বৃহস্পতিবার,২৫,ডিসেম্বর,২০২৫
14 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ২৫, ২০২৫
প্রচ্ছদসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়আইসিইউতে জনতার স্বপ্ন

আইসিইউতে জনতার স্বপ্ন

॥ নতুন কথা ভাষ্য ॥

মুক্তিযুদ্ধ থেকে জুলাই আন্দোলন-অধরা জনতার স্বপ্ন। বরং আমজনতার স্বপ্নজয়ের লড়াইকে পুঁজি করে ক্ষমতা-অর্থের পাহাড় গড়ছে পুঁজিবাদী অপশক্তি। দ্বিধা-বিভক্ত গণমানুষের লড়াইয়ের সাথী বামপন্থীরা। লড়াইয়ের ইতিহাসে তাদের অন্যন্য অবদান রয়েছে, অর্জনও কম নয়। কিন্তু বিভক্তি আর ভাঙনের খেলায় বামপন্থীরা ফসল তুলে দিয়েছে জাতীয়তাবাদীদের ঘরে। ৫৪ বছরের এ খেলার সুযোগে নিউ লিবারেল ইকোনোমি জেঁকে বসেছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। মুক্তবাজার অর্থনীতির ঘেরাটোপে দুর্নীতি-বৈষম্য আজ পাহাড়সম। ফলে বার বার পুঁজিবাদের তাবেদার জাতীয়তাবাদী শক্তি শাসক বদলের লড়াইয়ে জনগণকে ব্যবহার করছে হীনস্বার্থের ত্রুপের তাস হিসেবে। অন্যদিকে ধর্মীয় অনুভূতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শাসকগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় ফুলে ফেঁপে মসনদের স্বপ্নে ব্যাকুল সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী অপশক্তি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এই ত্রিমুখী দোলাচলে ভূ-রাজনীতির আধিপত্য বিস্তারে সাম্রাজ্যবাদী বাজপাখীদের থাবার আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশ। লণ্ডভণ্ড দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি। ভূলুণ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা। সামগ্রীক বাস্তবতায় পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের এদেশীয় সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠীর ভয়াল থাবায় পরাস্ত জনতার স্বপ্ন এখন আইসিইউতে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের আস্থাহীনতায় জনতার মুক্তি আজ দিশাহীন।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালির সামগ্রীক মুক্তির সর্বজনীন জনযুদ্ধ। চার মূলনীতির ভিত্তিতে সংগঠিত সে যুদ্ধে কেউ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসী পরিচয়ে নয়, জানবাজি লড়াইয়ে নেমেছিল চিরায়ত বাঙালি জাতিসত্ত্বার পরিচয়ে। লাখো শহিদের রক্তস্নাত সে লড়াইয়ে বিজয়ও হয়েছে। তবে স্বপ্নজয়ের সে বিজয়মকুট জনতার মাথায় নয়, ৫৪ বছর ধরে লুটেরা-পুঁজিবাদীদের মাথা’তেই আছে। মাঝে মাঝে কেবল সে মাথা বদল হয়। সেই বদলের লড়াইয়েও বলি হন হতভাগ্য সাধারণ মানুষ।

মুক্তিযুদ্ধের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় মুখ থুবড়ে পড়ে বাঙালির মুক্তির স্বপ্নযাত্রা। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যা কোনো ব্যক্তি মুজিব নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভিত্তিক রাজনীতির কবর রচনার সূদুর প্রসারি নীলনক্সা। যে নক্সায় দেশ চলে মুক্তিযুদ্ধের উল্টোযাত্রায়। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে গণমানুষের স্বপ্নযাত্রার সারথি লাল ঝাণ্ডার কাণ্ডরিরাই প্রথম প্রতিবাদের ঝড় তুলে। ’৯০-এর গণঅভ্যূত্থানে এদেশের মানুষ গণতন্ত্র মুক্তির সাথে সাথে আবার ক্ষুধা, দারিদ্র ও বৈষম্যমুক্ত সমতাভিত্তিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। স্বপ্ন দেখে ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের। কিন্তু কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও নিউলিবারেল ইকোনোমির খপ্পরে ক্ষমতাসীনরা তিনজোটের রূপরেখা ভুলে সীমাহীন দুর্নীতি-লুটপাট, চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, স্বজনপ্রীতি ও অর্থপাচারের খেলায় মেতে উঠে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, বৈষম্য আর আত্মঘাতী জঙ্গি হামলায় জনতার স্বপ্নযাত্রা আবার পথ হারায়। আঘাত আসে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায়।

