আজ ছাত্র-তরুণদের সহিংস আক্রমণের মুখে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি অলি পদত্যাগ করেছেন।তার ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রপতিও পদত্যাগ করেছেন। রাজধানী কাঠমন্ডু ও তার আশেপাশের জনপদে আন্দোলনকারীরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী কে পি অলির বাসভবন পুড়িয়ে দেয়। সারাদিনের সহিংসতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী জালানাথ কানালের বাসভবনে দেওয়া আগুনে তাঁর স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা যান। মন্ত্রী, ব্যাঙ্কের গভর্নরসহ রাজনৈতিক দলের অফিসসমূহ জালিয়ে দেওয়া হয়। বলা চলে, কাঠমুন্ডুর সরকারী স্থাপনাগুলো সহিংসতার শিকার হয়। সন্ধ্যার দিকে সেনাপ্রধান রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রন নিয়ে আন্দোলনকারীদের সাথে আলাপ আলোচনা করছেন। ইতিমধ্যে আন্দোলনকারীরা কাঠমুন্ডুর মেয়র বালেন শাহকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবার দাবি তুলেছে।
হিমালয়কন্যা হিসেবে পরিচিত নেপাল হঠাৎ গতকাল ৮ সেপ্টম্বর ছাত্রআন্দোলনের ফলে রক্তাক্ত হয়ে উঠে। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত প্রায় ২০ জন নিহত এবং তিন শতাধিক ছাত্র ও যুবক আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে । দুটি বিষয় এই ঘটনার ট্রিগার পয়েন্ট হিসেবে কাজ করেছে বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হচ্ছে। প্রথমত, কয়েক দিন আগে সরকার বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যথাযথভাবে নেপাল সরকারের রেজিষ্ট্রেশন না নিয়ে কর ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করার কারণে বন্ধ করে দেয়। এটা ছাত্র তরুণদের মধ্যে বেশ ক্ষোভের সৃষ্টি করে। ক্ষোভের অন্যতম কারণ হলো, নেপালের জনসংখ্যার প্রায় ৭% প্রবাসে কাজ করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা তাদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। প্রবাসীদের অধিকাংশই গরীব এবং গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিবারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে। অন্যদিকে, এইসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে তরুণরা অনলাইনে আয় করার চেষ্টা করে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ হওয়ায় সমাজে একটা অস্বস্তি তৈরি হয় এবং ছাত্র তরুণ যারা জেন- জি নামে নিজেদের পরিচয় দেয় তারা এই অস্বস্তির সাথে সরকারের দূর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে আন্দোলনের ডাক দেয়। জানা গেছে তারা টিকটিক ব্যবহার করে ৮ তারিখ জমায়েত হয় এবং পার্লামেন্ট ভবনের একটা অংশ দখল করে নিলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশ অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে।
এই পর্যন্ত জানা গেছে, পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে হতাহতের দায় নিয়ে প্রাথমিকভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন।
এই ঘটনা নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা কালো ক্ষত হিসেবে থেকে যাবে।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। খবর পাওয়া গেছে রাতে ধরপাকড় চলার কারণে বিক্ষোভ সাধারণের মাঝে আরও ছড়িয়ে পড়ে।
সরকার বলছিল, ছাত্রদের আন্দোলন জঙ্গিরা দখলে নিয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সরকারের কথা কেউ শুনেনি। অন্যদিকে সরকারের বিরুদ্ধে দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ জনগন বিশ্বাস করছে এবং স্কুল কলেজের পোষাক পরিহিত ছাত্র তরুণকে গুলি করায় সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে।
