বৃহস্পতিবার,২৮,মার্চ,২০২৪
28 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের সঙ্কটকালে

কমরেড অমল সেনের শিক্ষা পথনির্দেশক

। অধ্যাপক ড. সুশান্ত দাস।।

১৭ জানুয়ারী, ২০২১ কমরেড অমল সেনের ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২০ সাল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন প্রতিষ্ঠার শতর্বষ পার করেছে। এই ২০২০ সাল থেকেই বিশ্ব সভ্যতা অতিক্রম করছে কোভিড-১৯ নামের ভাইরাস সৃষ্ট এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। এই বিপর্যয়ের মুখে মানুষ আবার নতুন করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার এক মূর্তিমান চিত্র দেখছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত পুঁজিবাদী বিশ্বের সর্বাধুনিক ও উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার দুরবস্থা দেখছে গোটা বিশ্ব। দেখছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত গণতন্ত্রের সঙ্কট। পাশাপাশি স্বল্পোন্নত অথচ মানবিক মূল্যবোধের মৌলিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ সমাজতন্ত্রমুখী দেশ কিউবা, ভিয়েতনাম, চীনের এই বিপর্যয়রোধে সাফল্য নয় শুধু, বিপন্ন মানুষের পাশের দাঁড়ানোর সমাজতান্ত্রিক ভাবমানসের জলজ্যান্ত উদাহরণ। এই প্রেক্ষাপটে কমরেড অমল সেনের শিক্ষা মার্কসবাদ-লেনিনবাদ আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। মানুষের সামনে আজ নতুন করে জিজ্ঞাসা দানা বাঁধছে-পুঁজিবাদ না তার বিকল্প কোন পথে মানব সভ্যতা টিকে থাকবে?
আজ থেকে একশত সাত বছর আগে, ১৯১৪ সালের ১৯ জুলাই কমরেড অমল সেনের জন্ম যশোর জেলার আফরা গ্রামে এক জমিদার পরিবারে। প্রায় শতাব্দিকাল এই ভূখ-ে কৃষক আন্দোলন আর কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সার্বিক ভূমিকা রাখার পটভূমিতেই এ দেশের মানুষ তাদের সংগ্রাম আর সঙ্কটে স্মরণ করবে অনাগতকাল ধরে লোকজ সংস্কৃতির আবহে এই এলাকার ভূমিপুত্র কমরেড ‘অমল সেন’কে। হয়ত, কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা তাদের সকল অনৈক্য আর সঙ্কট নিরসনের আকাক্সক্ষা নিয়ে বছরের পর বছর হাজির হবে এই মহান বিপ্লবী মানুষটির স্মৃতিসৌধের বেদীভূমিতে।
তিনি জন্মেছিলেন মানব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে। লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে শ্রমিক শ্রেণী রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠা করে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই বিপ্লবের অভিঘাত, বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে শ্রমজীবি মানুষের মধ্যে তৈরী করে এক যুগান্তকারী চেতনা। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শাসন আর শোষণের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম নতুন গতিবেগ আর দিকনির্দেশনা পায়। তৎকালীন ভারতবর্ষে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের আবহে বেড়ে ওঠা কমরেড অমল সেনও অতি অল্প বয়সেই জড়িয়ে পড়েন বৃটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে এদেশেও। তিনি দ্রুতই আকৃষ্ট হন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের প্রতি। কঠিন সেই প্রেক্ষাপটে তরুণ এক যুবকের পক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অত সহজ ছিল না। এ ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন বিশিষ্ট এবং ব্যতিক্রম। তিনি সামন্ত পরিবারের আবহ অগ্রাহ্য করে, জায়গা করে নেন নড়াইলের বাকড়ির গরিব কৃষকের কুঁড়েঘরে। গড়ে তোলেন যশোর নড়াইল অঞ্চলের ঐতিহাসিক তেভাগা কৃষক আন্দোলন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের আবহে এই কৃষক সংগ্রাম এক নতুন মাত্রা যোগ করে। বৃটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে শ্রমজীবি তথা কৃষকসমাজের ভূমিকার ঐতিহাসিক অবস্থান নির্ধারিত হয়ে যায়। বাংলার এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই কৃষক আন্দোলনে কৃষকদের রয়েছে অনেক বীরোচিত ভূমিকা, কিন্তু তা সত্বেও কমরেড অমল সেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা যশোর নড়াইল এলাকার এই আন্দোলন সাফল্য, চেতনা আর সংগঠনের দিক দিয়ে এক অনন্য অবদান রেখেছিল, যার ধারাবাহিকতায় শুধু ঐ অঞ্চলে নয়, গোটা বাংলাদেশের ভূ-খ-ে গড়ে ওঠে বিপ্লবী সংগ্রাম আর সংগঠনের দৃঢ় ভিত্তি। পাশাপাশি এই আন্দোলনের দোলাচলে যুগ যুগ ধরে অন্ধকারে পড়ে থাকা মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠে শিক্ষা, সংস্কৃতি আর চেতনার এক নব দিগন্ত। কমরেড অমল সেনের লেখা ’নড়াইলের তে-ভাগা আন্দোলনের সমীক্ষা’ বইটিতে তিনি তার অভূতপূর্ব বিশ্লেষণী দক্ষতায় তা ভবিষ্যতের বিপ্লবীদের পথনির্দেশিকা হিসেবে রেখে গেছেন। বইটি পাঠ্য তাই প্রতিটি বিপ্লবী কর্মীর, সঙ্গে সঙ্গে সকল রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের। এ ক্ষেত্রে তিনি শুধু আমাদের পার্টির পথিকৃত নন, এ দেশের সকল প্রগতিশীল, সমাজসচেতন মানুষের পথিকৃত।
নড়াইলের তেভাগা আন্দোলন স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসে। এ আন্দোলনের রয়েছে সমষ্ঠিগত সাফল্য, পাশাপাশি কি ত্যাগ তিতিক্ষা করতে হয়েছিল এ এলাকার জনগণের সেটাও ইতিহাসের অংশ। কত পরিবার ধ্বংস হয়েছে, কত জেল জুলুম আর নিপীড়ণ সহ্য করতে হয়েছে, তা কি সময়ের সাথে সাথে ভুলে যাবে ভবিষ্যত প্রজন্ম? কমরেড অমল সেনের বৈশিষ্ট ছিল, তিনি সংগ্রামে সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে থাকা নেতা ছিলেন। নির্যাতন, নিপীড়ন আসলে সামনে দাঁড়িয়েই তা সহ্য করেছেন। বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তি যা করতে পারে নি, তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের পর, পাকিস্তান আমলে, বিপ্লবী সংগ্রামীদের জীবনে নেমে আসে সেই নির্যাতন। পাকিস্তানের ২৪ বছরের ১৯ বছরই জেলে কাটিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জেলের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে তাকে সীমাহীন শারীরিক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, যা নাৎসী ’কনসেনট্রেসন’ ক্যাম্পের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ ইতিহাস অনেকেরই জানা নেই। কিন্তু শত নিপীড়ন-নির্যাতনেও অমল সেন দেশত্যাগ করেন নি, বিপ্লবী জীবনও ত্যাগ করেন নি।
ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিটি বাঁকে তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে তৎকালীন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির গৃহীত রনদিভে লাইনের বাম বিচ্যুতি পার্টিকে যে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, তা তিনি কৃষক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক চেতনা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন এবং বিরোধীতা করেছিলেন। ষাটের দশকে যখন বিশ্বব্যাপী চীন-সোভিয়েত কমিউনিস্ট মতাদর্শগত বিতর্ক, দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোকে দ্বন্দ্ব এবং ভাঙনের মুখোমুখি করে, তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিও সে বিতর্ক এড়িয়ে যেতে পারে নি। ফলে পার্টির ভাঙন আর তার ফলাফল এখন ইতিহাস। তিনি গোটা বিষয়টিকে তাত্ত্বিকভাবে মোকাবিলা করেছেন। যা তিনি তার দু’টি ঐতিহাসিক দলিলে লিখেছেন। একটি ‘বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা প্রসঙ্গে’, অন্যটি ‘কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্ক প্রসঙ্গে’। মতাদর্শগত যেকোনো বিতর্কের পরিসমাপ্তি হলো পার্টির ভাঙন। সাংগঠনিকভাবে তিনি সারাজীবন এর বিরোধীতা করেছেন। পার্টির বহুধা বিভক্তিতে তিনি যন্ত্রণাবিদ্ধ হয়েছেন কিন্তু হতাশ হন নি। ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের ভ’মিকাকে সামনে নিয়ে তিনি যেমন রাজনৈতিকভাবে অবস্থান নিয়েছেন, তেমনি তৎকালী পূর্ববাংলার কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ করার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন আজীবন। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে যেমন তরুণ বয়সে জীবনবাজি রেখেছিলেন, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সংগঠক হিসেবে, নেতা হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি শুরু করেছিলেন, তা আমৃত্যু অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি সত্তর, আশি এবং নব্বই-এর দশকের সকল রাজনৈতিক সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা কি হওয়া উচিত, তা যেমন নির্দেশ করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি কমিউনিস্টদের ঐক্যের প্রতিভু হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছেন।
কমিউনিস্ট পার্টি শ্রেণী সংগ্রামের পার্টি। শ্রেণীসংগ্রাম ছাড়া শ্রমজীবি মানুষের নেতা হয়ে ওঠার অন্য কোনো বিকল্প নেই। কোনো দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের আঁকেবাঁকে পার্টিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে হয়, প্রয়োজনও বটে, কিন্তু সে সকল রাজনৈতিক সংগ্রামে শ্রমজীবি মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে, শ্রমজীবি মানুষের শ্রেণীসংগ্রামের মধ্যদিয়ে, তার নিজস্ব বিকল্প শক্তি গড়ে তুলতেই হয়। কমরেড অমল সেন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মকা-ের নির্যাস হিসেবে জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিয়েছেন তার ‘জনগণের বিকল্প শক্তি’ বইতে। সেটা শুধু এদেশের কমিউনিস্টদের পথ নিদের্শক নয়, ধ্রুপদী মার্কসবাদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মৌলিক চিন্তায়-এই বইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শোষকশ্রেণীর রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপরীতে জনগণের নিজস্ব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কিভাবে গড়ে উঠতে পারে তা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্য হিসেবে তা গবেষণার দাবি রাখে।
সাম্রাজ্যবাদের নয়া-উদারীকরণ নীতি শুধু বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আর সামরিক বিপর্যয় এর কারণ হয় নি, ভোগবাদ আর ব্যক্তিসর্বস্ব স্বার্থান্ধতার সাংস্কৃতিক আবহে সমাজজীবন আর নৈতিকতাকে ঠেলে দিয়েছে এক অন্ধকার আবহে। তরুণ যুব সমাজও নিমজ্জিত হচ্ছে এক অন্ধকার হতাশাচ্ছন্ন দিক নিশাহীন আবর্তে। বর্তমান সমাজব্যবস্থার এই সার্বিক অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখা ‘কমিউনিস্ট জীবন ও আচরণ রীতি প্রসঙ্গে’ বইটি শুধু কমিউনিস্টদের নয়, সার্বিকভাবে ব্যক্তি ও সমাজ কল্যাণের আদর্শিক ক্ষেত্রে এক দিক নির্দেশক দর্শনের ভূমিকা পালন করতে পারে।
ইতিহাস তার গতিপথে কিছু মানুষ সৃষ্টি করে, আবার কিছু মানুষ তাদের জীবন দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তাঁরা কিংবদন্তি। কমরেড অমল সেন তেমনি একজন মানুষ, যাঁরা বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে, পথভ্রষ্টদের পথ দেখান। তিনি বিপ্লবী জীবনাদর্শ ও মনুষত্বের প্রতীক।