স্বপ্নজয়ের কাণ্ডারি মুক্তিকামী জনতা ফুঁসে উঠে শাসকগোষ্ঠীর দুর্নীতি-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। জঙ্গিবাদী আস্ফালন, লাশ আর রক্তের হোলি খেলা বন্ধ এবং জনজীবনের জীবনযাত্রায় নাভিশ্বাস থেকে গণমানুষের মুক্তির প্রত্যাশায় আবারো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ডাক দেয় বামপন্থীরা। বিভেধ ভুলে দাঁড়ায় ঐক্যের কাতারে। ঐক্যবদ্ধ সেই লড়াই বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থেকে ১১ দল হয়ে প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী সকল শক্তির ঐক্যব্ধ লড়াইয়ে রূপ নেয়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের বিভক্তির ফাঁদে পা দেয় বামপন্থীরা। তথাকথিত বিশুদ্ধবাদী বামেরা আদর্শিক লড়াইয়ের বিচ্যুতির প্রশ্ন তুলে হাঁটতে থাকে আলাদা পথে। সেদিনের সে ‘বিকল্প’ কতটা যৌক্তিক ছিল তা-সচেতন পাঠক হিসেবে আপনাদের বিবেচনায় রাখলাম। বামপন্থীদের ঐক্য থাকলে বাংলাদেশের এই চরম পরিণতি হয়তো মোড় নিতো অন্য বাঁকে।

যাইহোক, ঐক্য-বিভক্তির মধ্যেও ২০০৮-এর নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিবাদী শক্তির ভূমিধ্বস বিজয়ে পরাস্থ হয় দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী অপশক্তি। বিভক্তির পরেও রণনীতি-রণকৌশল প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ ও প্রগতিশীল চেতনা রক্ষায় বামপন্থীদের একাংশ একদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে গণমানুষের মুক্তির লড়াইয়ে সোচ্চার ছিলেন রাজপথ থেকে সংসদে। ক্ষমতাসীনদের গণবিরোধী নীতির প্রশ্নেও তারা প্রতিবাদের ঝড় তুলে। দুর্নীতি-লুটপাট ও অর্থপাচারের বিরুদ্ধে সরব ছিল তাদের সাহসী কণ্ঠস্বর। বামপন্থী সংখ্যালঘিষ্ঠতায় তা ক্ষমতাসীনদের দমাতে পারে নাই। ক্ষমতাসীনরা অফিস থেকে বাজার, জলাশয় থেকে বালুমহল সর্বত্র লুটপাট আর ত্রাসের রাজত্ব। বাজার চলে যায় সিন্ডিকেটের দখলে। ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্র নির্ভর সরকার দুর্নীতির মচ্ছবে মেতে উঠে। বাড়তে থাকে বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার অসহায় মানুষের হাপিত্যেশ। নিত্যপণ্যের বাজারে অগ্নিমূল্যে জনতার নাভিশ্বাস উঠে। কোনোভাবেই শাসকগোষ্ঠী আর তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ক্ষমতা আকড়ে থাকতে ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া নীতিগ্রহণ। এটাই নিউলেবারেল ইকোনোমির চরিত্র। পুঁজি রক্ষা ও পুঁজির পাহাড়ায় ধীরে ধীরে তা চরম কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরশাসনে রূপ নেয়। যা শাসক গোষ্ঠীকে রক্ষা নয়, বরং পতনের দিকে টানে।

অন্যদিকে জেনে বা না জেনে দক্ষিণপন্থী শক্তির সমর্থন ও উত্থানের পথরচনায় পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছে তথাকথিত বিশুদ্ধ বামেরা। ফলে একদিকে ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ববাদী আচরণ, দুর্নীতি-লুটপাট, স্বজনপ্রীতি, গণবিরোধী নীতি ও কৌশল, ক্ষমতার নেশায় ধর্মবাদীদের সাথে সখ্যতা, অন্যদিকে বামপন্থী বিভাজনে জনতার লড়াইয়ের কণ্ঠস্বর ও শক্তি দুর্বল হওয়ায় আজকের এই পর্যায়ে এসেছে বাংলাদেশ। মাঝখানে ফায়দা লুটছে সাম্রাজ্যবাদী বাজপাখী। আস্ফালন বেড়েছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির। রেজিম চেঞ্জের ষড়যন্ত্রের খেলায় সফল আমেরিকার পিটার হাস ও ডোনাল্ড লু’রা।

যাই হোক ফিরে আসি জনতার স্বপ্নযাত্রায়। গত বছর কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জুলাই আন্দোলন শুরু হলেও তা ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, লুটপাট, দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদী শাসনে অতিষ্ঠ জনতার পুঁঞ্জিভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। জুলাই আন্দোলনকে ‘গণঅভ্যূত্থান’, “দ্বিতীয় বিপ্লব” এমনকি “দ্বিতীয় স্বাধীনতা” বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে। ৩০ লাখ মানুষের আত্মহুতির সর্বজনীন জনযুদ্ধ হিসেবে খ্যাত মুক্তিযুদ্ধ আর কর্তৃত্ত্ববাদী শাসকগোষ্ঠীকে পরাস্থ করতে দেড় সহস্রাধিক মানুষের আত্মহুতির জুলাই আন্দোলন এক কাতারে দাঁড় করানো কতটা যুক্তিযুক্ত তা বিবেচনার দায়িত্ব¡ সচেতন পাঠকের।

আন্দোলনের স্টেকহোল্ডারদের কারো কারো দাবি ‘চাই নতুন বাংলাদেশ’ ‘নতুন বন্দোবস্ত’ জুলাই সনদের আদলে ‘নতুন সংবিধান’। প্রশ্ন হলো নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা কিংবা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ পাল্টে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ‘নতুন সংবিধান’ সৃষ্টি-যাই হোক না কেন, তাতে কি লড়াইয়ের মূল নিয়ামক শক্তি জনতার স্বপ্নযাত্রা পূরণ হবে! একবছর পরে এসেও প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব এলোমেলো!

সমালোচকদের মতে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মূল উপজীব্য ছিল বৈষম্য নিরসন। অন্তবর্তী সরকার সে বৈষম্য কি দূর করতে পেরেছে? পরিস্থিতি বলছে, ‘না’। বরং বৈষম্য আরো বাড়ছে। ক্ষমতার হাতবদল হলেও ব্যবস্থার বদল হয়নি। উল্টো অন্তবর্তী সরকারের কারো কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতি-লুটপাটের অভিযোগ উঠছে জোরালোভাবে। জুলাই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে জনপ্রিয়তা ছিল, তা রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি) ক্ষেত্রে অনেকটাই ম্লান হচ্ছে। ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর পরিবর্তে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘নতুন সংবিধান’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য, নেতাদের প্রতি অবমাননাকর আচরণ, চাঁদাবাজির অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এনসিপি নেতাদের গ্রহণযোগ্যতা। তদবির বাণিজ্য, চাঁদাবাজির অভিযোগের আঙ্গুল জুলাই আন্দোলনের প্রধান সারির ছাত্রনেতাদের দিকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা’র মতে নতুন গড়ে উঠা প্ল্যাটফর্মটি নাকি ‘মানি মেকিং এন্টারপ্রাইজ’! চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও। আওয়ামী শাসনামলে পাচারকৃত অর্থ ফেরত তো দূরের কথা, গত এক বছরে দেশ থেকে আরো টাকা পাচার হয়েছে। মন্তব্য মির্জা আব্বাসের।

