বদরুদ্দীন উমর চলে গেলেন আজ সকালে

তাঁকে সাধারণ মানুষ একজন বুদ্ধিজীবী হিসেবে চেনেন। আবার অনেকেই জানেন তিনি একজন কমিউনিস্ট এবং মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী। তাঁর প্রয়ানে তাঁকে নিয়ে অনেক মূল্যায়ন হবে – ইতিবাচক, নেতিবাচক ইত্যাদি। কারণ বাংলাদেশর চিন্তার জগতে তাঁর বেশ প্রভাব রয়েছে।
বদরুদ্দীন উমর ১৯৩১ সালে পশ্চিম বঙ্গে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবুল হাশিম ছিলেন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি চিন্তা চেতনায় ইসলামীক রেডিক্যাল হিসেবে পরিচিত ছিলেন। মুসলিম লীগে তিনি বামপন্থী মুসলিম লীগার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৪৭ সালে বাংলা বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারতের অংশ হওয়ার বিরোধী ছিলেন তিনি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলা অবিভক্ত থেকে একটা দেশ বা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। যাইহোক, তা সফল না হওয়ায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তথা পূর্ব বাংলায় চলে আসেন পশ্চিম বঙ্গের নিজ আবাস ছেড়ে। তাই বদরুদ্দীন উমর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন এবং এরপর অক্সফোর্ডে পড়েন।
দেশে এসে তিনি প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত হন। তখন বামপন্থী আন্দোলন রুশপন্থী ও চীনপন্থী নামে বিভক্ত ছিল। তিনি চীনপন্থীদের সাথে যুক্ত হলেন। তখন চীনপন্থীদের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কি জাতীয় আন্দোলন নাকি শ্রেণিসংগ্রাম তা নিয়ে বিতর্ক চলছিল। পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চীনপন্থীদের একটা বড় অংশ নিজেদের পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। এই ধরনের পরিস্থিতিতে বদরুদ্দীন উমর সকলে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন এবং ব্যর্থ হন। তাই মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণ হয়ে উঠেনি।
স্বাধীনতার পর থেকে বদরুদ্দীন উমরের ধারণা হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ একটা ভারতপ্রভাবিত জাতীয় বুর্জোয়ার আন্দোলন এবং কমিউনিস্ট বা বামপন্থীরা লেখাপড়ায় অজ্ঞ।
কিন্তু তিনি তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ চালিয়ে যান।
বিশেষ করে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন নামক গ্রন্থটি তাঁকে অমর রাখবে। এরপর সাম্প্রদায়িকতা ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা নামক গ্রন্থগুলো বেশ প্রভাবশালী বই হিসেবে বিবেচিত হয়।
ব্যক্তি জীবনে তিনি একটা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, লেখক শিবিরের সংগঠক এবং জাতী মুক্তি কাউন্সিলের নেতা। বামপন্থী রাজনীতির প্রায়োগিক দিকে তাঁর তেমন সফলতা নেই। বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর প্রভাবের প্রথম কারণ, তিনি ধারাবাহিক ভাবে, সংস্কৃতি নামে একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। ইংরেজি ও বাংলায় প্রায় বিশের অধিক বই প্রকাশ করেছেন।
বদরুদ্দীন উমর নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে : দেশে সবাই আমাকে উপেক্ষা করেছে।
গত একবছর তিনি সংবাদপত্রে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতকার দিয়েছেন। এইসব সাক্ষাৎকারে তিনি দেশ, সমাজ ও নিজের সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন। এগুলো বেশ বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন যা ইতিহাসসম্মত নয়। একপেশে। তাঁর সাক্ষাৎকারে এবং আইসিটিতে তাঁর সাক্ষ্য প্রদান তার প্রমান রয়েছে।
যাইহোক, তাঁর মৃত্যু একটা জেনারেশনের সমাপ্তি হিসেবে বিবেচিত হবে যারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে পশ্চিম বঙ্গ থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বাংলাদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমৃদ্ধ করেছিলেন। বামপন্থী আন্দোলনে তাঁর প্রায়োগিক রাজনীতির তেমন সফলতা না থাকলেও তাঁর লিখিত পুস্তকগুলো প্রভাবশালী হিসেবে থেকে যাবে।
মৃত্যু তাঁর এই কাজগুলোকে থামিয়ে দিল।
তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।
লেখক- শরীফ শমশির
লেখক ও গবেষক