বিয়াল্লিশে পা
নতুন সময়কে আবাহন
।। রাশেদ খান মেনন ।।
একচল্লিশ পেরিয়ে বিয়াল্লিশ বছরে পা দিল ‘নতুন কথা’। আর এমন এক সময়ে, যখন দেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশের এই পঞ্চাশ বছর পথ চলার একচল্লিশটি বছর ‘নতুন কথা তার সাথে থেকেছে। মাঝখানে কিছু দিনের বিরতি ছিল। এখন সে সব কাটিয়ে এমনকি ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে ‘নতুন কথা’। পত্রিকা বেরুতেই তা কম্পিউটার বা মোবাইলের পাতায় দেখা যায়। নতুন কথা’র প্রিন্ট ভার্সানের সাথে ই-পেপার’ও বের হয়। এখন বাংলাদেশ সহ বিশ্বে ও যেকোনো প্রান্ত থেকে epaper.notunkotha.news ক্লিক করলেই নতুন কথার সব খবর পাওয়া যায়। হয়েছে ‘নতুন কথা’ নিউজ পোর্টাল। | notunkotha.news ক্লিক করলেই দেখা যায় ‘নতুন কথা’ নিউজ পোর্টাল। প্রস্তুতি চলছে নতুন কথা টেলিভিশনের জন্য। কিন্তু এই সব আধুনিক ব্যবস্থার সাফল্য নির্ভর করে ‘নতুন কথা’ কতখানি পাঠক টানছে। ‘নতুন কথা’ কতখানি তাদের সংগ্রামের সহযাত্রী হতে পারছে।
‘নতুন কথা’ যখন যাত্রা শুরু, তখন কথা দিয়েছিল সে মানুষকে নতুন কথা শোনাবে। নতুন দিনের নতুন স্বপ্নে উজ্জিবীত করবে মানুষকে। সে ক্ষেত্রে ‘নতুন কথা’ কতখানি সফল তা বিচার করবেন তার সাথে শরিকরা, যাদের সংগ্রামী সহযাত্রী থেকেছে ‘নতুন কথা’ তারা।
এই সময়কালে এদেশের শ্রমিকের, এ দেশের কৃষকের এদেশের নারীর ছাত্র-যুবার এবং সংস্কৃতি কর্মীদের কথা বলেছে ‘নতুন কথা’। তাদের সংগ্রামের বিবরণ তুলে ধরেছে। তাদের জন্য পথনির্দেশনামূলক বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেছে।
কিন্তু একচল্লিশ বছর পথচলা ‘নতুন কথা’র জন্য মসৃণ ছিল না। এরশাদ শাসনামলে ‘নতুন কথা’-র সম্পাদক হাজেরা সুলতানা ও ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নাসিম আলীকে ডিজিএফ-তে ডেকে নিয়ে সারাদিন ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। প্রশ্নের পর প্রশ্নে বাণে তাদের বিদ্ধ করা হয়েছিল। অবশ্য এর পরিণাম খুব শুভ হবে না এই বিবেচনায় শেষঅব্দি তাদের ছেড়ে হলেও ‘নতুন কথা’ সব সময় কর্তৃপক্ষের নজরদারীতে ছিল। এরশাদের পতনের পর ‘নতুন কথা’কে নিজের কিছু অক্ষমতার কারণে বন্ধ থাকতে হয়েছে। কিন্তু পুনরায় প্রকাশনায় এসে ‘নতুন কথা’ এবার বিএনপি-জামাত শাসনের দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন, মৌলবাদী ধারণার বিস্তৃতিকরণ ও নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।
দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ‘নতুন কথা’র এই সংগ্রাম এখনো উল্লিখিত হয় এ সম্পর্কিত যেকোনো আলোচনায়। এই দুর্নীতির কাহিনী কেবল দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে বিশ^ জানতে পেরেছে যে বাংলাদেশ কেবল একবার নয়, তিনবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এর সাথে যুক্ত অর্থনীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। এটাই যখন দেশের পরিণতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল তখন ‘নতুন কথা’ সাহস আর দৃঢ়তা নিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
তবে এই সময়কালে ‘নতুন কথা’-র সবচাইতে বড় অবদান ছিল সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদের ক্ষেত্রে। জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ার রাজনীতির মূল হাতিয়াল ছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অবসান ঘটিয়েছিল তাকেই দৃঢ়মূল ভিত্তি দিয়েছিল এসব শাসনামল। এই সাম্প্রদায়িকতার রূপ-প্রকৃতি চরিত্র উদ্ঘাটন করে ‘নতুন কথা’ দেখিয়েছিল এর পরিণাম ফল হচ্ছে মৌলবাদী উত্থান। আর সেটাই ঘটেছিল প্রায় এক দশকে সমাজের সর্বস্তরের মৌলবাদের শিকড় গড়ার মধ্য দিয়ে।
