বৃহস্পতিবার,২৫,এপ্রিল,২০২৪
29 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতপাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কোনো বিকল্প নেই

পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কোনো বিকল্প নেই

|| নিতাই চন্দ্র রায় ||

বিশুদ্ধ বীজের মাধ্যমে ফসলের ফলন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বাড়ানো যায়। এছাড়া উৎপাদিত পণ্যের মান, বাজার মূল্য, পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ বীজের গুণগতমানের ওপর নির্ভর করে। দেখা গেছে সীমান্তের ওপার থেকে অবৈধ পথে আসা নি¤œমানের পাটবীজ ব্যবহারের কারণে অনেক সময় অকালে পাট গাছে ফুল আসে। ফলন হ্রাস পায়। আঁশের মান নষ্ট হয়ে যায়। কৃষক আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির শিকার হন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালে পাট রপ্তানিতে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম এবং উৎপাদনে দ্বিতীয়। দেশে প্রতি বছর ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর জমিতে ৮০ থেকে ৯০ লাখ বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়। গত ২০১৯-২০ মৌসুমে বাংলাদেশে ৬ লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর জমিতে ৮০ লাখ বেল পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু পাট বীজের অভাবসহ নানা কারণে সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
প্রতি হেক্টর জমিতে পাট আবাদে ৫ থেকে ৭ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দেশে উৎপাদিত বীজের মাধ্যমে চাহিদার ১০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব হয়। বাকি চাহিদার ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ভারতীয় বীজের মাধ্যমে পূরণ হয়ে থাকে। সামান্য কিছু বীজ ব্যবসায়ীরা চীন, মিয়ানমার, ব্রাজিল ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আমদানি করেন। গত অর্থবছরে ভারত থেকে সাড়ে ৪ হাজার টনের বেশি বীজ আমদানি হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে সেই বীজ সময় মতো দেশে আসতে পারেনি। এমনিতেই গত বছর বন্যার কারণে পাটের উৎপাদন ব্যাহত হয়। তার ওপর সময় মতো ভারতীয় বীজ না আসায় পাটের উৎপাদন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ হ্রাস পায়, যার প্রভাব পড়ে কাঁচা পাটের বাজারে।
দেশে মূলত দেশি ও তোষা এ দুই জাতের পাটের চাষ হয়। উৎপাদিত পাটের ১৫ ভাগ আসে দেশি এবং ৮৫ ভাগ আসে তোষা জাত থেকে। তোষা পাটবীজের চাহিদার প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ ভারত থেকে আমদানিকৃত জেআরও-৫২৪ জাতের মাধ্যমে মিটানো হয়। অথচ জিনোম গবেষণার মাধ্যমে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত রবি-১ ( তোষাপাট-৮)’ পাটের ফলন জেআরও-৫২৪ জাতের চেয়ে ১৫ থেকে ২০ ভাগ বেশি। তোষা পাটবীজ সাধারণত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাসের ফসল। এ সময়ে উচ্চ মূল্যের রবি ফসলের পরিবর্তে তূলনামূলক কম লাভজনক পাটবীজ উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ দেখা যায় না। তাই পাটবীজ উৎপাদনের পরিবর্তে কৃষক পাট চাষের সময় বাজার থেকে সহজলভ্য ভারতীয় বীজ ক্রয় করে পাট চাষ করাই লাভজনক মনে করেন।
বাংলাদেশে বছরে কৃষক পর্যায়ে প্রত্যায়িত বীজের চাহিদা ৫ হাজার ২১৫ মেট্রিক টন। চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সরবরাহ করে মাত্র ৭৭৫ মেট্রিক টন। এর মধ্যে তোষা ৫১৫ মেট্রিক টন এবং দেশি ২৬০ মেট্রিক টন। তোষা পাটের প্রায় পুরোটাই ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এই বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য বিলম্বে হলেও কৃষি মন্ত্রণালয় ৫ বছর মেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ২০২৫-২৬’ এই ৫ বছরের মধ্যে দেশে ৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পাটবীজ উৎপাদনের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই পরিমাণ তোষা পাটবীজ উৎপাদনের জন্য ৮ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে পাটবীজের চাষ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের কথা ভর্তুকি দিয়ে হলেও পাট বীজের উৎপাদন বাড়াতে হবে। অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকলে সব সময় অনিশ্চয়তায় থাকতে হয়। তার ওপর পাট বীজের রপ্তানির ওপর সংশ্লিস্ট দেশের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ভয় থাকতে পারে। ইতিমধ্যে আমাদের পাট পণ্যের ওপর ভারতের এন্টিডাম্পিং করারোপের ফলে ভারতে বাংলাদেশের পাট পণ্যের রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। ভারতে কোনো কারণে পাটবীজের উৎপাদন বিঘিœত হলে এবং পেঁয়াজের মতো বিনা নোটিশে হঠাৎ পাটবীজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে মহা বিপদে পড়বে দেশের পাট চাষি, পাট শিল্প এবং এই শিল্পের সাথে সংশ্লিস্ট শ্রমকি-কর্মচারি ও ব্যবসায়ীগণ। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে- তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
অন্যের ওপর নির্ভরশীল না থেকে পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গৃহিত সমন্বিত উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। আমারা দীর্ঘ দিন পাটবীজের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল থাকতে পারি না। বাংলাদেশকে অবশ্যই পাটবীজের উৎপাদন বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে উৎপাদিত পাটবীজ কৃষকদের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করতে হবে। গুণগত মানের বিশুদ্ধ পাট বীজ ব্যবহারের ফলে পাটের ফলন, আশেঁর মান ও উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। উৎপাদন খরচ হ্রাস পাবে। এতে কৃষক পাটের ন্যায্যমূল্য পাবেন। পাট চাষ লাভজনক ফসল হিসেবে পুনরায় এদেশের কৃষকের নিকট সমাদৃত হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য পাটের অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বেশি ফলন ও আঁশের গুণগতমানের জন্য বৃহত্তর ফরিদপুর ও যশোর অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনিিস্টটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত রবি-১ পাট জাতটি ইতিমধ্যে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। যথাযথভাবে সম্ভাবনাময় এই জাতটিকে সম্প্রসারণের মাধ্যমে পাটবীজের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ পাট ও পাটজাতপণ্য রপ্তানি করে ৩ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় করে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ দশমিক ২৬ শতাংশ বেশি। রপ্তানিবাণিজ্যের এই অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখতে হলে পাটবীজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই।
এক সময় আলু বীজের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। কিন্তু টিস্যু কালচার পদ্ধতির মাধ্যমে ব্রিডার বীজ উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ বীজ আলু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এ ক্ষেত্রে বিএডিসিসহ বিভিন্ন বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলি উল্লেখযোগ্য অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। এছাড়া প্রায় পোনে দুই কোটি মেট্রিক টন সবজি উৎপাদন করে বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বে সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থান দখল করেছে। সবজি উৎপাদনের এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছেনে বেসরকারি বীজ উৎপাদন কাম্পানিগুলোর সারা বছরব্যাপী উচ্চ ফলনশীল সবজি বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমরা যদি সবজি বীজ ও বীজ আলু উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারি, তাহলে পাটবীজেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারবো। পাট বীজে স্বয়ংস্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ,বিএডিসি ও বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে একযুগে কাজ করতে হবে। সেইসাথে উৎপাদিত বীজের ব্যবহার এবং উৎপাদনকারীদের পাটবীজের ন্যায্যমূল্য প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।এজন্য সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে ভারতীয় নি¤œমানের পাটবীজের অনুপ্রবেশ বন্ধেরও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক(কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ লি:, গোপালপুর , নাটোর

সর্বশেষ