বৃহস্পতিবার,২৫,এপ্রিল,২০২৪
39 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়রাষ্ট্রের চার মূলনীতি: বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের মর্মকথা

রাষ্ট্রের চার মূলনীতি: বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের মর্মকথা

।। ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ।।

(শেষ পর্ব)

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

সমাজতন্ত্র:
’৭২-এর সংবিধানের ১০ ধারায় বলা হলো, “মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।” ’৭২-এর ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে বিস্তৃত পরিসরে তার সমাজতন্ত্র ব্যাখ্যা করে বলেন, “আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। . . . . সমাজতন্ত্র গাছের ফল না – অমনি চেখে যাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। . . . . আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ, এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূলকথা হল শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কী climate, কী ধরনের অবস্থা, কী ধরনের মনোভাব, কী ধরনের আর্থিক অবস্থা, সব কিছু বিবেচনা করে step by step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে। রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করে নাই . . রাশিয়ার পার্শ্বে বাস করেও যুগোশ্লভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে সমাজতন্ত্রের অন্য পথে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান-ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, আবার মিশর অন্য দিকে চলেছে। বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনোদিন সমাজতন্ত্র হয় না, তা যারা করেছেন, তারা কোনোদিন সমাজতন্ত্র করতে পারেন নাই। কারণ, লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র হয় না — যেমন আন্দোলন হয় না। সেজন্য দেশের environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সব কিছু দেখে step by step এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না। একই ভাষণে তিনি বলছিলেন, “. . শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, classless society প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”
উপরোক্ত দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র ভাবনা স্বব্যাখ্যাত এবং যা এত স্পষ্ট যে, অবোধ্য/দুর্বোধ্য কিছু নেই। তবে বক্তব্যটির সারাৎসার অনুধাবন করার লক্ষ্যে কিছু চুম্বক মন্তব্য প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর বিবেচনায় সমাজতন্ত্র মানে ছিল শোষণহীন সমাজ। সামগ্রীক বিবেচনায় বলতে হয়, সমাজতন্ত্রের চেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা আর হয় না। তিনি এক সময়ে বলেছিলেন, “আমি কমিউনিস্ট নই, কিন্তু সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। পুঁজিবাদ শোষণের হাতিয়ার।” সে কারণে আলজিয়ার্স জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, “বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত — শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।” বিশ্বব্যবস্থার যথার্থ মূল্যায়ন ছিল এমন একটি মন্তব্যে। যা সনাতনী পুঁজিবাদের প্রতি একটি চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত, তাত্ত্বিকতা ও তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি যে বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে যায় না, সে সম্পর্কে মাঠ – ঘাটের রাজনীতিক বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতাসঞ্জাত উপলবদ্ধ সত্য ছিল। সে কারণে বাম নেতাদের (যাদের প্রতি তার অপরিসীম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ছিল) সতর্ক করে অসমাপ্ত আতœজীবনী-তে লিখেছেন, “জনসাধারণ চলছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত।” (পৃ. ১০৯) বলা বাহুল্য, বঙ্গবন্ধু লোকানূবর্তী (লোকরঞ্জক নয়) রাজনীতির কথা বলেছেন; আর আমজনতার হজমযোগ্য সমাজতন্ত্র হিসেবে শোষণ মুক্তির কথা বলেছেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে ‘সমাজতন্ত্র’ উড়িয়ে দিয়েছিলেন; ২০১১-তে ১৫তম সংশোধনীতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে সমাজতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সমাজতন্ত্র এখন যেন কাজীর গরু; খাতায় আছে, গোয়ালে নাই — সংবিধান আছে, বাস্তবে নাই। বাংলাদেশ এখন পূর্ণ পুঁজিবাদী দেশ। তাজউদ্দীনের বাজেটে দর্শন ছিল; তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বাজেট দর্শনহীন আমলাতান্ত্রিক আয়-ব্যয়ের হিসাব মাত্র। ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী হলে এমন পরিস্থিতি অনিবার্য। কাজেই সাংবিধানিক সমাজতন্ত্র বাস্তবের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা তা বিবেচ্য। তৃতীয়ত, বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রকে দীর্ঘ ও নিরন্তর প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা ইতিহাসের সত্য। লেনিন ১৯১৭-তে war communism চালু করে ১৯২১-এ New Economic Policy তৈরি করে কৌশলগত পশ্চাদপসরণ করেছিলেন; চালু হয়েছিল মিশ্র অর্থনীতি। ১৯২৮ পর্যন্ত চালু থাকা নতুন নীতি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। আর সে বছরই সমাজতন্ত্রের পথে ফেরা সম্ভব হয়েছিল। চতুর্থত, বঙ্গবন্ধু দেশীয় ঐতিহ্য-পরিস্থিতির সঙ্গে যায় এমন সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন; যেমন জুলিয়াস নাইয়েরেরী ১৯৬৭-র ফেব্রুয়ারি ‘আরুশা ঘোষণা’র মাধ্যমে ‘আফ্রিকীয় সমাজতন্ত্রের’ পথপ্রদর্শক হয়েছিলেন। পঞ্চমত, লেনিনের মতো বঙ্গবন্ধুও বিলম্বিত বোধোদয়ের কারণে বাংলাদেশের গতিমুখ ফিরিয়ে বাকশাল ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতে, যা ছিল সাময়িক এবং অনাকাক্সিক্ষত। New Economic Policy-ও ছিল সাময়িক এবং অনাকাক্সিক্ষত; কিন্তু যা পরিণতি পেয়েছিল বলে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব হয়েছিল। অপরদিকে বাকশালের প্রবক্তা ও পদ্ধতি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনার ফলে ছিল ক্ষণস্থায়ী। কাজেই বাকশাল নিয়ে চূড়ান্ত মন্তব্য অসম্ভব। বঙ্গবন্ধু বাকশালকে দ্বিতীয় বিপ্লব বলেছিলেন; অর্থাৎ ’৭১ কে প্রথম বিপ্লব ধরে নিয়ে। কিন্তু সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ’৭১ বিপ্লব ছিল না; তবে বাকশাল বাংলাদেশকে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতবাহী ছিল। বাকশাল সমাজতান্ত্রিক ছিল কিনা তা নিয়ে বিস্তর তাত্ত্বিক আলোচনার অবকাশ আছে। তবে এটা ঠিক যে, বাকশাল কোনো দল ছিল না; ছিল পরিস্থিতির প্রয়োজনে একটি অভিন্ন জাতীয় মঞ্চ।
গণতন্ত্র:
সংবিধানের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।” ’৭২-এর ৪ নভেম্বর, বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চরিত্র সম্পর্কে বলেন আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের ধারণা . . গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে দেখা যায় সেসব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না।
আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হল, আমার দেশে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে যেসব provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দু:খী মানুষ protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে-ঐ শোষকরা যাতে protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে।” গণতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সে সম্পর্কে মন্তব্য প্রাসঙ্গিক। এক, সংজ্ঞার্থ অনুযায়ী গণতন্ত্র শোষিতের গণতন্ত্র। অর্থাৎ শোষকদের জন্য গণতন্ত্র থাকবে না। দুই, গণতন্ত্রের এমন সংজ্ঞা