শুক্রবার,১৯,ডিসেম্বর,২০২৫
24 C
Dhaka
শুক্রবার, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৫
প্রচ্ছদসম্পাদকীয়মুক্তমতবাংলাদেশ রাষ্ট্রের পঞ্চান্ন বছর: এখনো বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র কীনা বির্তক

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পঞ্চান্ন বছর: এখনো বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র কীনা বির্তক

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পঞ্চান্ন বছর: এখনো বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র কীনা বির্তক : বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ : বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের অভাবে ভারত বনাম পাকিস্তান  যুদ্ধের প্রসঙ্গ: ইতিহাস দখল করে নিচ্ছে রাজনীতি : একটা টাইম বোম কার অস্তিত্ব উড়িয়ে দেবে! /?
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বয়ান বদলে ইতিহাস বদলের এক অশুভ প্রয়াস চলে আসছে -এই রাষ্ট্রের সৃষ্টির প্রথম থেকেই। এই ষোল ডিসেম্বর এই বয়ানগুলো বেশ জটিল ও ডালপালা মেলেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কয়েকটি দলের মুখপাত্র ষোলো ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বিজয় দিবস নাকি পাকিস্তানের পূর্বান্চলের পতন নাকি ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় – এইসবই মূখ্য হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনেকে ষোল ডিসেম্বর কে বিজয় দিবস মানতে রাজি নন। সেখানে পাকিস্তান ও ভারত তার তার নিজস্ব বয়ানতো দিবেই।
১৯৭১ সালের ষোল ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলমুক্ত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্র বাহিনী উভয়ই জিতে যায়। বিজয় অর্জনকরে।  বাংলাদেশ তার বিজয় দিবস পালন করে।  ডিসেম্বরের প্রথম দিকে পাকিস্তান পশ্চিম সীমান্তে ভারতের সাথে যে যুদ্ধ শুরু করেছিল পূর্বান্চলে তারা সে যুদ্ধে পরাজিত হয় বা  ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে। ইতিহাসে একইসাথে তিনটা ঘটনা ঘটে। প্রথমত, ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলার উপর অপারেশন সার্চলাইটের সূচনা করেছিল তার বিরুদ্ধে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে বাংলাদেশের মানুষ তা নয় মাস পর সেই যুদ্ধে ষোল ডিসেম্বর জয়লাভ করে।  পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে যেমন পরাজিত হয়েছিল তেমনি ভারতের কাছেও পরাজিত হয়েছিল। ভারতের বিজয় কিন্তু একক ছিল না। এই বিজয়ের গৌরবের বেশির ভাগ ভাগীদার বাংলাদেশের অদম্য মুক্তিযোদ্ধারা। রাজনীতির নানা পটপরিবর্তনে তিন পক্ষ তিন ভাবে বা নিজ নিজ দৃষ্টিতে দেখে। এটা স্বাভাবিক। অস্বাভাবিক হলো বাংলাদেশের কেউ কেউ যখন নিজের বিজয় দেখে না। এই রাজনীতি বাংলাদেশকে একটা হীনমন্যতায় নিয়ে যায়। এটাকেই বলা হচ্ছে টাইম বোম। আসলেই তাই।
আহমদ ছফা লিখেছিলেন, উত্তর- পূর্ব ভারতের এ অঞ্চলে একটি ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় অবশ্যই একটি অভিনব ঘটনা। এটা একটা ভূরাজনৈতিক ঘটনাও বটে। কারণ বাংলাদেশের জন্মের পেছনে পরাশক্তিগুলোর বিরোধও নানা ভাবে কাজ করেছে। পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছিল। বাংলাদেশের পক্ষে ভারত ছিল।  ভারতের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল। বাংলাদেশের জন্ম তাই  সোভিয়েতের ঋণেও ঋণী। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং শাসন পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস এখন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। বেশ তর্কমূলকও হয়েছে।  