শরীফ শমসির
আজ বাইশে শ্রাবন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮৪ তম মৃত্যু দিবস। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট মৃত্যু বরণ করেন তিনি। কিন্তু বাইশে শ্রাবন তাঁকে স্মরণ করা হয়। এই কয়েকটি ক্ষেত্রে বাংলা মাসের তারিখ চালু আছে।
বৃষ্টিস্নাত দিনে তিনি চলে গিয়েছিলেন। বেশ পরিণত বয়সে।
মৃত্যু নিয়ে তাঁর তেমন উদ্বেগ ছিল না। অপারেশনের জন্য শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসার সময় তিনি অনুভব করেছিলেন, আর নাও ফিরতে পারেন। তাঁর চোখে তাই জল এসেছিল। মৃত্যুর জন্য নয়; শান্তিনিকেতনে আর ফিরবেন না, এই বেদনাবোধের কারণে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কলকাতায় তিনি অপারেশনের পর বেশ হাস্যরসে কাটাতেন। নাতনির সাথে মজা করতেন এবং লেখার নিয়ম মেনে লেখার চেষ্টা করতেন। ছড়া কাটার ছলে দার্শনিকতা করতেন। তারপর চলে গেলেন।
তিনি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁকে নিয়ে বেশ কথা হবে ; বাঙালি অতিরিক্ত ভাব দেখাবে – এটা স্বাভাবিক ছিল। কারণ তিনি বাঙালির চেয়েও বাংলার প্রকৃতির সাথে মিশে ছিলেন। জমিদারি তদারকির জন্য পূর্ব বাংলায় বিশেষ করে পতিসর, শিলাইদহ ইত্যাদি জায়গায় আসতেন। ছোটগল্প বা গীতাঞ্জলির পরতে পরতে তার প্রমাণ আছে। সোনার তরী, সোনার বাংলা ইত্যাদি তিনি পূর্ব বাংলার প্রকৃতির রুপ থেকে পেয়েছেন।
পূর্ব বাংলাকে তিনি বেশ ধারণ করতেন। ভালোবাসতেন। কিন্তু জমিদার ছিলেন, জমিদাররা তেমন আদৃত হন না। ছিলেন ব্রাহ্ম্য, প্রজারা সব মুসলিম নয়তো নমঃশুদ্র। ফলে, শ্রেণির একটা ফারাক ছিল। এই ফারাকটা কবি ব্যক্তিজীবনে কতটুকু কমাতে পেরেছেন – সেসব প্রশ্ন সমালোচকগণ করেছেন । তারপর পূর্ব বাংলা একসময় পাকিস্তান হয়ে গেলে তাঁর প্রতি বৈরী বা সমালোচকের সংখ্যা বাড়লো। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে তাঁকে একপ্রকার নিষিদ্ধ করা হলো। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন্দ্রনাথ আবার পূর্ব বাংলার মানুষের কাছে সমাদৃত হলেন। তাঁর গান বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা পেলো।কিন্তু তাঁর সমালোচনা কমেনি। তাঁর চর্চা যেমন হয়েছে তেমনি তাঁর পর্যালোচনাও হয়েছে। কিন্তু জাতিরাষ্ট্রের বিকাশের পর্যায়ে যাঁর সমাদর হয়, কালে কালে তার অনাদরও হয়। কারণ, জাতিরাষ্ট্রে রাজনীতি প্রবল থাকে। এতে করে বিচার বিশ্লেষণ বেড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষেত্রে তা একটু বেশি হলো।
পশ্চিম বঙ্গেও রবীন্দ্রনাথ বেশ পূজিত মনে হলেও তাঁর চর্চা তেমন বেড়েছে বলা যাবে না। সেখানেও তাঁর শান্তিনিকেতন বদলে গেছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু কামনা করার লোকের সংখ্যা বেড়েছে। কারণ তিনি মৃত হলেও তাঁর সঙ্গীত জাতীয়ভাবে গাওয়া হয়। এই সঙ্গীত জাতীয়ভাবে যাতে গাইতে না হয় তার নানান যুক্তি এখন সরগরম। ফলে তাঁর সঙ্গীত যদি জাতীয়ভাবে গাওয়া বন্ধ করা যায় তারজন্য তাঁর মৃত্যু কামনা শ্রেয়। এই মৃত্যু কামনা, তাঁর সাংস্কৃতিক মৃত্যু কামনা।
রবীন্দ্রনাথ সমালোচনার উর্ধ্বে নন; কিন্তু এই রকম সৃষ্টিশীল বাঙালি কয়জনই বা আছে!
তাঁর মৃত্যুর ৮৪ বছর পরেও এই সমালোচনার মধ্যে যে তিনি আছেন – তাতেই মনে হয় – তিনি এখনো বাংলাদেশে স্মরণে আছেন।