শুক্রবার,১৯,এপ্রিল,২০২৪
32 C
Dhaka
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা

॥ রাশেদ খান মেনন ॥

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা নিয়ে বিশেষ কিছু লেখা হয়নি। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনায়ও সে সম্পর্কে কমই উল্লেখ হয়। বরং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাম কমিউনিস্টদের একাংশের ভ্রান্ত অবস্থানের কারণে তাকে উল্লেখ করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের ভূমিকা পুরোপুরি অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়। অথচ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে সংঘটিত হয়েছে কেবল নয়, ’৪৮ থেকে বস্তুত পাকিস্তানে চলে আসা পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত রূপ ছিল সেটি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই এই লড়াই শুরু হয়। যাত্রা শুরু থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক মোড়ে বামপন্থীরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। একেবারে যাত্রা শুরুর কথা যদি বলতে হয় তা’হলে মওলানা ভাসানীর কথা বলতে হয়। তিনি ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন। তখনও তিনি মুসলিম লীগে। আসাম থেকে পূর্ব বাংলায় এসে তিনি রাজনীতি শুরু করেছেন। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। এদেশের বামপন্থীদের, যার মাঝে কমিউনিস্ট পার্টিই ছিল প্রধান, তখন চরম দুর্দিন। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপরই তৎকালীন সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি- যাতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টরাও অন্তর্ভূক্ত ছিলেন- ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হায়, লাখো ইনসান ভুখা হায়, সাচ্চা আজাদী ছিনকে লও’ বলে বিপ্লবের যে রণকৌশল নিয়েছিলেন জনগণের কাছ থেকে কোন সাড়া না পাওয়ার কারণে একদিকে যেমন তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, তারা তেমনি সম্মুখীন হয়েছিলেন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর চরম নিপীড়নের। এই অবস্থায় এদেশের কমিউনিস্টরা মওলানা ভাসানী ও তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগের মধ্য থেকে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করে ছাত্র-তরুণদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাতে এই যুবলীগেরই ছিল অগ্রণী ভূমিকা। ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব লক্ষ্য করলে নব উত্থিত বামপন্থী তরুণদের এই ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। বস্তুত ভাষা আন্দোলন, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলিতে এদের ভূমিকা প্রাধান্যে ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা প্রণয়নে চুয়ান্ন’র নির্বাচনের কর্মীশিবির সমূহে, পঞ্চাশের প্রথমার্ধব্যাপী স্বাঃয়ত্তশাসনের আন্দোলনে, কাগমারী সম্মেলনে, যেখানে মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানকে তার ঐতিহাসিক “আসসালামু আলাইকুম” জানিয়েছিলেন, বামপন্থীরা ছিল প্রধান ভূমিকায়। কলকাতা পার্টি কংগ্রেসে ১৯৪৮ সালে ভারত ও পাকিস্তানে দুটি আলাদা পার্টি করার সিদ্ধান্ত হয় এবং সারা পাকিস্তানভিত্তিক কেন্দ্রীয় কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু সারা পাকিস্তান ভিত্তিক পার্টির ঐ কেন্দ্রীয় কমিটি কখনও বসতে পারেনি। এর ফলশ্রুতিতে ১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এই উপলব্ধিতে উপনীত হয় যে পাকিস্তানের দুই অংশের একই সাথে বিপ্লব হবে না। কার্যত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ভাগ হয়ে পাকিস্তান পার্টির পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কমিটি প্রথম থেকে একেবারে আলাদাভাবেই তাদের কর্মকান্ড পরিচালনা করছিল। ইতোমধ্যে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি সাধারণ দাবীতে পরিণত হয়েছিল। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবীকে এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি বেলুচিস্তান, সিন্ধু প্রদেশ ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতেও সোচ্চার ছিল।
এখানে ইতিহাসের একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা’হল ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গ্রহণ করা হয়। ঐ সংবিধানে পূর্ব বাংলার সংখ্যাধিক্যের বিষয়টি বিসর্জন দিয়ে সংখ্যা সাম্যনীতি গ্রহণ করা হয় এবং পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানকে দুই ইউনিট হিসাবে গণ্য করা হয়। এই সাথে পূর্ব বাংলার নামটিও পাল্টিয়ে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। মওলানা ভাসানী ও বামপন্থীরা এই সংখ্যাসাম্য নীতির ঘোর বিরোধিতা করেন। অপরদিকে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এই সংখ্যাসাম্যনীতির প্রবক্তাই ছিলেন না কেবল, তারপক্ষে ওকালতিও করেন। এর বিরোধিতাকারীদের কমিউনিস্ট বলে আখ্যায়িত করেন। পরবর্তীতে কয়েকমাসের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সোহরাওয়ার্দী ঢাকা এসে বক্তৃতা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ইতোমধ্যে আটানব্বইভাগ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই সংখ্যাসাম্যনীতি গ্রহণ না করলেও সোহরাওয়ার্দীর প্রতি তার আনুগত্যের কারণে তার পক্ষেই অবস্থান নেন। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ (এক্ষেত্রেও সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ব্যাখ্যা ছিল- ‘জিরো প্লাস জিরো ইকুয়ালটু জিরো’। এ দুই বিষয় বিশেষভাবে আওয়ামী লীগে বিভক্তি ডেকে নিয়ে আসে। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বামপন্থীরা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) সংগঠিত হন ও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে অটল থাকেন। এসময় তাদেরকে ভারতের দালাল, যুক্তবাংলার সমর্থক বলে আওয়ামী লীগ অভিযুক্ত করত।
এ পর্যায়ে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারীর মাধ্যমে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের ক্ষমতাকে আরো কেন্দ্রীভূত করে এবং পূর্ব বাংলার উপর জাতিগত নিপীড়ন তীব্র থেকে তীব্রতর করতে থাকে। সামরিক শাসক আয়ুব খানের দশ বছরের শাসনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দৃশ্যমানভাবে এমন বেড়ে যায় যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্রমাগত প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। ষাটের দশকের যাত্রা শুরুতেই এই অঞ্চলের ছাত্র, সংস্কৃতি কর্মী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য, বাঙালির সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও সর্বোপরি গণতন্ত্রের দাবিকে বিভিন্ন কর্মকা-ের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে নিতে থাকে। বস্তুত; এই ষাটের দশকের শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধিকারের দাবি সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করতে শুরু করে। এবং একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই যে এই দাবির পিছনে বামপন্থী ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
এর কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যায়। ’৬২-র সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও শিক্ষা আন্দোলনের অন্যান্য দাবির মধ্যে মুখ্য ছিল পাকিস্তানের উভয় অংশের বৈষম্য। ইতোমধ্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান তার ঐতিহাসিক ‘দুই অর্থনীতি’র তত্ত্ব হাজির করেছেন। বস্তুত; ’৬২-র সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের কাছে বক্তৃতা দিতে আসা পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদেরকে ঐ অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে সূচিত ঘটনা প্রবাহে। এই ধারাবাহিকতায় ’৬২-র একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারকে সাজানো হয়েছিল ঐ অর্থনৈতিক বৈষম্যকে চিত্রিত করে বিভিন্ন প্লাকার্ড ও পোস্টার দিয়ে। এর মূল কাজটাই করেছিল সে সময়কার বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা। এর কিছুদিন বাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগ আয়োজিত প্রদর্শনী যার মূল আয়োজক এই বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সমর্থকরা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে বিপুল বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরেছিল। পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক স্বাধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিও তারা প্রকাশ্যেই তুলে ধরতে থাকে। সম্প্রতি সময়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অনুঘটক হিসাবে যে নিউক্লিয়াসে’র কথা সোচ্চারে প্রচার করা হয় এসব আন্দোলনে তাদের ভূমিকা বরং বিপরীতই ছিল। এ প্রসঙ্গে আজকের বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই কথাগুলো দিয়ে পোস্টার করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনে ছাত্রলীগের ছেলেরা বোমা-পটকা নিয়ে আক্রমণ করেছিল। কেবল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নয়, সারা দেশেই পূর্ব বাংলার স্বপক্ষে এসব কথা বলাতে ‘এনএসএফ’ ছাত্র শক্তি তো বটেই, ছাত্রলীগও ছাত্র ইউনিয়নকে যুক্ত বাংলার সমর্থক বলে অভিযুক্ত করত।
এই ছাত্র ইউনিয়ন পরিচালিত হত মূলত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা। আগেই বলা হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এই উপলব্ধিতে উপনীত হয়েছিলো যে পার্টির দুই অংশে একসঙ্গে বিপ্লব করা যাবে না। তবে তারা স্বাধীনতার প্রশ্ন তখনও বিবেচনায় নেয়নি। পরবর্তীতে ১৯৬৭ তে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি মতাদর্শগত প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) হিসাবে নতুন করে সংগঠিত হলে তার প্রথম কংগ্রেসে রণনীতিগত দলিলে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরা হয়। এটা ছিল স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রথম কোন রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত। অবশ্য ইতোমধ্যে স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর নীতির পরিহার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিরুর রহমান তার ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবী তুলে ধরেছেন এবং তার ভিত্তিতে আন্দোলন ক্রমাগত জনসমর্থন লাভ করছে। পাশাপাশি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতার দাবিতে বামপন্থী ধারাও নিজেদের সংগঠিত করতে থাকে। যদিও এই সময় পশ্চিম বাংলার নক্সালবাড়ী আন্দোলনের প্রভাবে বাম কমিউনিস্টদের মধ্যে বাংলাদেশের বিপ্লবের রূপ কি হবে এ নিয়ে প্রচ- বিতর্ক শুরু হয় এবং বাম কমিউনিস্টদের সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) এর মধ্যে বিভিন্ন ধারা উপধারার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এসকল ধারা উপধারার মধ্যে সাধারণভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা আদায়ের প্রশ্নে এক ধরনের ঐক্যমত ছিল। ১৯৬৮ সালের সামরিক আইনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে মওলানা ভাসানী আহুত পাবনার শাহপুরের কৃষক সম্মেলনে লালটুপি পরিহিত কৃষকের গ্রাম-গ্রামান্তরে থেকে আসা মিছিলে এবং সম্মেলনস্থলে মূল যে শ্লোগান উচ্চারিত হয় তা’ছিল ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধর পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর’। ’৬৮-এর ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গভর্নর হাউস ঘেরাও, ২৯ ডিসেম্বর দেশব্যাপী গ্রামাঞ্চলে হাট হরতাল এসবই ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছিল। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। শ্রমিক অঞ্চলেও টঙ্গী, চট্টগ্রামে এই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ছাত্রদের ১১ দফা ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শহীদ আসাদের জীবনদানের মধ্য ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান যা ঢেউয়ের মত ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিকাঞ্চলে ঘেরাও আন্দোলন ও গ্রামাঞ্চলে তহশিল অফিস- জোতদার, মহাজন ও বদমাতব্বরদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে আগরতলা মামলায় সেনানিবাসে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করেন এবং বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বিপুলভাবে বেগবান হয়।
কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) থেকে বেরিয়ে আসা ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার কর্মসূচী প্রকাশ্যে ছাত্র-শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭০ এর ২২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) ও পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে পল্টনের জনসভায় প্রকাশ্যেই ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান ও তার ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
এই জনসভার প্রতিক্রিয়া ছিল বিভিন্নমুখী। একদিকে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন এই শ্লোগান ও কর্মসূচীর জন্য ঐ সভার সভাপতি ও বক্তাদের বিরুদ্ধে সামরিক আইন মামলা দায়ের করে। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুখপত্র ‘ইত্তেফাক’ এর রাজনৈতিক মঞ্চে একে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের কর্মকা- বলে সামরিক আইনে সভার উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘মস্কো টাইমস’ এর ৪৫ অথবা ৪৬ সংখ্যায় ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান ও তার কর্মসূচীকে পিকিংপন্থী কতিপয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উস্কানীমূলক কর্মকা- বলে অভিহিত করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ ঐ জনসভার বক্তাদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে হুলিয়া জারী করে এবং তার কিছুদিনের মাঝে সামরিক আদালত ঐ সভার বক্তা কাজী জাফর ও রাশেদ খান মেননকে সাত বছর ও তাদের সম্পত্তির আটভাগ বাজেয়াপ্ত করার ও মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুব উল্লাকে এক বছরের সশ্রম কারাভোগের দ-াদেশ প্রদান করে। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’ কর্মসূচী ঘোষণার ধারাবাহিকতায় আত্মগোপনে অস্ত্র সংগ্রহ, গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটি অঞ্চল তৈরী করার কাজ শুরু করে। এদিকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) এর নাম পরিবর্তন করে পূর্ববাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের নাম পূর্ববাংলা শ্রমিক ফেডারেশন রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতি অবশ্য স্বনামেই থাকে। ইতোমধ্যে পশ্চিম বাংলার নক্সালবাড়ী আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদারের তত্ত্ব অনুসরণ করে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি’ বাদে বাম কমিউনিস্ট অন্যান্য গ্রুপ গণসংগঠন, গণআন্দোলন বর্জন ও শ্রেণী শত্রু খতমের রাজনৈতিক লাইন গ্রহণ করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঐ মুক্তিযুদ্ধকে ‘দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি’ বলে নিজেদের তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এসে এদের কোন কোন অংশ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর পক্ষালম্বনও করে। বাম কমিউনিষ্টদের এই বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এ ধরনের ভ্রান্ত অবস্থান (যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসী যুদ্ধ করেছেন ও জীবনদান করেছেন) মুক্তিযুদ্ধে বাম-কমিউনিষ্টদের ভূমিকাকে চরমভাবে কলঙ্কিত করেছে এবং এর দায় সকল বামপন্থীদের নিতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে বাম-কমিউনিস্টদের এ সকল অংশের ঐ ভ্রান্ত অবস্থানের বিপরীতে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ তার ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ কর্মসূচী বাস্তবায়নে গেরিলা গ্রুপ গঠন, ঘাঁটি অঞ্চল গঠন ও অস্ত্র সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই ধারাবাহিকতায় ’৭১ এর ২৫ মার্চের কালরাত্রির গণহত্যার পরপরই ঐ সমন্বয় কমিটির মূল নেতৃত্ব তৎকালীন ঢাকা জেলার নরসিংদীর শিবপুর থানা (বর্তমানে উপজেলা)কে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজ শুরু করে। সমন্বয় কমিটির নেতৃত্ব এপ্রিল-মে মাসে সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে সংযোগ স্থাপন করে দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা শুরু করে।
প্রাথমিক পর্যায়ে অস্ত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে আমার শ্যালক গোলাম মোস্তফা হিল্লোল শহীদ হন। সে ছিল আমাদের প্রথম শহীদ। এ সময় বাগেরহাটের সমন্বয় কমিটির রফিক বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতির কর্মীদের সংগঠিত করে গোটাপাড়াকে কেন্দ্র করে বাগেরহাটে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করে। এই বাগেরহাটে সমস্ত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় রফিকের নেতৃত্বে পাক-বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে আমাদের যোদ্ধারা অসম সাহসী যুদ্ধ করে। রফিকের নেতৃত্বাধীন এই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা নোমা কুখ্যাত রাজাকার নেতা রজব আলীকে গুরুতরভাবে আহত করে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর নিজ পরিণাম আঁচ করতে পেরে সে আত্মহত্যা করে। এই ঘটনা বাগেরহাট অঞ্চলের রাজাকারদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে এবং তাদের অনেকেই পক্ষ ত্যাগ করে রফিকের নেতৃত্বাধীন বাহিনীতে যোগ দেয়। অন্যদিকে পিরোজপুরে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ফজলুর নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধের শুরুতেই পিরোজপুরের থানার অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র দখল করে নেয়। অবশ্য পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আক্রমণ শুরু হলে ফজলু ধরা পড়ে এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পিরোজপুরে এই যোদ্ধারাই সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় ঐ অঞ্চলে পাকবাহিনীকে ব্যস্ত রাখে। রফিকের নেতৃত্বাধীন এই বাম মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র সংগ্রহ করে যা বাংলাদেশ স্বাধীন হলে কর্নেল মঞ্জুরের কাছে সমর্পণ করা হয়। এই সময়ে বরিশালে সৈয়দ নজরুল ও শাহ আলম ছাত্র-কৃষকদের সংগঠিত করে ঐ অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু করে। পরে সৈয়দ নজরুল পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে নির্মমভাবে নিহত হয়। এরা কেউই ভারতে যায়নি। দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেছেন।
