মহেশখালীকে আগামীর সিঙ্গাপুর বা সাংহাইয়ের মতো গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত :

মহেশখালীকে আগামীর সিঙ্গাপুর বা সাংহাইয়ের মতো গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত : ৩০ বছরের পরিকল্পনার ভিত্তি ও বাস্তবতা কি? পিটার হাসের কক্সবাজার সফরকালে মহেশখালীর উন্নয়ন! নাকি রাজনৈতিক ফুলঝুরি?
আমি চট্টগ্রামে জন্ম এবং মহেশখালীতে কিছুদিন কাটানোর সুবাদে সরকারের এই সিদ্ধান্ত দেখে খুশি হতে পারতাম কিন্তু কঠিন বাস্তব কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজেকে কিছুটা দমন করতে বাধ্য হচ্ছি।
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি চট্টগ্রাম বন্দরনগরী এবং দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে এইসব মিথ ও বাস্তবতা রাজনৈতিক বুলি ছাড়া আজ পর্যন্ত তেমন কোনো উন্নয়ন দেখিনি। বন্দরের সুবিধা দেশ নিচ্ছে কিন্তু বন্দরের উন্নয়নে আমাদের সক্ষমতা এখনও মানসম্মত নয়। আমরা বৈদেশিক প্রতিষ্ঠান খুঁজে বেড়াচ্ছি। আর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার অভিযোগ ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য সংবাদ নেই। এটাও একটা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রকল্প মানে দূর্নীতি এবং অপচয়। চট্টগ্রাম শহর প্রতিবছর পানিতে ডুবে যাওয়ার অভ্যাসে পরিণত করেছে এবং বন্দর তার নাব্যতা হারিয়ে তার প্রাকৃতিক সক্ষমতা হারাচ্ছে। এইসবের বাইরে, গত পঞ্চাশ বছরে রেল সহ বহু প্রতিষ্ঠানের প্রধান অফিস চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে। আমাদের পঞ্চবার্ষিকী বা দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় চট্টগ্রাম ও বন্দরের জন্য তেমন কোনো পরিকল্পনা ও বাজেট নেই। ঢাকা রাজধানী হিসেবে সব উন্নয়ন খেয়ে ফেলছে।
এই ধরনের পরিস্থিতিতে মহেশখালী ভবিষ্যতের সিঙ্গাপুর বা সাংহাইয়ের মতো নগররাষ্ট্রে পরিণত হবে তা তেমন আশা জাগায় না। তবে সরকার বলছে, সমুদ্রকেন্দ্রীক শিল্পায়ন, গভীর সমুদ্র বন্দর, জ্বালানি কেন্দ্র, মৎস আহরণ কেন্দ্র এবং এখানে আধুনিক টাউনশিপ গড়ে তোলা হবে। এই সংবাদটা জানিয়েছেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান।।
প্রধান উপদেষ্টা বলছেন, মহেশখালী হয়ে সমুদ্র হবে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান সড়ক। এটা হবে সমুদ্রকেন্দ্রীক ব্লু বা নীল অর্থনীতির ভবিষ্যত।
এটা সকলেই জানেন সিঙ্গাপুর – একটা নগররাষ্ট্র। বড় সামুদ্রিক বন্দর বা হাব। ষাটের দশকে এই দ্বীপরাষ্ট্রটি স্বাধীন হয়ে শুধু একটা রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণে এগিয়েছে। এই দ্বীপ একটা বহুজাতিক এবং বহু ধর্মের সংমিশ্রণে গঠিত। এই রাষ্ট্রে বাংলাদেশের মতো ওয়েস্ট মিনিস্টার ধাঁচের গনতন্ত্র নেই। অন্যদিকে বৌদ্ধ, হিন্দু মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আইনের অধীনে সিঙ্গাপুরিয়ান হিসেবে পরিচিত। এই দ্বীপ মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে বৈশ্বিক পুঁজি আকৃষ্ট করেছে এবং এই আন্তর্জাতিক পুঁজিই সিঙ্গাপুরকে টাউনশিপের মডেল বানিয়েছে। তারপাশের মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ সীমান্ত পরিবেশে তারা আছে। সাংহাইয়ের কথা একটা আলাদা। এটি বিকশিত হয়েছে চীনের খোলা দুনিয়ায় নীতির ফলাফল হিসেবে।
এবার আসি মহেশখালীর কথায়। মহেশখালীর ভৌগোলিক অবস্থান হলো, মাতারবাড়ী, ধলঘাটা ও সোনাদিয়ার মতো ছোট ছোট দ্বীপ। মাতারবাড়ীতে কয়েক বছর ধরে গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি হচ্ছে, এলএমজি টার্মিনাল ও কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে।
মহেশখালী এখন জাপান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নজরে আছে। আছে ভারতেরও নজরে। জাপান এখানে বিনিয়োগ করছে ভারতের সাত রাজ্যের দিকে চোখ রেখে। মহেশখালীর প্রধান অর্থনৈতিক কাজ হলো, লবণ, পান এবং মৎস্য আহরণ। শিক্ষা ও উন্নয়ন তেমন নেই। এখানে টাউনশিপ গড়ে তুলতে স্থানীয় অধিবাসীদের একপ্রকার উচ্ছেদ করতে হবে, জমি অধিগ্রহণের নামে।
মহেশখালীর উন্নয়ন, বাংলাদেশেরও উন্নয়ন। ঘোষণা দেওয়া হয়েছে , একটা মহেশখালী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। কিন্তু আমারা জানি, বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক উন্নয়ন মডেল রাজনৈতিক দূর্নীতির পথ প্রশস্ত করে মাত্র। ফলে এখানে, মহেশখালীতে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে ভূঅর্থনীতির স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বার্থে তেমন নয়।
আর নীল অর্থনীতি মানে শুধু মৎস্য আহরণ নয়, সামুদ্রিক খনিজ সম্পদও। এই খনিজ সম্পদে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের চোখ। ফলে বিডার আশা কার স্বার্থে যাবে তা বোঝা তেমন কঠিন কিছু নয়।
মহেশখালীর উন্নয়ন, মহেশখালীর সমৃদ্ধি – আমার একান্ত কাম্য। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় আমলাতান্ত্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা সমৃদ্ধির তেমন কোনো সুষম বৃদ্ধি করে না।
চট্টগ্রাম বন্দর, বাণিজ্যিক রাজধানী, মহেশখালী মহেশখালীর মতোই উন্নয়নে এগিয়ে যাক, সিঙ্গাপুর বা সাংহাইয়ের মতো নয়। সে বাস্তবতা বাংলাদেশের নেই।
লেখক- শরীফ শামশির
লেখক ও গবেষক