বৃহস্পতিবার,৯,মে,২০২৪
31 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়স্মরণার্ঘ্যলড়াইয়ের ময়দান, সংগ্রামী শ্লোগান-বিপ্লবী স্মৃতি আজো অম্লান

লড়াইয়ের ময়দান, সংগ্রামী শ্লোগান-বিপ্লবী স্মৃতি আজো অম্লান

কমরেড শফিউদ্দিন আহমেদের ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী

কিংবদন্তী নেতার প্রতি অতল শ্রদ্ধা

নতুন কথা প্রতিবেদন ॥ শ্রমিক আন্দোলনের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন কমরেড শফিউদ্দিন আহমেদ। শ্রমিক অন্তঃপ্রাণ এই কিংবদন্তী নেতার বর্ণাঢ্য সংগ্রামময় জীবনের অবসান ঘটে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর। এদিন’ই তিনি বিদায় নেন প্রকৃতির অমোঘ সত্য মৃত্যুর ডাকে। এ বছর ১৫ নভেম্বর ছিল তার ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী।
সারা জীবন তিনি অন্যায় ও অসত্যের কাছে আপোষ করে নি। নানা ঘাত-প্রতিঘাতেও আদর্শে অবিচল থেকেছেন শ্রমিক আন্দোলনের এই উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যুতে সেদিন যেমন কেঁদেছিলেন পার্টি কমরেডরা, নারায়ণগঞ্জের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ, এখনো কাঁদেন। কারণ কমরেড শফিউদ্দিন ছিলেন মানুষের নেতা। শ্রমজীবী মানুষের শোষণমুক্তির লড়াইয়ে সারথী। বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা শোষকগোষ্ঠীর হাত থেকে মুক্তির লড়াই ছাড়া শ্রমিকের মুক্তি সম্ভব নয়। তাই শ্রমিকদের কারখানার বাইরে এনে যুক্ত করেছিলেন কমিউনিস্ট রাজনীতিতে। শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যদিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরির্বতনের জন্য সংগ্রাম করার মধ্যদিয়ে হয়ে ওঠেন জাতীয় রাজনৈতিক নেতা।
কমরেড শফিউদ্দিন আহমেদের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২০ জানুয়ারি তৎকালীন বিক্রমপুরের লৌহজং থানার ধানকুন্না গ্রামে। পিতা রুস্তম আলীর জ্যেষ্ঠ সন্তান। বাবার চাকুরির সুবাদে নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত লক্ষীনারায়ন কটন মিলের আবাসিক কোয়াটারে তিনি বেড়ে উঠেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে সংস্পর্সে আসেন। পরবর্তীতে পার্টি সিদ্ধান্তে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে ২৫ বছর বয়সে তাকে রেল শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতে বলা হয়। সেখানেই শ্রমিক আন্দোলনে হাতেখড়ি। তবে অনেকেই মনে করেন তিনি শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন সাধারণ বীমা কর্মচারী ইউনিয়নের মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি সাধারণ বীমা কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হন। সেই সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে রেলশ্রমিক আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী ছিল। কিন্তু নেতৃত্বের অভাবে নারায়ণগঞ্জে তা ছিল অগোছালো। তিনি ও তার কিছু সহকর্মী মিলে রেলশ্রমিকদের সুসংগঠিত করেন। ঐ সময়কালে পাটকল শ্রমিকদের সুসংগঠিত আন্দোলন শ্রমিক আন্দোলনকে বেগবান করে। দলীয় সিদ্ধান্তে তিনি আদমজী পাটকলের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। তিনি ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ, ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা, আন্দোলন ও সংগ্রাম গড়ে তোলায় সম্পৃক্ত হন। দ্রুতই জাতীয় শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে হন। তাই সুনির্দিষ্ট কোনো সেক্টরে তিনি দীর্ঘস্থায়ীভাবে যুক্ত থাকেন নি। তবে ’৭৯-৮০ সালে টেক্সটাইল, জুট প্রেস ও রেলিং শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন লেগে পড়ে থেকে। কাজী জাফরের নেতৃত্বে সেই জুট বেলিং আন্দোলনটি হয়েছিল। আশির দশকে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্যপরিষদ (স্কপ) গঠিত হলে তিনি নারায়ণগঞ্জে ঐক্যপরিষদের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ’৮৪ সালে স্কপের পাঁচ দফা দাবি’র আন্দোলন বাস্তবায়নে তার সক্রীয় ভুমিকা ছিল। পরবর্তীতে তিনি স্কপের কেন্দ্রিয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ’৬৯-৭০ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে মতভেদ হলে শ্রমিক আন্দোলনে নিয়োজিত বেশ কিছু পার্টি সদস্য প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা নাসিম আলীর নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের ‘হাতিয়ার গ্রুপ’ নামে কমিউনিস্ট সংগঠন গড়ে তোলেন; তিনি ছিলেন হাতিয়ার গ্রুপের সদস্য। মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটিতে ‘হাতিয়ার গ্রুপ’ যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৮ সালে প্রথমে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিতে (লেনিনবাদী) হাতিয়ার গ্রুপ যুক্ত হলে তিনি তার সদস্য হন। পরবর্তীতে লেনিনবাদী পার্টি ওয়ার্কার্স পার্টি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলে তিনি প্রথমে নারায়ণগঞ্জ জেলার সম্পাদক ও পরে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পলিটব্যুরো সদস্য হন। পার্টিতে নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকলেও তার মূল কাজ ছিল শ্রমিক আন্দোলন। শ্রমিক আন্দোলনের ঐক্যের ধারায় ‘গণতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলন’ গঠিত হলে তিনি তার কেন্দ্রিয় দায়িত্বে নিয়োজিত হন। পরবর্তীতে জাতীয় শ্রমিক ফেডরেশন বাংলাদেশ এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে তার প্রচেষ্টায় জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ ও জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন ঐক্যবদ্ধ সংগঠনে রূপ নেয়। তিনি বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কমরেড আবুল বাশারের মৃত্যুর পর তিনি পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলনকে এগিয়ে নেন। নারায়ণগঞ্জে জুট বেইলিং প্রেস শ্রমিক ইউনিয়নসহ নারায়ণগঞ্জের অসংখ্য শ্রমিক ইউনিয়ন তার হাতে তৈরী। গার্মেন্টস ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। ২০১৯-এ বার্ধক্যজনিত কারণে পলিটব্যুরোতে থাকতে না পারলেও দশম কংগ্রেসে তাকে পার্টির আজীবন সদস্য নির্বাচিত করেন সম্মানিত কাউন্সিলরবৃন্দ।
কমরেড শফিউদ্দিন আহমেদ নেই। চলে গেছেন ৭৯ বছর বয়সে। কিন্তু তার আদর্শ আজো অবিচল। আগামী দিনে এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনে তার আদর্শ শ্রমজীবী মানুষের লড়াইয়ের প্রেরণা হয়ে থাকবেন। কমরেড শফিউদ্দিন লাল সালাম।

সর্বশেষ