চালে চালবাজি। ডালে কারসাজি। পেঁয়াজ, লবণ ও আলুকা- থেকে নিত্যপণ্যের লাগামহীন দাম-সবই সিন্ডিকেটের খেলা। এ খেলা চলে জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও। বাংলাদেশে এটাই স্বাভাবিক অবস্থা। হরতাল, ধর্মঘট কিংবা বন্যা-খরা’সহ যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই সিন্ডিকেটের পোয়াবারো। বিশ্বের অনেক দেশে ব্যবসায়ীরা সারাবছর মুনাফা করে, রমজানে মানবিক কারণে পণ্যের দাম কমায়। আর আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে রমজানের দিকে। পুরো বছরের মুনাফা লুটে নেয় এই এক মাসে। আসলে এদের মধ্যে মানবতা নেই। মানুষের অসহায়ত্বে সুযোগ নিয়ে ফায়দা লুটে। মানবতাহীন অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে মানুষের সেবা নয়, মুনাফা’ই মুখ্য। পার ট্যাবলেট তিন টাকা উৎপাদন খরচের অ্যাজিথ্রমাইসিন বিক্রি করে ৩৫-৫০ টাকায়। এরকম ব্যবসায়ীদের কাছে করোনা কোনো বিপদ নয়, বরং টাকার পাহাড় গড়ার আর্শিবাদ। তাই তো বিশ্ব মহামারী করোনাতেও ব্যবসায়ীরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্যেও রীতিমতো মানুষের পকেট কেটেছে। পরীক্ষা না করেই করোনার নেগেটিভ রির্পোট দিয়েছে।
এই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মাধ্যমেই নাকি আসছে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের টিকা। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে আসার কথা রয়েছে। শুরু হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগে টিকা আমদানির গুঞ্জন। সে গুঞ্জন এখন সত্য হওয়ার পথে। রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কয়েকটি দূতাবাস তাদের কর্মী ও নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য টিকা আমদানি করতে চায়। পিছিয়ে নেই দেশি-বিদেশি বেসরকারি বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানও। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য টিকা আমদানিবিষয়ক আগ্রহের কথা সরকারকে জানিয়েছে। সরকারও এ বিষয়ে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছে। সরকারের টিকা আমদানি সহযোগী বেক্সিমকো ফার্মা বাণিজ্যিকভাবে টিকা আমদানির ঘোষণা দিয়েছে। এতে প্রতিডোজের দাম পড়বে ১৩ দশমিক ২৭ ডলার বা এক হাজার ১২৫ টাকা। বেক্সিমকো ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কিনবে আট ডলারে। শুরু থেকেই টিকা আমদানির প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ফর্মুলায় ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি কোভিশিল্ড টিকা কোভ্যাক্সের সহযোগিতায় তৈরি একটি টিকা। যা অলাভজনকভাবে বিশ্বের মানুষকে সরবরাহের কথা। কিন্তু সে শর্ত মানছে না ভারত। সেরাম ইনস্টিটিউট ভারতকে দুই ডলারে টিকা দিলেও বাংলাদেশকে ৪৭ শতাংশ বেশি দামে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এরমধ্যে এক ডলার বেক্সিমকোকে বাড়তি দিতে হবে। এসব নিয়েই চারদিকে প্রশ্ন উঠেছে।
অবশ্য ‘স্বাস্থে’-র ডিজি ও বেক্সিমকো’র পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন আশ্বস্ত করেছেন ভারতের সমপরিমাণ দামেই বাংলাদেশ করোনা ভাইরাসের টিকা পাবে। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, ভারতের বিকল্প টিকার বাজার খুঁজে দেশের নাগরিকদের সরকারি উদ্যোগে টিকা প্রয়োগই সমীচীন হবে। নয়তো করোনা নমুনা পরীক্ষা ও টিকিৎসার নামে রিজেন্ট-জেকেজিকা-ের মতো ভুয়া টিকা প্রয়োগ হতে পারে। এছাড়াও করোনার টিকা আমদানি, সংরক্ষণ ও প্রয়োগে কিছু বাড়তি নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয় রয়েছে। যার সক্ষমতা একমাত্র সরকারেরই রয়েছে। এসব আলোচনা সমালোচনার মধ্যেই সরকার বেসরকারি খাতে টিকা আমদানি ও প্রয়োগ বিষয়ে একটি নীতিমালা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। করোনার টিকা আমদানি ও প্রয়োগে সরকারের এককভাবে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। এজন্য বেসরকারিভাবে কেউ এগিয়ে এলে নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। তবে মহামারি মোকাবেলায় কেউ যেন সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে কিংবা জিম্মি করে ব্যবসা না করতে পারে সেটি সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে। টিকা আমদানি থেকে প্রয়োগ-প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের মনিটরিং থাকতে হবে। নয়তো দেশে রিজেন্ট-জেকেজির মতো অন্যন প্রতারকরা করোনার টিকার নামে নকল টিকা প্রয়োগ করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য কোভ্যাক্সের মাধ্যমে উৎপাদিত গ্লোবাল পাবলিক গুড হিসেবে গণ্য হবে। একেবারে বাণিজ্যিকীকরণ করা হবে না। তাহলে বেক্সিমকো ফার্মাকে বাংলাদেশে করোনার টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের একমাত্র অধিকার দেয়া সেরাম ইনস্টিটিউটের পক্ষে কতটা নৈতিক? সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকার একটি ডোজ স্থানীয়ভাবে ২ মার্কিন ডলারে বিক্রি করা হবে। সেই টিকাই বাংলাদেশ সরকারের কাছে বিক্রি করা হবে প্রতি ডোজ প্রায় ৫ ডলারে। কিন্তু কেন? এর যুক্তি কী? বিশ্বব্যাপী মহামারি চলাকালে টিকার দামের এই বৈষম্য কতটা নৈতিক? ঘুরে ফিরে এ প্রশ্নই আসছে।
যাইহোক করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের টিকা নিয়ে নৈরাজ্য হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এই নৈরাজ্য চান না। তারা চান সরকারি উদ্যোগে টিকা। বেসরকারিভাবে দিলেও তা যেন অবশ্যই নিয়ম মেনে হয়। সেখানে যেন কোনো দুর্নীতি লুটপাট না হয়, সেদিকে সরকারকেই লক্ষ্য রাখতে হবে। সাধারণ মানুষ অসহায়। যতই দুর্নীতি হোক মানুষ টিকা নিতে বাধ্য হবে। তাই মানবিক দিক বিবেচনায় সব মানুষের জন্য টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে মানবিক পদক্ষেপ চাই।