প্রচলিত সংজ্ঞার ব্যতিক্রম, যা বাংলাদেশের পরিবেশ-পরিস্থিতির উপযোগী–বাংলাদেশের নিজস্ব গণতন্ত্র। বাংলাদেশের নিজস্ব সমাজতন্ত্রের মতো গণতন্ত্রও নিজস্ব, যা স্বাভাবিক ও বাস্তবানুগ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় প্রচেষ্টা জারি থাকা সত্ত্বেও এমন গণতন্ত্র দৃশ্যমান হয় নি। পাকিস্তানি আমলের প্রশাসন-কাঠামো ও ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে এমন গণতন্ত্র পাওয়া সম্ভব ছিল না; ফিদেল ক্যাস্ত্রো এ ব্যাপারে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। সে জন্যই বাকশাল করে বঙ্গবন্ধু শোষিতের গণতন্ত্র করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তা তো যে নদী মরু পথে হারালো ধারা। অবশ্য পদ্ধতি হিসেবে বাকশাল অগণতান্ত্রিক ছিল, সে কথা বঙ্গবন্ধু নিজেও স্বীকার করেছিলেন এবং বলেছিলেন অনেককে। এটাও বলেছিলেন যে, পদ্ধতিটি সাময়িক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ’৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবৈধ সামরিক স্বৈরাচার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে উধাও করে দিয়েছিল; চলেছিল পাকিস্তানিকরণ ও রাজাকারায়ণ প্রক্রিয়া (যা বিস্তৃত হয়েছিল ’৯১-’৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত, যদিও তা ছিল নির্বাচিত)। ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থান ও তিনজোটের রূপরেখা সত্ত্বেও বাংলাদেশ গণতন্ত্র আস্বাদন করেছে বলে মনে হয় না। গণতন্ত্রের নামে যা দৃশ্যমান তাকে democracy না বলে বলা উচিত demosclerosis; যা demosclerosis+sclerosis। Sclerosis একটি রোগের নাম, যাতে শরীরের ধমনী শীর্ণ হয়ে যায়, রক্ত সঞ্চালন ঠিক মতো হয় না। ফলে মানুষ নির্জীব হয়ে যায়, সচল-সক্রিয় থাকতে পারে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের দশা তো এমনই। গনতন্ত্রের প্রতি ঐকান্তিক অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল; ’৭২-র সংবিধান দিয়ে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার শুভ সূচনাও হয়েছিল। অভিযাত্রা শেষ করার আগেই গণতন্ত্র পথ হারালো। গণতন্ত্র তো এখন মায়ামৃগ-দেখা যায়, ধরা যায় না।
ধর্মনিরপেক্ষতা:
সংবিধানের ১২ ধারার শিরোনাম বেশ কৌতুহলোদ্দীপক: “ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা।” এ ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য চারটি নির্দেশ করা আছে; যেমন ক. সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার , ঘ. কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে। ’৭২-এর সংবিধানের ৩৮ ধারায় ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান ১২ ধারায় ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছিলেন, “মহান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস”; এবং সংবিধানের শুরুতে যোগ করেছিলেন, “বিসমিল্লহির রহমানির রাহিম।” অন্যদিকে ৩৮ ধারা বিলোপ করে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর পুনরুত্থানের সুযোগ করে দিলেন। অর্থাৎ তিনি সংবিধান ও রাজনীতির ইসলামিকরণ প্রক্রিয়ার সূচনা করেন, যা তুঙ্গে নিয়ে যান এরশাদ ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করে। জিয়া এবং এরশাদ দুজনেই অবৈধ সামরিক স্বৈরশাসক। এমন শাসকের ধর্মনির্ভরতা লক্ষণীয়। এখন ৩৮ ধারায় আছে আপসমূলক ভাষা: “জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।” এ ধারার ভাষা বলে দেয়, কেন প্রগতিশীলদের দাবি সত্ত্বেও জামায়াত নিষিদ্ধ হয় না। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষতা দারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ রাষ্ট্রধর্ম আর ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে থাকায় সংবিধান জগাখিচুড়ি। তেলে-জলে মেলানোর ব্যর্থ প্রয়াস। ২ক ধারায় বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্রে সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করিবেন।” কোনো বিশেষ ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দিলে অন্য ধর্মের নাগরিক দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়, যা বঙ্গবন্ধু ও সংবিধান পরিপন্থী, এবং যা রাষ্ট্রের ধর্মীয় ভিত্তি ও রাজনীতির ধর্মীয়করণ নির্দেশ করে। উল্লেখ্য, ‘রাষ্ট্রধর্ম’ শব্দবন্ধটি অশুদ্ধ। রাষ্ট্র একটি বিমূর্ত ধারণা; বিমূর্ত যা কিছু তার ধর্ম থাকতে পারে না। যদি করতেই হয় তাহলে হবে ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম; ইংরেজিতে religion of state, not state religion. যাহোক তথাকথিত রাষ্ট্রধর্ম পাঁচটি কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। এক, সংবিধানের ১২ (খ) ধারার পরিপন্থী। দুই, বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারি ’৭২-এর ভাষণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ তিনি তো বলেছিলেন, রাষ্ট্র কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রধর্ম থাকলে রাষ্ট্র অবধারিতভাবে ধর্মভিত্তিক হয়ে যায়। তিন, বিধানটি বঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শের পরিপন্থী। চার, রাষ্ট্রধর্ম গণতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রে ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। পাঁচ, রাষ্ট্রধর্মের বিধান ইসলামে নেই; থাকলে নবীজী মদীনায় (৬২২-৩২) তা করতেন। বরং কোরানে বলা হয়েছে লাকুম দ্বীনুকুম ওয়াল ইয়া দ্বীন- তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে।
এবার আসা যাক ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ধারণার কথায়। ’৭২-এর ৪ নভেম্বর তিনি গণপরিষদে বললেন, “. . ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। . . . . আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। . . . . ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।।” বোধগম্য, বঙ্গবন্ধু দুটো বিষয়ে পরিষ্কার ছিলেন। এক ধর্মীয় বহুত্ব ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। দুই, রাজনীতিবিযুক্ত ব্যক্তিগত ধর্মাচারণ। অবশ্য ধর্মের রাজনীতি এখন বাংলাদেশে চলমান, যার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংশ্রব দৃশ্যমান বাস্তবতা। তবে মনে হয়, পশ্চিমের বিভ্রান্তির শব্দ ‘সেক্যুলারিজম’ ব্যবহার না করে সরাসরি ‘ধর্মীয় সহিষ্ণুতা” ব্যবহার করা উচিত ছিল; বঙ্গবন্ধুও তা বুঝিয়েছিলেন, এবং যা বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সাযূজ্যপূর্ণ হতো। উপরন্তু ‘সেক্যুলারিজমের’ বাংলা ধর্মনিরপেক্ষতা নয়। সংবিধানে বাংলা-ইংরেজি অসঙ্গতি প্রচুর আছে।
সমাপণী বক্তব্যে বলতে চাই, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও রাষ্ট্রভাবনার মর্মশাঁস চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে বিধৃত। চার মূলনীতির কোনোটিই প্রাচ্যের ঐতিহ্য নয়, যা আমরা আহরণ করেছি পাশ্চাত্য থেকে উপনিবেশবাদের সুবাদে; কিন্তু বঙ্গবন্ধু যার দেশীয়করণ (homogenization) করেছিলেন, এবং যার মাধ্যমে তৃতীয় দুনিয়ায় স্বীয়তার (autonomy) প্রবক্তা হিসেবে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি এ চার নীতি অনুসরণ ও বাস্তবায়নের পথ তৈরি করেছিলেন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে, যা তার অনবদ্য কীর্তি। কিন্তু সে সংবিধান এখন ক্ষত-বিক্ষত; আমরাও তার দেখানো পথ হারিয়েছি। চার মূলনীতি যেন হারানো দিনের হারানো সুর। শেষ করি জন সি. ম্যাক্সওয়েল-এর কথা দিয়ে। “তিনি নেতা যিনি পথ চেনেন, সে পথ পরিক্রমা করেন এবং পথ দেখান।” আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে আদর্শিকভাবে তো চলছি না । প্রাসঙ্গিক কবি শামসুর রাহমান -“উদ্ভট এক উঁটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।”

লেখক: বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্স।

সর্বশেষ