প্রায়শই এ কথাটি উচ্চারিত হয় যে, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একুশ শতকের চ্যালেঞ্জের নির্দিষ্ট রূপ কি? উত্তর খুবই ব্যাপক এবং সঠিক অর্থে বলতে গেলে এর অনেক কিছুই এখনো মানুষের অজানা। আর এ নিয়ে দ্বিমত বা বহুমত থাকাই স্বাভাবিক। তবুও সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই চ্যালেঞ্জের কয়েকটি দিকের আশু রূপ নির্দিষ্ট করা সম্ভব। এই চ্যালেঞ্জ রয়েছে-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিকাশে, রয়েছে অর্থনৈতিক-সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে, রয়েছে বিশ্বজাগতিক ক্ষেত্রে মানুষের নতুন কোথায়ও পদার্পণের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে। ভৌতবিজ্ঞান আজ উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহন করেছে বলা যায়। তবুও সেক্ষেত্রেও রয়েছে বড় বড় চ্যালেঞ্জ। পদার্থবিজ্ঞানে মহাজাগতিক ও মৌল বলসমূহের একীভূতকরণ, রসায়ন, প্রাণ-রসায়ন, জিনপ্রযুক্তির বহু অজানা প্রশ্ন, কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তির বাস্তবায়ন, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্যান্সার বা এইড্স এবং এই মুহূর্তের করোনার মত ভাইরাস সৃষ্ট ঘাতক ব্যাধির মোকাবেলা-সবই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আরো বড়। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত কাঠামোগত সমস্যা আজ আরো দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। অর্থনীতির বৈশ্বীকরণ-অতি কেন্দ্রীকরণ ও বৈষম্য সমস্যাকে আরো ঘনীভূত করে তুলেছে। ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগত উল্লম্ফন একদিকে যেমন উৎপাদন শক্তি বৃদ্ধির দ্বার উন্মোচন করছে, তেমনি তা বিদ্যমান উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে শ্রমজীবি মানুষের বেকারত্বের হাতছানি দিচ্ছে। এই সঙ্কটের সমাধানের রাস্তা কি? অমল সেন শিখিয়েছেন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য মার্কসের মতাদর্শ, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনার সৃজনশীল প্রয়োগ প্রয়োজন। আর তাই আমাদের মত দেশের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় মার্কসবাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাত্র হিসেবে কমরেড অমল সেন তাঁর যে প্রয়োগলব্ধ জ্ঞান আমাদের জন্য রেখে গেছেন, তা আমাদের নতুন প্রজন্মকে আত্মস্থ করতে হবে, প্রয়োগে নিতে হবে, অনুশীলনে নিতে হবে। সৃষ্টিশীল এই প্রয়াসই অমল সেনের কাছ থেকে বড় শিক্ষা। এই সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবী পথই একমাত্র পথ। ইতিহাসের জটিল পথপরিক্রমায় আমরা আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে সামনে এগোনোই আমাদের একমাত্র রাস্তা। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্কট, বিশ্বব্যাপী সা¤্রাজ্যবাদের লগ্নীপুঁজির আগ্রাসন, নয়া-উদারনীতিবাদের রশাষণ, বিশ্বায়ন, গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে চরম সাম্পদায়িক শক্তির উত্থান, শ্রমজীবি ও গণতান্ত্রিক শক্তির বিভক্তি ও বিভ্রান্তি, কমিউনিস্ট ও প্রগতিশীল শক্তির বিভাজন ও হতাশা-এই সব সঙ্কটকে মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কমরেড অমল সেন তাঁর জীবদ্দশায় এর প্রতিটি সংগ্রামে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাত্ত্বিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তার মৃত্যুর পর আমরা নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে সামনে চলছি। তার রেখে যাওয়া তাত্ত্বিক লেখা জনগণের বিকল্প শক্তি গড়ে তোলা এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক অমূল্য শিক্ষা। তার দেখানো পথকে সামনে রেখে ইতিহাসের এই দায়কে কাঁধে নিতে হবে এই প্রজন্মকেই।

লেখকঃ পলিটব্যুরোর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

সর্বশেষ