নিজস্ব প্রতিবেদক- রাজশাহী
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (স্ট্রোক) বা হৃদযন্ত্র বিকল (হার্ট অ্যাটাক) হলে রোগীদের জীবন ও পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষায় দ্রুত একটি ইনজেকশন দিতে হয়। দেশের বাজারে এর দাম এক লাখ টাকা। হতদরিদ্র কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের কেউ তাৎক্ষণিক কিনতে পারেন না। রোগী বাঁচলেও অনেক ক্ষেত্রে পঙ্গুত্ব মেনে নিতে হয়। সেই ওষুধ আসালো রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যা রোগীরা পাবেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) শিক্ষানবিশ চিকিৎসক শীর্ষ শ্রেয়ানের প্রচেষ্টায় এ অঞ্চলের অন্তত ৫০০ রোগী এবার বিনামূল্যে এই ওষুধটি পাবেন। শীর্ষ শ্রেয়ান ৬১ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি গবেষণাও করছেন। তার উদ্যোগে নেদারল্যান্ডস থেকে দুই হাজার ৫০০ ভায়াল অ্যাল্টেপ্লেস ইনজেকশন এসেছে। ২০ আগস্ট বোহরিঙ্গার কোম্পানির ওষুধগুলো পাঠানো হয়। রামেক হাসপাতালে পৌঁছেছে ২৫ আগস্ট।
বুধবার (২৭ আগস্ট) হৃদরোগ বিভাগের ওয়ার্ডে ৭০টি ভায়াল দেওয়া হয়েছে। শীর্ষ শ্রেয়ানের এই উদ্যোগে সহযোগিতা করেছেন মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক আজাদ এবং হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ।
শীর্ষ শ্রেয়ান জানান, তিনি ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশনের সঙ্গে গবেষণা করছেন। কিছুদিন আগে তিনি তাদের জানান, বাংলাদেশে অধিকাংশ স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের পর রোগী মারা যান, নয়তো পঙ্গুত্ববরণ করেন। কারণ, দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত রোগীর আত্মীয়স্বজন ব্যয়বহুল ইনজেকশনটি কিনতে পারেন না। সরকারের পক্ষে বিনামূল্যে এ ওষুধ সরবরাহ করা সম্ভব না। তখন অস্ট্রেলিয়ার ডিরেক্ট রিলিফ নামের প্রতিষ্ঠানটিতে এই ওষুধটি ছিল প্রায় ৫ হাজার ভায়াল। রিলিফের পরিচালক গর্ডন উইলিয়ামকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীদের পরিস্থিতির কথা জানানো হয়। কিছু ইনজেকশন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। তখন গর্ডন উইলিয়াম দুই হাজার ৫০০ ইনজেকশন বিনামূল্যে দিতে সম্মত হন।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক আজাদ বলেন, এটার প্রথম যোগাযোগ শ্রেয়ান করেছে। এরপর আমি এবং পরিচালক মিলে সম্পন্ন করেছি। এটা নেদারল্যান্ডস থেকে আনা। ভারত থেকে যে ওষুধটি আসে, তার চেয়ে এটা দামি এবং গুণগতমানে ভালো। তার মতে, বিনামূল্যে আনা ওষুধের বাজারমূল্য প্রায় ১৭ কোটি টাকা।
ডা. আজিজুল জানান, শ্রেয়ান গবেষণা করছে স্ট্রোকের ওপর। গবেষকদের মাধ্যমে দাতা সংস্থার সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন সে মেডিসিন বিভাগে যোগাযোগ করে। পরে ওদের প্রধানের সঙ্গে জুম মিটিং করেন ডা. আজিজুল। স্ট্রোকের সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে এই ইনজেকশন দিলে রোগী ভালো থাকবে। কিন্তু এ দেশে স্ট্রোকের রোগীরা সময়মতো আসতে পারেন না। এই পরিস্থিতি জানিয়ে ডা. আজিজুল প্রস্তাব করেন, এই ওষুধটা হার্ট অ্যাটাকে ব্যবহারে অনুমতি দিতে হবে। তখন তারা এ অনুমতি দেয়। পরে হাসপাতালের সঙ্গে ডিরেক্ট রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের চুক্তি হয়। প্রতি রোগীকে পাঁচ ভায়াল ওষুধ দিতে হবে। এটা কিনতে গেলে একজন রোগীর এক লাখ টাকা লাগবে। এখন আমরা রোগীদের বিনামূল্যে দিতে পারব। তিনি আরও জানান, এখানে পৌঁছানোর পর শুল্ক এবং অন্যান্য খরচ দাতারা বহন করেছে।
ডা. আজিজুল হক আজাদ বলেন, কিডনি, ফুসফুস (সিওপিডি) আক্রান্তসহ আরও কিছু জরুরি ওষুধ আছে। সেটাও আমরা একই পন্থায় আনার চেষ্টা করছি।
রামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহাম্মেদ বলেন, এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। এটা সম্ভব হয়েছে শীর্ষ শ্রেয়ানের প্রচেষ্টায়। তাকে সহযোগিতা করেছেন মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক আজাদ। এই ওষুধ স্ট্রোক হলে সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োগ করতে হয়। হৃদরোগে ১২ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করতে হয়। বুধবার ৭০টি ভায়াল ওয়ার্ডে দিয়েছি। খুবই দামি এবং কার্যকর এই ওষুধ।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজের হৃদরোগ বিভাগের ইনচার্জ ডা. আবির বলেন, প্রথম দিন ৭০টি ভায়াল এসেছে ওয়ার্ডে। নতুন রোগী এলে তাদের আর চড়া মূল্যে এটা কিনতে হবে না। বিনামূল্যে ওষুধটি পাবেন।
রামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ফয়সাল আলম বলেন, এটা আমাদের জন্য খুশির খবর। ভবিষ্যতে আরও বেশি গবেষণা করার সুযোগ তৈরি করা হবে। শিক্ষার্থীরা যেন গবেষণায় যুক্ত হয়ে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা এবং এ ধরনের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এনে এ অঞ্চলের মানুষের উপকার করতে পারে।
শিক্ষানবিশ চিকিৎসক শীর্ষ শ্রেয়ান বলেন, স্ট্রোকের রোগীদের সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে এই ইনজেকশন দিতে পারলে রোগী পঙ্গু হবে না। জীবনও রক্ষা পাবে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে স্ট্রোকের রোগীরা সাড়ে চার ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালে আসতে পারেন না। এ ছাড়া হৃদরোগীদের জন্যও এই ইনজেকশনটি উপকারী। নালিতে রক্ত জমাট থাকলে এই ইনজেকশন তরল করে দেয়।