বিশ্লেষকরা বলছে, বেশ কয়েক বছর ধরে নেপালের বামপন্থীরা বিভক্ত হয়ে সরকার চালাচ্ছে। কখনো পুষ্পকমল দহ প্রচন্ড প্রধানমন্ত্রী আবার কখনো কে পি শর্মা অলি প্রধানমন্ত্রী। এবার, কে পি অলি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দিলে আন্দোলন তুঙ্গে চলে যায়। কিন্তু আন্দোলনকারীদের বক্তব্য হলো তারা রাজনীতিবিদদের দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করতে চায়। একজন শিক্ষার্থী বলছিল, নেতাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করে, সুবিধা ভোগ করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতাদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবন যাপনের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে। তাই তারা আন্দোলনে নেমেছে।
এই ক্ষোভ প্রকাশের অন্য পিঠে রয়েছে, কর্মসংস্থানের সংকোচন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা।
ধারণা করা হয়, নেপালের বামপন্থী সরকার কিছুটা ভারতবিরোধী, কিছুটা চীনঘেঁষা। ভারত নেপালের গুর্খাসহ অনেক জাতিসত্তার কর্মসংস্থান করে, বিশেষ করে, সেনাবাহিনীর গুর্খারেজিমেন্টে। অন্যদিকে, নেপালের কংগ্রেস ও রাজতন্ত্র পন্থীরা ভারত ঘেঁষা। বিশেষ করে কট্টর রাজতন্ত্রীদের সাথে বিজেপির সংযোগ রয়েছে। এদিকে সম্প্রতি , অলির সরকার নেপালের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক অংশ ভারতের দখলমুক্ত করতে চায় এবং তারা নেপালের মানচিত্রে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করে ছাপিয়েছে। ভারতের বিজেপি সরকার তার বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার।
ভারতের সাথে সম্পর্কের অবনতি না হলেও উত্তেজনা আছে। নেপালে এখনো ভারতের সেনারা আছে এবং ভারতের সেনাবাহিনীতে নেপালিরা কাজ করে। ভারত ও নেপালের মধ্যে কাঁটা হয়ে আছে চীন।
সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেসন থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী অলি এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো।
সর্বশেষ নানা খবরে দেখা যাচ্ছে, তরুণদের এই আন্দোলন সংগঠনের পেছনে ডিজে সুদান গুরং সহ বেশ কিছু জনপ্রিয় টিকটকার ও এনজিও প্রধানদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে।
বিশ্লেষকগণ প্রথম দিকে এটা শুধু রেজিম চেইঞ্জের বিষয় মনে করলেও ঘটনা আরও গভীর বলে অনুমান করছে। ছাত্রদের বক্তব্য নেপাল কংগ্রেস একটা দূর্নীতিপ্রধান দল। অলির সরকার এই কংগ্রেসের সাথে জোট করে দূর্নীতি করছে।
এখানে উল্লেখ করা যায়, ২০০৮ সাল থেকে নেপালে আধা পিআর চালু থাকায় কোনো সরকারই মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। এই কয়েক বছরে বার বারের অধিক সরকার পরিবর্তন হয়েছে।
এবার ছাত্র আন্দোলনের অভিমুখ সব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে। অন্য দিকে, নেপালের বামপন্থীরা বিভক্ত এবং অনেকে এই আন্দোলনকে সমর্থন করে এগিয়ে যেতে চায়।
নেপালের এই সহিংস সরকার উচ্ছেদ প্রতিবেশী হিসেবে ভারত নজর রাখছে। তারা বাংলাদেশের সাথে এর মিল খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঘটনার গতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তা বাংলাদেশের মতো মনে হলেও তার চেয়ে কিছুটা আলাদা। নেপালের তরুণরা যাকে নেতৃত্বে চাইছে, কাঠমুন্ডুর মেয়র, তারা এক নতুন প্রজাতির নেতা যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত।
নেপালের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা বাঁকে বামপন্থীদের ইতিবাচক ভূমিকা ছিল এইবার তারা নতুন প্রজন্মের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেলো। বামপন্থীদের বিভক্তি এই টানাপোড়েনকে আরও যন্ত্রণাদায়ক করবে।
নেপালের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থানের সংকোচন, সরকারের দূর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করা- সবমিলিয়ে নেপালের বামপন্থীদের তাদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল!
আগামী দিনের নেপাল নতুন ও পুরাতন ধারার রাজনীতিতে মুখোমুখি শক্তি পরীক্ষা করবে। এতদিন নেপালের রাজনীতি চীন ও ভারতের রশি টানাটানি করছিল কিন্তু সবার অলক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নেপালের রাজনীতির নিয়ে নিলো বলে ধারণা করা যায়।
লেখক- শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক



