রবিবার,৯,নভেম্বর,২০২৫
23 C
Dhaka
রবিবার, নভেম্বর ৯, ২০২৫
প্রচ্ছদসম্পাদকীয়মুক্তমতবিদায় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম! একজন মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী ও মার্কসবাদী চিন্তক চলে গেলেন

বিদায় অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম! একজন মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী ও মার্কসবাদী চিন্তক চলে গেলেন

“যার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে একটা  ধারার অবসান”  
১০ অক্টোবর বিকেলে চলে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম (১৯৫১-২০২৫)। কয়েক দিন ধরে হাসপাতালে যমে-মানুষে টানাটানি করে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম চলে গেলেন। তাঁর মৃত্যুকে  একটি যুগের ধারার অবসান বলা চলে। পত্রিকার সংবাদে তাঁর বহুবিধ পরিচয় সম্পর্কে জানা যাবে। কিন্তু তাঁর ছাত্ররা জানবেন তাঁর  ব্যক্তিত্বের সৌরভ কেমন ছিল।  আমি তাঁর ছাত্র নই কিন্তু তাঁর গুণগ্রাহী।  আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর জেনেছিলাম,  ইংরেজি বিভাগ একটা স্নব বিভাগ। এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমাদের মতো নয়। আমার বিভাগের নিচে দোতলায় তখন ইংরেজি বিভাগ। সেই বিভাগের কালজয়ী একজন অধ্যাপককে চিনতাম। তাঁর লেখা পড়তাম।  তিনি কয়েকবার সিনেট- সিন্ডিকেটের ভোটে উপাচার্যের জন্য সর্বাধিক ভোট পেয়েছিলেন কিন্তু সরকার তাঁকে মনোনয়ন দেয়নি।  কারণ তিনি বামপন্থী ছিলেন : প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।  আমরা তাঁকে পড়তাম বাংলা ভাষায়।  সংবাদ পত্রিকায় গাছপাথর নামে কলাম লিখতেন : সময় বহিয়া যায়। ইংরেজির অধ্যাপক বাংলা ভাষায় লিখতেন,  বাংলা বলার সময় ইংরেজির মেশাল দিতেন না। আমারতো বাংলায় কথা বলার সময় বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করি: নিজের ইংরেজি বিদ্যা জাহির করি। চৌধুরী স্যার তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন।
আর চৌধুরী স্যারের একজন  ব্যতিক্রমী ছাত্র ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনিও বাংলা ভাষায় লিখতেন। বাংলায়  কথা বলার সময় ইংরেজির মেশাল দিতেন না। আজ তাঁর মৃত্যুতে আমার কিছু কথা মনে পড়ছে।  চৌধুরী স্যার ছিলেন আমাদের পিতৃসম কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন অনেকটা অগ্রজের মতো। কারণ তিনি বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তব্য রাখতেন। টিএসসি বা ক্যাম্পাস বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় তিনি আমন্ত্রণ রক্ষা করতেন। নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন তিনি। বিশেষ করে বামপন্থী সাহিত্য নিয়ে তিনি বক্তব্য রাখতেন। উল্লেখ্য যে, আশির দশকে বামপন্থী সাহিত্য বলতে বেশির ভাগই সোভিয়েত সাহিত্য বুঝাতো। আমি অন্তত তাই মনে করতাম।  আমি যাঁদের সাথে ঘোরাফেরা করতাম সেখানে গোর্কী ল্যুসূন, মানিক এদের কদর বেশি দেখতাম।  ইংরেজি ভাষায় বা পশ্চিমা মার্কসবাদী সাহিত্য বা লাতিন আমেরিকার মার্কসবাদী বা পরাবাস্তববাদী লেখকদের সম্পর্কে তেমন জানতাম না। এই ধারার সাহিত্য পড়লেও পশ্চিমবঙ্গের অনুবাদে পড়তে হতো। কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আশির দশকে সেই চাহিদা পূরণ করতে এগিয়ে আসেন এবং নানা পত্র পত্রিকায় লিখে আমাদের প্রশিক্ষিত করতেন।  আর এভাবেই তিনি লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার প্রগতিশীল ও বামপন্থী সাহিত্যের হাওয়া বাংলাদেশে বয়ে দেন। তাঁর প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখালেখি পাঠকদের সমৃদ্ধ করতো।  তিনি লিটল ম্যাগাজিনেও লিখতেন।  পাঠচক্র বা ঘরোয়া আলোচনা বা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে বক্তৃতায় ব্যস্ত থাকতেন। তিনি ব্যতিক্রমিদের মতো  ইংরেজির লোক হয়েও মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।  এটা প্রায়শ দেখা যায় পশ্চিমা পিএইচডি ডিগ্রির ধারক বামপন্থীরা বেশ অহংয়ের অধিকারী হন। নিজেও এমন দেখেছি। কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন ব্যতিক্রম। চিন্তা ও চেতনায় বিশেষ করে সাহিত্যে তিনি  বামপন্থী ধারাটাকে নানাভাবে তুলে ধরতেন।  আমাদের মতো অনেকেই তাঁর কাছ থেকে শিখতাম।  তিনি কখনো একঘেয়ে ছিলেন না : ছিলেন বৈচিত্র্যময় ও আনন্দদায়ক।
তারপর আমরা ক্যাম্পাস ছাড়ি। দেশেও বামপন্থার কদর কমতে থাকে।  একটা নয়া উদারতাবাদী হাওয়া সাহিত্য থেকে সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যায়।  কিন্তু দূর থেকে লক্ষ্য করতাম অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নিজেকে বদলাননি, ভোল পাল্টাননি এবং সত্য থেকে নিজেকে চ্যুত করেননি।  বরং, তিনি গল্প উপন্যাস লিখে নিজের একটা ধারা তৈরি করলেন। গণমানুষকে নিয়ে আসলেন লাতিন আমেরিকার ধারা বা পরাবাস্তববাদী সাহিত্যের ধারায়। এই ধারা বাংলা সাহিত্যে তা কতটুকু ফলবতী হবে তার চেয়েও বড় হলো ওটা ছিল তাঁর নিজস্ব ধারা। এক নতুন রীতির তিনি চর্চা করে গেলেন।
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে কোনো সময়ের তোষামোদ করতে দেখিনি। সুবিধা নিতেও দেখিনি।  তারপরও যখন কেউ মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে পিছিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি অবলীলায় বলে গেছেন সাতই মার্চের ভাষণ শোনার অভিজ্ঞতার কথা।  তিনি বলেছেন,  আ ফ ম মাহবুবুল হকের কারণে তিনি এক বিদেশি রেড়িও সাংবাদিকের দোভাষী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের নোট নেন এবং তা অনুবাদ করেন। তিনি বলছেন,  আমি সব নোট নিয়েছি,  যারা বলেন বঙ্গবন্ধু ভাষণের শেষে,  জয় পাকিস্তান বলেছেন, তারা ভুল।  তারা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেননি।  এই রকম ইতিহাসের সাক্ষ্য দেওয়া বিরল।  আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বড় দূর্দিন। এই দূর্দিনে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম চলে গেলেন। আজ বামপন্থী সাহিত্যচিন্তারও বড় দূর্দিন। তাঁর লেখা হয়তো পথ দেখাবে কিন্তু এই রকম শিক্ষক তো আর পাওয়া যাবে না।
আমি দৃঢ় ভাবে বলতে পারি,  অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মহাপ্রস্থানে মুক্তিযুদ্ধ ও বামপন্থী একটা ধারার অবসান হয়েছে যাঁর প্রবর্তক ছিলেন তিনি নিজেই। এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।
লেখক- শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক

সর্বশেষ