অর্থনৈতিক সংকট চরমে। বাজারের আগুনও নিভে নাই। বাড়েনি আমজনতার আয়। বরং ব্যয় বাড়ছে হু হু করে। কৃষকের ভাগ্য এখনো সেই তিমিরেই। শ্রমিকের মজুরি না বাড়লেও উল্টো কর্মহীন হচ্ছে। অর্থনীতির মন্দায় কমছে ব্যবসায়ীদের আয়। বাড়ছে বেকারত্ব, বাড়ছে দারিদ্র্যের হার। ফলে জনতা ক্ষমতা বদলের মূল হাতিয়ার হলেও তাদের মুক্তি মিলেনি। স্বপ্ন ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, ফিরবে শান্তি ও শৃঙ্খলা। নিরাপদ বুক ফুলিয়ে হাঁটবে সাধারণ মানুষ। দেশ গণতান্ত্রিক যাত্রায় ফিরবে। ফিরবে নাগরিক অধিকার। বিচার বিভাগ সহ সরকারের সকল বিভাগের আমূল পরিবর্তন হবে। গড়ে উঠবে ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, সুশাসন আর ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র। সে প্রত্যাশাতেই জুলাই আন্দোলনের মিছিলে পা বাড়িয়েছিল সাধারণ মানুষ। কিন্তু প্রত্যাশায় গুঁড়েবালি। বরং ’৭১ কিংবা ’৯০-এর মতো জনতার স্বপ্ন ভঙ্গ জুলাই আন্দোলনেও।

এটাই নিউলেবারেল ইকোনোমি বা সাম্রাজ্যবাদের শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র। যে ফাঁদে তারা পা দেয়, সেটাই তাদের ডুবায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তার কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে! ক্ষমতা বদলায়, বদলায় শাসকগোষ্ঠী। ব্যবস্থা বদল না হলে বদলাবে না শাসকগোষ্ঠীর চরিত্র!

অন্যদিকে কেউ কেউ জুলাই আন্দোলনকে ‘রেজিম চেঞ্জের ষড়যন্ত্র’ আখ্যায়িত করছেন। অনেক আগেই বহু রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলেছিলেন, “ভূ-রাজনীতির কঠিন রোষাণলে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।” চট্টগ্রাম বন্দর, সেন্টমার্টিনে শক্তঘাঁটি করতে না পারার গোস্বা থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী বাজপাখী রেজিম চেঞ্জের চিন্তাকে জোরালোভাবে মাথায় নেয়। নানা সমীকরণের পর টার্গেট করে এদেশের তরুণ প্রজন্মের ছাত্র সমাজকে। সাথে ছিল এদেশীয় দক্ষিণপন্থী অপশক্তি। শুরু হয় মাস্টার প্লান। বিদেশের মাটিতে জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন প্রধান উপদেষ্টা নিজেই। তাছাড়া আন্দোলনকারীদের অনেকেই মাস্টারপ্লানের কথা নিজের মুখে বলেছেন। ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের সীমাহীন ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে সেই মাস্টারপ্লানে। সব মোহনার মিলনে ২৪-এর ৫ আগস্টে পতন হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের।

সমালোচকদের এই মন্তব্যের পূর্বাভাস বহু আগেই দিয়েছিল রাশিয়া। ’২৩-এর ১৫ ডিসেম্বর এমন সংকেত দিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া যাখারোভা এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, “বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে যদি শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তার সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করবে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতের জন্য।” তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ‘এরাব স্প্রিং’ অর্থাৎ ‘আরব বসন্তের’ মতো একটি সিনারি তৈরি করবে। যে আরব বসন্ত আনতে ব্যবহার করা হবে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের।” জুলাই আন্দোলন যাখারোভা’র পূর্ব সংকেতের বহিঃপ্রকাশ।

এখন প্রশ্ন হলো রেজিম চেঞ্জের ষড়ডন্ত্র কিংবা গণঅভ্যূত্থান-যাই হোক না কেন, জুলাই আন্দোলনে ব্যাপক গণমানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তাদের স্বপ্ন ছিল, ছিল প্রত্যাশা। সেই স্বপ্নযাত্রাকে প্রাধান্য দিতে হবে সবার আগে। তা কি দেওয়া হয়েছে, নাকি হচ্ছে!

