কবিগুরু বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি
নতুন কথা ফিচারঃ
২২ শ্রাবণ। এক নীরবতার দিন।
বাংলা পঞ্জিকায় এই দিনটির আলাদা এক আবেগ আছে। এই দিনেই, ১৯৪১ সালের বর্ষায়, চির নিদ্রায় শায়িত হয়েছিলেন সেই মানুষটি, যিনি একাধারে কবি, দার্শনিক, সংগীতকার, গল্পকার, শিক্ষাবিদ, সমাজচিন্তক এবং মানবতাবাদী—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
তবে আমরা কি তাঁকে কেবল ঋষির আসনে বসিয়ে রাখব? না, আসলে মানুষ রবীন্দ্রনাথই আমাদের সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী। কারণ ঋষি দূরের আলোকবর্তিকা, কিন্তু মানুষ রবীন্দ্রনাথ—তিনি আমাদের সুখে-দুঃখে, প্রেমে-বিরহে, সংগ্রামে পাশে থাকা সাথি।
“মানুষের কাছে আমি ঋষি নই, আমি মানুষ হতে চাই।”
জন্ম থেকে শৈশব: মুক্ত হাওয়ার সন্ধানে
১৮৬১ সালের ৭ মে (২৫ বৈশাখ), কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে জন্ম রবীন্দ্রনাথের। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম সমাজের নেতা, মা সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন গৃহকোণার আলোকশিখা। সংসার ছিল ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর জ্ঞানের বাতিঘর। কিন্তু ছোট্ট রবি সেই গৃহের শৃঙ্খলে ছিলেন খানিকটা অস্থির। নিয়মের গণ্ডি ভেঙে তিনি চাইতেন মুক্ত আকাশ, খোলা প্রকৃতি। তাই স্কুলের বেঞ্চি তার ভালো লাগেনি, শিক্ষার আনন্দ খুঁজেছেন ঘুরে বেড়ানোর ভেতর, নিজের চোখের দুনিয়ায়।
কিশোর বয়সেই শুরু হলো সাহিত্যচর্চা। ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী দিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব, যেখানে কিশোরের ভেতর লুকিয়ে থাকা কবিসত্তা প্রথম আলোড়ন তুলেছিল।
যৌবনের উন্মেষ: প্রেম, প্রকৃতি ও সৃষ্টির নদী
তরুণ রবীন্দ্রনাথের জীবন ছিল বহুমাত্রিক। জমিদারি দেখার অজুহাতে শিলাইদহ, পদ্মার পাড়ে কাটানো দিনগুলো তাকে প্রকৃতির কাছে নিয়ে গেল। সেসব অভিজ্ঞতায় জন্ম নিল সোনার তরী, ছিন্নপত্র—যেখানে নদীর ঢেউয়ে মিশেছে মানুষের জীবনের দোলাচল।
এই সময়েই তার প্রেমের কবিতা, গান ছড়িয়ে পড়ল বাংলার আকাশে। কড়ি ও কোমল, চিত্রা, চৈতালি—এসব কাব্যগ্রন্থে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা আর হৃদয়ের সূক্ষ্ম স্পন্দন মিলেমিশে একাকার।
বিশ্বকবি হয়ে ওঠা
১৯১৩ সাল। রবীন্দ্রনাথ পেলেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার গীতাঞ্জলির জন্য। প্রথম এশীয় হিসেবে এই স্বীকৃতি পেলেও, তার গর্ব ছিল না পুরস্কারে, বরং সৃষ্টিতে। তিনি বলেছিলেন—
“আমি পুরস্কারের জন্য কবিতা লিখিনি; লিখেছি অন্তরের আনন্দে।”
কিন্তু বিশ্বকবির এই পরিচয়ের আড়ালে যে মানুষটি ছিলেন, তিনি নিঃসন্দেহে রক্তমাংসের মানুষ। তিনি ভালোবেসেছেন, হারিয়েছেন, শোকের কান্নায় ভিজেছেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, সন্তানরা—প্রাণের মানুষদের একে একে হারিয়ে তিনি যে অশ্রুপাত করেছেন, তারই অদৃশ্য দাগ রয়ে গেছে তার গান, কবিতা, গদ্যে।
শিক্ষা ও সমাজচিন্তায় রবীন্দ্রনাথ
১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন শান্তিনিকেতন। তার স্বপ্ন ছিল মুক্ত শিক্ষা, যেখানে বইয়ের দেয়াল নেই, আছে মুক্ত প্রকৃতি, সৃজনশীলতার স্বাধীনতা। পরে সেটিই হলো বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়—এক অনন্য শিক্ষাচিন্তার প্রতীক।
তিনি ছিলেন সমাজ ও রাজনীতির প্রশ্নে দৃঢ় কণ্ঠস্বর। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৯১৯ সালে নাইটহুড ফিরিয়ে দেন। তার ভাষায়—
“সত্যের উপর যে আঘাত হানে, তার কাছে মাথা নত করি না।”
মানুষ রবীন্দ্রনাথ
আমরা তাঁকে অনেকসময় ঋষি বলে ডাকি, পূজার আসনে বসাই। কিন্তু তিনি নিজেই বলেছেন—
“আমি মানুষের কাছে ঋষি নই, আমি মানুষ হতে চাই।”
তিনি গেয়েছেন প্রেমের গান, লিখেছেন বৈরাগ্যের কাব্য, আবার সমরগর্জনও তুলেছেন স্বাধীনতার আহ্বানে।
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।”
এক হাতে কলম, অন্য হাতে সুর, তৃতীয় হাতে সমাজের পরিবর্তনের চাবিকাঠি—তবু সবকিছুর ভেতর দিয়ে তিনি ছিলেন মানুষ।
তিনি হেসেছেন বন্ধুদের সঙ্গে, তিনি প্রেম করেছেন হৃদয় উজাড় করে, তিনি ব্যথা পেয়েছেন হারানোর যন্ত্রণায়। যে মানুষ এত রঙে নিজেকে ছড়িয়েছেন, তিনি কখনও দেবতা নন—তিনি আমাদের মতোই মাটির মানুষ, শুধু তিনি নিজেকে পূর্ণ করে তুলেছিলেন সৃষ্টির উজ্জ্বলতায়।
শেষ শ্রাবণ: আলো নিভে গেলেও প্রদীপ রয়ে গেল
১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি নিস্তব্ধ হয়ে গেল। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা রবীন্দ্রনাথ তখনও লিখছিলেন—
“বিশ্বমাঝে মহাকাশে মহাকালতলে, ক্ষুদ্র আমি রেখেছি মাথা।”
তিনি চলে গেলেন, কিন্তু যে আলো জ্বালিয়ে গেলেন, তা আজও নিভেনি।
আজও আমাদের প্রেমে, প্রার্থনায়, প্রতিবাদে, মানবতার আহ্বানে রবীন্দ্রনাথ জাগ্রত।
ঋষি রবীন্দ্রনাথ হয়তো দূরের আলো, কিন্তু মানুষ রবীন্দ্রনাথ—তিনি আমাদের অন্তরের সবচেয়ে কাছের প্রদীপ।