অন্যদিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ‘মার্কসবাদী’র সাথেও সংযোগ স্থাপন করে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির উদ্যোগে ও সিপিআই(এম) এর সহযোগিতায় জুন মাসে ভারতের আশ্রয় গ্রহণকারী বামপন্থী বিভিন্ন দল গ্রুপকে একত্রিত করে ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়। জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটি তার ঘোষণায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থনদান ও তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা ঘোষণা করে। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারদের অধীন পরিচালিত যুদ্ধ সমূহে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু এ কাজটা করা খুব সহজ ছিল না। এব্যাপারে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিশাল বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও একই আচরণ করে বিভিন্ন যুব ক্যাম্প ও সেক্টর থেকে বামপন্থী এসব কর্মীদের প্রায়ই বের করে দিয়েছে। কাউকে কাউকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে, কেউ কেউ ভারতের জেলেও গেছেন। মূলত নক্সালভীতি ও মুক্তিযুদ্ধে জাতীয়তাবাদীদের একচ্ছত্র নেতৃত্ব যাতে ক্ষুণœ না হয় সে কারণে মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস ও বাংলাদেশ পরবর্তীকালে বাম-কমিউনিস্টদের এই বিরূপ আচরণের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে বিভিন্ন সেক্টরে ও দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় এই বাম কমিউনিস্টরা অসম সাহসী ভূমিকা পালন করে। আগরতলার মেলাঘরে যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো তার মূল ভূমিকায় ছিল আমার ছোট ভাই শহীদুল্লাহ খান বাদল। আর ২নং সেক্টরের কর্নেল হায়দারের স্টাফ অফিসার ছিল আমার আরেক ছোটভাই সুলতান মাহমুদ খান মনন। বস্তুত ক্যাপ্টেন (পরবর্তীতে কর্ণেল) হায়দারের অধীনে ঢাকা ক্রাক প্লাটুনের অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা ছিল বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী ও সমর্থক। অন্যান্য সেক্টরেও তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন নয়মাসে সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে আমার দায়িত্ব ছিল দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাসমূহে মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় করা। সে অনুযায়ী আমি সেক্টর কমান্ডার বাশার, সেক্টর কমান্ডার কর্নের কাজী নুরুজ্জামান বীর উত্তম, ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ, এয়ার ভাইস মার্শাল সদরুদ্দীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ রেখে দিনাজপুর, রংপুর ও রাজশাহীর আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করি। এ সময় দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ফ্রন্টাল যুদ্ধ দেখার ও তাদের সহায়তা করার সৌভাগ্য হয়।
ডান কমিউনিস্টরা অবশ্য সেদিক দিয়ে সুবিধায় ছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) কংগ্রেসের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় তারা ভারতে বিশেষ সুবিধা লাভ করে। তারা মূলত সিপি আই এর সাথে মিলে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা করে বেড়াতে। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে তারা অংশ নেয়। কিন্তু অক্টোবর পর্যন্ত তারা আলাদাভাবে সংগঠিত হতে পারেনি। অক্টোবরে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের আলাদা গেরিলা গ্রুপ গঠিত হয়। তারা ভারতের বিভিন্ন সামিরক ছাউনীতে প্রশিক্ষণ নেয়। কিন্তু সেই প্রশিক্ষণ শেষ হতে না হতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারত-পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়।
