জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করা এবং বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলায় সমন্বিতভাবে প্রচেষ্টা গ্রহণের ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শীর্ষ সম্মেলনে চার দফা সুপারিশে তিনি এই আহ্বান জানিয়েছেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার নয়াদিল্লির প্রগতি ময়দানের ভারত মান্দাপান কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য দেন। সূত্র: বাসস
সম্মেলনে ‘ওয়ান আর্থ’ অধিবেশনে বক্তব্যে সুপারিশের প্রথম পয়েন্টে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখানে জি-২০ ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং বাংলাদেশ সংকট মোকাবেলায় কার্যকর সুপারিশ তৈরি করতে তাদের প্রচেষ্টাকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’
দ্বিতীয় পয়েন্টে তিনি বলেন, ‘মানবতার বৃহত্তর স্বার্থে এবং সারা বিশ্বে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাপী সাহসী, দৃঢ় ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর যথাযথ দায়িত্ব পালন করা উচিত।’
তৃতীয়ত, ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের ত্রয়ীকার সদস্য হিসেবে তিনি বলেন, ‘জলবায়ুজনিত অভিবাসন মোকাবেলায় অতিরিক্ত অর্থায়নের ব্যবস্থা করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষতি এবং ক্ষয়ক্ষতি তহবিল চালুর জন্য আমি সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসন্ন কপ-২৮ এ আমি সবাইকে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ক্ষতি এবং ক্ষতির জন্য তহবিল বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়ার জন্য অনুরোধ করব।’
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অবশেষে অভিমত ব্যক্ত করেন, ‘সব মানুষেরই উপযুক্ত জীবনযাপনের সমান অধিকার থাকা উচিত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক সম্প্রদায় ভুলবে না এবং তাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা আমাদের পৃথিবীকে বাঁচাতে ও শক্তিশালীকরণে জি-২০ অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি।
‘আমাদের একে অপরের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং আমাদের মাতৃ পৃথিবীর যত্ন নেয়ার জন্য নিজেদেরকে পুনরায় প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।’
২০২২ সালে গঠিত জাতিসংঘ মহাসচিবের গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপের একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শেখ হাসিনা উল্লিখিত সুপারিশগুলো করেছেন।
শীর্ষ সম্মেলনের এই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আমরা এমন একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা চাই যা দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্র্রভাব প্রশমন, সংঘাত প্রতিরোধ এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য প্রযুক্তিগত স্থনান্তরকে অর্থায়নের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
‘শীর্ষ সম্মেলনটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন আমাদের মাতৃ-পৃথিবী জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক সংকট, কভিড-১৯ মহামারি এবং নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চ্যালেঞ্জ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মানবজাতির শান্তি ও উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি অন্য সম্প্রদায়ের গ্রহণ করা অপরিহার্য।’
‘বাস্তবতা হল- মানুষ ও আমাদের মাতৃভূমি কেবল পারস্পরিক সহায়তার মাধ্যমেই টিকে থাকতে পারে।
‘অতএব, আমাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা সবুজ এবং টেকসই উন্নয়নের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এখন আমরা সার্কুলার অর্থনীতির পদ্ধতিও নিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে নগণ্য অবদান রাখলেও এর পরিণতির শিকার হিসেবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
‘বিশ্বব্যাংকের গ্রাউন্ডসওয়েল রিপোর্ট-২০২১ অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ২০৫০ সালের মধ্যে ১৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষকে তাদের স্বাভাবিক আবাসস্থল থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। যদিও বাংলাদেশের প্রশমনের সুযোগ কম। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন এবং এসডিজি অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জলবায়ু পরিবর্তনের বিপজ্জনক প্রভাব মোকাবেলায় অনেক রূপান্তরমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৯৭ সালে আমি গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ বা আশ্রয় নামে একটি প্রকল্প শুরু করি। এই উদ্যোগের অধীনে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে বিনামূল্যে বাড়ি ও জমি দিয়ে পুনর্বাসন করেছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশকে গৃহহীন ও ভূমিহীন মুক্ত করা।’
বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রোল মডেল হিসেবে পরিচিত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা দুর্যোগ প্রস্তুতি ও জলবায়ু অভিযোজনে শক্তিশালী অবস্থান অর্জন করেছি।
“দুর্যোগ মেকাবিলায় সরকার ৪ হাজার ৫৩০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এছাড়া বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য ‘মুজিব কিল্লা’ নামে আরও ৫৫০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য আমরা ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ চালু করেছি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমার সরকার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য ও সমৃদ্ধ ব-দ্বীপ গড়ে তোলার লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ প্রণয়ন করেছে।
“২০২২ সালে সরকার জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা চালু করেছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২৩০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এ বিষয়ে সক্রিয় সমর্থন দিতে আমরা উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই।”
