণের কারণে পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে জুট ব্যাগ, জিও-টেক্সটাইল, জৈব-বিয়োজ্য প্যাকেজিংয়ের চাহিদা পুনরায় দ্রুত বাড়ছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী—২০২৪ সালে বৈশ্বিক জুট বাজারের আকার প্রায় ২৮০ কোটি মার্কিন ডলার, যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধি ৫.৮ শতাংশ। শুধু জুট ব্যাগের বাজারই ২০২৪ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে ২৪৭ কোটি থেকে ২৬৮ কোটি ডলারে পৌঁছেছে।
ভারত এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পাটশিল্পকে আধুনিক করেছে, যেখানে বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি হয়। নেপালও নতুন প্রযুক্তি ও প্যাকেজিং ব্যবহার করে বাজারে প্রবেশ করেছে। অথচ বাংলাদেশ, যেখানে সেরা মানের পাট উৎপাদিত হয়, তার বাজারের অনেকটাই হারাচ্ছে। চীন কাঁচা পাট কিনে প্রক্রিয়াজাত পণ্য বানিয়ে আবার তা  বিশ্ববাজারে বিক্রি করছে।
সামনে বাজার আরও বাড়বে । ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩০ সালের মধ্যে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক নিষিদ্ধের পরিকল্পনা করেছে। এর মানে, পরিবেশবান্ধব পণ্যের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় থাকতে পারে—তবে আমাদের পাটকল বন্ধ থাকলে সুযোগ হারাবো তা নিশ্চিত।
শ্রমিক ও কৃষকের ওপর প্রভাব
রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধের ফলে প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পরোক্ষভাবে প্রভাব পড়েছে প্রায় দুই থেকে তিন লাখ পরিবারে। অনেক পরিবার গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসী হয়ে দারিদ্র্যের চক্রে আটকা পড়েছে। শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়া, মেয়েদের বাল্যবিয়ে বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য সমস্যা—এসব সামাজিক বিপর্যয়ও দেখা গেছে। অন্যদিকে কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। আড়তদার ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে উৎপাদক বঞ্চিত হচ্ছেন, ফলে অনেকে পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন। আর্থিক ক্ষতির হিসাব ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে। রাষ্ট্রীয় পাটকলগুলো পুনরুজ্জীবিত হলে এটি সহজে ৩–৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারত। প্রতি বছর বন্ধ পাটকলের কারণে সম্ভাব্য রপ্তানি আয় কমপক্ষে ৪–৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
গবেষণা, উদ্ভাবন ও দুর্নীতি- 
বাংলাদেশ জুট গবেষণা ইনস্টিটিউট উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে—উন্নত বস্তা, কার্বন-ঘন ফাইবার, আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি। তবে বাজেট সংকোচ, বিনিয়োগের অভাব, এবং যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে প্রযুক্তি কাজে লাগানো হয়নি।
শ্রমিক আন্দোলন ও রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা- 
১৯৮০–২০০০ সালের মধ্যে শ্রমিকরা বহু আন্দোলন ও ধর্মঘট করেছে। তাদের দাবি ছিল ন্যায্য মজুরি ও চাকরির নিশ্চয়তা। কিন্তু সরকারি উদাসীনতা ও ব্যবসায়ী স্বার্থের কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। শ্রমিক অধিকার ও মানবিক নিরাপত্তা আজও অবহেলিত। এই সংগ্রামে শ্রমিক নেতা কমরেড আবুল বাসার ছিলেন অন্যতম কণ্ঠস্বর। তিনি পাটশ্রমিকদের জন্য আন্দোলন, লং মার্চ, অনশন, মিছিল সংগঠিত করেন। তার দৃঢ় উচ্চারণ ছিল—“পাট শিল্প টিকিয়ে রাখা মানে কেবল শ্রমিকের চাকরি বাঁচানো নয়, দেশের অর্থনীতি ও কৃষকের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা।” কিন্তু তার সতর্কবাণী উপেক্ষা করায় আজ শিল্প ধ্বংসপ্রায়।
পরিবেশবান্ধব পণ্য ও টেকসই উন্নয়ন। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে জুট ও জৈব-বিয়োজ্য পণ্যের ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। বাংলাদেশের জন্য পাটশিল্পকে সবুজ অর্থনীতির অংশ করে তুলতে পারলে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে এবং বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সম্ভব।
করণীয়- 
১. আধুনিক প্রযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি সংযোজন।
২. জিও-টেক্সটাইল, জৈব-বিয়োজ্য প্যাকেজিংয়ের মতো নতুন পণ্য উন্নয়ন।
৩. “বাংলাদেশি সবুজ আঁশ” নামে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং।
৪. শ্রমিক পুনর্বাসন, দক্ষতা উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
৫. কৃষকের ন্যায্য দাম নিশ্চয়তা।
৬. আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ ও সনদপত্র প্রাপ্তি।
৭. বাজেট ও নীতিতে সবুজ অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অন্তর্ভুক্তকরণ।
উপসংহার- 
পাটকল বন্ধ করে বাংলাদেশ শুধু একটি রপ্তানী শিল্প হারায়নি; হারিয়েছে বৈশ্বিক বাজারের সম্ভাবনাও। শুকিয়ে যাচ্ছে একটা বৃহত্তর কর্মসংস্থানের খাত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা, গবেষণা ও উদ্ভাবনের অমূল্য সুযোগ—সবই নির্দেশ করছে, আমরা ভুল পথে চলছি। আজ বিশ্ব যখন প্লাস্টিকবিরোধী আন্দোলনে এগোচ্ছে, বাংলাদেশ যদি সঠিক পদক্ষেপ না নেয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মই প্রশ্ন করবে—“যে দেশ বিশ্বের সেরা পাট উৎপাদন করত, তারা কেন নিজেদের সম্পদ ধ্বংস করতে দিল?” সোনালি আঁশের পুনরুজ্জীবন এখন কেবল অর্থনীতির প্রশ্ন নয়; এটি জাতীয় স্বার্থ, পরিবেশ রক্ষা এবং মানবাধিকারের অপরিহার্য শর্ত।
সূত্র ও রেফারেন্স
১. বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই), বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২৩।
২. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), ২০২৪।
৩. বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ পুনর্গঠন কর্মসূচি সংক্রান্ত নথি, ১৯৮০–৯০-এর দশক।
৪. জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) প্রতিবেদন, ২০২৩।
৫. আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ প্রতিবেদন: গ্লোবাল জুট মার্কেট অ্যানালাইসিস ২০২৪।
৬. পশ্চিমবঙ্গ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন, বার্ষিক প্রতিবেদন, ২০২৩।
লেখক- শরীফ চৌহান
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

সর্বশেষ