বাম কমিউনিস্টদের মধ্যে যারা ‘দুই কুকুরে কামড়া কামড়ির সর্বনাশা তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন তাদের এক বড় অংশ খুলনা-যশোর অঞ্চলে পাকিস্তানী বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে অসম সাহসী লড়াই করেন। কমরেড মোহাম্মদ তোয়াহা পার্টির মূল নেতৃত্বে থাকার পরও তার বাস্তববুদ্ধিতে নোয়াখালী চর অঞ্চলে মুক্ত অঞ্চল গঠন করে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বিতরণ করলেও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কোন সংঘাতে আসেননি। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার তার সাথে যোগাযোগও স্থাপন করেছিল বলে জানা যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের অংশগ্রহণে ভারত সরকারের আপত্তি সত্ত্বেও ঐ মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে এসে মওলানা ভাসানীকে প্রধান ও অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহম্মদ, মণিসিংহ মনোরঞ্জন ধর প্রমুখদের অন্তর্ভুক্ত করে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। অবশ্য ঐ উপদেষ্টা পরিষদের একটি মাত্র সভা হয়েছিল। ঐ সভার ছবি তুলে ভারত সরকার ব্যাপক প্রচার করে যাতে বিশ্বের অন্যান্য শক্তি মনে করে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দলমত নির্বিশেষ সবাই ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু কোন ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে সকল দলমতের অংশগ্রহণের সুযোগ দানে তারা রাজী ছিল না। একারণে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটি কর্তৃক বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করার অথবা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের কোন ধরনের ইতিবাচক সাড়া পায়নি। মুক্তিযুদ্ধে দেশের সকল স্তরের মানুষেরা, খুব অল্প সংখ্যক দল ও গোষ্ঠী বাদে, অংশগ্রহণ করলেও মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের একক লড়াই বলে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা ছিল সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে।
একথা বলা অনস্বীকার্য যে, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মার্চ পরবর্তী অসহযোগ আন্দোলন আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতা আন্দোলনের একক নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত করেছিল। একাত্তরের সাতই মার্চের পর তারই নির্দেশে দেশ পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু ’৪৮ থেকে শুরু করে ৫২’র ভাষা আন্দোলন ’৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের বিজয়, ষাটের দশকের শুরুতে ছাত্রদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ছাত্রদের ১১ দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সর্বোপরি সত্তরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার আন্দোলন ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছে। এই প্রতিটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রধান নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। ’৭০-র নির্বাচন ও ৭১-র মার্চের ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন তাকে দেশের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত করেছিল। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ তার নামেই পরিচালিত হয়েছিল।
একইসঙ্গে একথাও অনস্বীকার্য যে বামপন্থীরা এদেশের মানুষের মনে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিল। ঐ সকল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তি ডান ও বাম বিচ্যুতি ও সর্বশেষে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ঐ বাম কমিউনিস্টদের একাংশের সর্বনাশা বিভ্রান্তি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বামপন্থী ধারাকে হীনবল কেবল নয়, বিশাল প্রশ্নের সম্মুখীন করেছিল। কিন্তু ইতিহাসের একটি বা দুটি ঘটনা ইতিহাসের সব সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করে না। সেক্ষেত্রে মধ্য পঞ্চাশে সংখ্যাসাম্যনীতি মেনে নেয়া, পূর্ব পাকিস্তানের আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়েছে বলে দাবি করা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা বলে উল্লেখ করা যায়। কিন্তু সেটিও ইতিহাসের সব কথা বা শেষ কথা ছিল না। বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের উঠতি পড়তির মধ্য দিয়ে পরিণামের দিকে অগ্রসর হয়েছে। সেক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থার ধারা সমানতালেই অগ্রসর হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা এই সমগ্র ইতিহাসের আলোকেই বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় যাদের স্বপ্ন, যাদের প্রচেষ্টা, ত্যাগ, জীবনদান একে সম্ভব করেছে তাদের সবাইকেই স্বীকার করতে হবে। বামপন্থীরা এক্ষেত্রে অবশ্যই এগিয়ে ছিল। তাদের আদর্শনিষ্ঠ সংগ্রাম, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষকে সংগঠিত করা স্বাধীনতার ক্ষেত্রকে প্রস্তুত করেছিল যার উপরে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও সংসদ সদস্য 

সর্বশেষ