প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। নড়েচড়ে বসেছে নির্বাচন কমিশন। তবে আদৌ কি নির্বাচন হবে, নাকি হতে দেওয়া হবে! সংশয়, শঙ্কা বাড়ছে! কারণ ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-ডিক্লারেশন নিয়ে গোস্বা করেছে এনসিপি। ক্ষুব্ধ জামাত ও ইসলামপন্থী আরো কিছু দল। বামপন্থীদের একটা অংশ তো আগেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। নির্বাচনী ঘোষণাকে ইতিবাচকভাবে নিলেও ছাত্রদের রাজনৈতিক দল এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না।’ দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বক্তব্য, “জুলাই ঘোষণাপত্রে ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জুলাই সনদে একবিন্দুও ছাড় দেওয়া হবে না।” তাদের দল এনসিপি জুলাই সনদ বাস্তবায়ন, সংবিধানের পরিবর্তন ও চলমান বিচার প্রক্রিয়া শেষ করা ছাড়া কোনোভাবেই নির্বাচনে যাবে না। দলটির কেন্দ্রীয় সভা থেকে শ্লোগান তোলা হয়েছে,“বাংলাদেশের সমাধান, নতুন এক সংবিধান।”

অন্যদিকে জামাতে ইসলামীও আগে বিচার ও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন চায়। একই সুর ইসলামি আন্দোলন ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলগুলোর। সকলের দাবি গণপরিষদ।
নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছে গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুর। ইউনুস সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না-এমন দাবি কিছু বামপন্থী দলের। ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী ও রাজনৈতিকভাবে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন চায়, তবে তা ইউনুস সরকারের অধীনে নয়। কেবল খোশ মেজাজে আছে বিএনপি। তারা চায় ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন।

কিন্তু কেবল বিএনপি চাইলেই তো হবে না। আগামী নির্বাচন নিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে রাজনীতির আকাশে যে কালো মেঘ উঁকি দিচ্ছে তা গণতান্ত্রিক রূপান্তরকামী সাধারণ মানুষের জন্য এক অশনিসংকেত। তাই একদিকে সাধারণ মানুষের লড়াইয়ের স্বপ্ন অধরা, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় আবারো অশনিসঙ্কেত। ফলে চব্বিশের আন্দোলন ইতিহাসে বীরত্বের মাইলফলক হবে নাকি কলঙ্কিত স্মারক হিসেবে থাকবে-তা নির্ভর করছে জনগণ ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের নৈতিক মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের ওপর।

যাইহোক জুলাই আন্দোলন রাষ্ট্রের পুরনো কাঠামো ভাঙতে না পারলেও মানুষের সচেতনতা, জবাবদিহির দাবি ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে দিয়েছে যা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অনিবার্য। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আইসিইউতে থাকা জনতার স্বপ্নকে সুস্থ্য-সবল করতে হবে। ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যবস্থা বদলের লড়াইকে জোরদার করে জনগণের রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে হবে। সেই কাজটি পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তি কখনোই করবে না। কেবল ক্ষমতা বদলের লড়াইয়ের সুর তুলবে। ব্যবস্থা বদলের লড়াইয়ে বামপন্থীদের’ই নামতে হবে। বিভক্তি ও ভাঙনের খেলা বন্ধ করে, সংকীর্ণতাকে দূরে ঠেলে এই মূহুর্তে সকল বাম-প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এক সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। গণমানুষের রাজনীতির সাফল্য হাতছানি দিচ্ছে। কেবল আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে হবে।

সর্বশেষ