ইতিহাসে রাজনীতি প্রথম প্রবেশ করে সংবিধানের মূলনীতিতে। মূলনীতির চারটির মধ্যে একটা হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের কারণে সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সংবিধানের মূলনীতির চারটির মধ্যে তিনটার পরিবর্তন করেন। সমাজতন্ত্র,  ধর্মনিরপেক্ষতা এবং  বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তিনি পরিবর্তন করেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের জায়গায় আসলো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদ বাঙালির জাতি পরিচয়ের চেয়ে তার ধর্মীয় পরিচয়কে প্রধান করে দেখা হলো। অন্যদিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দূর্বলতা চিহ্নিত করার জন্য মানবেন্দ্র নারায়ন লার্মার সংবিধানে চাকমা সহ পাহাড়ের অন্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিকারকে সংরক্ষণের দাবিকে তুলে ধরা হয়। এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তা হলো বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির পরিবর্তন এনে বাংলাদেশের বাঙালির জাতি পরিচয়ের জায়গায় তার নাগরিকত্বের পরিচয়কে প্রধান করার কথা উঠেছে। বিষয়টা আরও গড়িয়ে অনেকে বলছেন,  বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশ বহুজাতির দেশ। এতে বিষয়টা আরও জটিল হলো। বাংলাদেশের ষোলো ডিসেম্বরে যে বিজয় অর্জিত হয়েছিল তাহলে তা কার বিজয়? এইসব বিতর্ক এখন রাজনীতি,  সমাজনীতি ছাড়িয়ে ইতিহাসের টাইম বোমায় পরিণত হয়েছে। কারণ, এতে,  জাতি হিসেবে বাংলাদেশের বাঙালিদের দীর্ঘ সময়ের নির্যাতিত জাতি হিসেবে সংগ্রাম এবং যুদ্ধ করে একটা জাতিরাষ্ট্র অর্জন করেছে। ১৯৪৭ সালের পর তারমধ্যে যে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ বিকশিত হয়েছে এবং সায়ত্তশাসনের দাবি থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বাঙালির পাকিস্তানের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম এবং পরিশেষে একটা জাতিরাষ্ট্রের আকাঙ্খা তারমধ্যে জেগেছিল এবং তার জন্য তার যে অপরিসীম আত্মত্যাগ তাকে নাকচ করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ একটা জাতিরাষ্ট্র।  এই রাষ্ট্রের আদিবাসীদের সকল সাংবিধানিক অধিকার সংরক্ষিত থাকবে।  বাঙালির ধর্ম পরিচয় থাকবে অর্থাৎ হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ আদিবাসী ধর্ম পরিচয় অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের সৃষ্টির ইতিহাসে যাদের অবদান বা জনগণের সকল অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। এইতো বাংলাদেশ এবং ষোলো ডিসেম্বরের বিজয়।  বাংলাদেশের পরিচয়। ইতিহাসকে তার নিজের জায়গায় থাকতে দিতে হবে। রাজনৈতিক শক্তির বয়ানে তাকে পরিবর্তন করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এক হীনমন্যতায় ভুগবে। তারা তখন নিজের দেশ এবং নিজের গৌরব থেকে বঞ্চিত হবে। তবে এটাও বলে রাখা ভালো,  বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় হয়েছিল একটা জাতিরাষ্ট্রের সংগ্রামের মাধ্যমে।ইতিহাসের এই জন্মসূত্র মনে না রাখলে ইতিহাসের গতিপথ অনুধাবন করা যাবে না।  আর জাতিগত পরিচয়, রাষ্ট্রীয় এবং সাংবিধানিক পরিচয়কে একটার বিপরীতে আরেকটাকে প্রতিদ্বন্দ্বী না করাই ভালো।  না হয়, বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতির একটা বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে বিতর্কের আর শেষ হবে না।আর তাতে রাজনৈতিক বিতর্কও শেষ হবে না। ষোলো ডিসেম্বরে বাংলাদেশ নামক একটা জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। এটাই ইতিহাসের সরল গতিপথ।
লেখক- শরিফ শমশির
লেখক ও গবেষক

সর্বশেষ