যখন সেই মৌলবাদ জঙ্গিবাদে রূপ নেয়, তাকে চিহ্নিত করতে সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছিল ‘নতুন কথা’। বাংলাভাই, শায়খ আবদুর রহমান সম্পর্কে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আর ক্ষুরধার কলাম বাংলাদেশের মানুষকে জঙ্গিবাদ চিনতে সাহায্য করেছিল। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে সাহস জুগিয়েছিল। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল।
এ ছিল, সমাজের উপরিকাঠামোর যে বিষ ফলের বিস্তৃতি ঘটছিল তার বিরুদ্ধে ‘নতুন কথা’র সংগ্রাম। তবে ‘নতুন কথা’ যাদের কথা বলে সেই শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রাম সংগঠনের দায়ও তুলে নিয়েছিল নিজ কাঁধে। বিরাষ্ট্রীয়করণের বিরুদ্ধে পাটকল বস্ত্রকল শ্রমিকদের সংগ্রাম, তাদের জীবনদান, আগুনে মৃত গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা, তাদের সংগ্রামে আবহন। এসবই ছিল ‘নতুন কথা’-র সংবাদ, মতামত অভিমতের বিষয়বস্তু।
কৃষকের কথাও পিছে পড়ে থাকে। আশির দশকের কৃষকের যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন এরশাদের মত সামরিক শাসনকে ভূমি সংস্কার আইন ও ক্ষেতমজুরদের ন্যুনতম মজুরি আইন প্রণয়নে বাধ্য করেছিল, ‘নতুন কথা’ বিভিন্ন লেখার মধ্যদিয়ে তার তথ্যগত ও তাত্ত্বিক উপাদান জুগিয়েছিল।
আর নারী অধিকারের প্রশ্নে ‘নতুন কথা’ সর্বদা সোচ্চার ছিল। ‘নতুন কথা’র সম্পাদক হাজেরা সুলতানা সেই নারী অধিকার আন্দোলনের অগ্রবর্তীদের একজন ছিলেন। ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার এই শ্লোগনে যে নারী আন্দোলনে এগিয়েছিল আশির মধ্যভাগে থেকে নব্বইয়ের দশকে, তাকে ধারণ করেছে ‘নতুন কথা’। ‘নতুন কথা’ এ ক্ষেত্রে আরো এগিয়ে বলেছে এর জন্য কেবল আইন’ই যথেষ্ট নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও সংশোধন করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজভাবনাকে নারী-পুরুষের সমঅধিকার, সমান অবস্থানের ধারণায় পরিবর্তিত করতে হবে। আর ওই নারী আন্দোলন কেবল সমাজের ওপরতলায় নয়, তৃণমূলেও বিস্তৃত করতে হবে। নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য দুরীকরণ-নিরাপদ কর্মস্থান, গাহস্থ্য নারী শ্রমিকদের কাজের স্বীকৃতি, এমনকি জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি-এসব ধারণাকে কেবল সুস্পষ্টভাবে তুলেই ধরে নাই; তার পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রামকে সংগঠিত হতে উৎসাহিত করেছে ‘নতুন কথা’।
একচল্লিশ বছরে প্রজন্ম থেকে প্রজম্মান্তর অতিক্রম করে ‘নতুন কথা’ এখন এক নতুন বিশে^র প্রান্তে। তথ্য প্রযুক্তি এই সময়কে দ্রুততার সাথে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সামনের পঞ্চাশ বছরে আরো যেসব পরিবর্তন আসবে, তাতে পৃথিবী এক নতুন রূপ নেবে। উৎপাদন শক্তির বিকাশের পাশাপাশি নতুন উৎপাদন সম্পর্কও গড়ে উঠবে। পথ খুলে দেবে সমাজতন্ত্রেও, সাম্যবাদে উত্তরণের নতুন সম্ভাবনায় পৃথিবী এগিয়ে যাবে। এর রূপারূপ কি হবে তা এখনই বলার বিষয় নয়। আগামী পঞ্চাশ বছরে এই সম্ভাবনার নতুন দিকগুলোর উন্মোচন করবে ‘নতুন কথা’-রাজনীতি ক্ষেত্রে, অর্থনীতি ক্ষেত্রে, সমাজ সংস্কৃতির পরিবর্তনে।
মাঝখানে কোভিড-এসে এসবে গতি টেনে দিতে চেয়েছিল। এক ভয়ঙ্কর স্তব্ধতায় দাঁড়িয়েছিল পৃথিবী। কিন্তু এক বছরেই পৃথিবী তার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বিজ্ঞানের এক নতুন অভিযাত্রায়। ‘নতুন কথা’ বিজ্ঞানের এই নতুন অভিযাত্রার সাথী। বিজ্ঞানের জয় হোক। নতুন পৃথিবীর জয় হোক। জন্ম নিক নতুন মানুষ। নতুন সমাজ। নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা। বিয়াল্লিশ বছরে ‘নতুন কথা’ সেই নতুন সময়কেই আবাহন করছে।