একদিন সন্ধ্যাবেলায় হুমায়ূন আহমেদের ফ্ল্যাটে গেছি। নিয়মিত আড্ডার বন্ধুরা তখনো কেউ আসেননি। আমি একটু আগে চলে গিয়েছিলাম। হুমায়ূন আহমেদের ফ্ল্যাটের দরজা সব সময় খোলাই থাকত। বাইরে থেকেই শুনছি, তিনি কাকে যেন ধমকাচ্ছেন। ভেতরে ঢুকে দেখি, গ্রাম্য চেহারার একজন লোকের সঙ্গে ১০-১২ বছরের একটি ছেলে আছে। লোকটি হুমায়ূন ভাইয়ের সেন্ট মার্টিনের বাড়ির কেয়ারটেকার। সে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চা ছেলেটি বেশ উৎফুল্ল। বোঝা গেল, ওই ছেলেটির কারণেই লোকটিকে ধমকাচ্ছেন হুমায়ূন ভাই। লোকটি পিনপিন করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল। হুমায়ূন ভাই কঠিন ধমক দিলেন, ‘খেতা পুড়ি।’ রেগে গেলে ‘খেতা পুড়ি’ কথাটা তিনি প্রায়ই বলতেন। আমাকে দেখে একপলক তাকালেন। সূক্ষ্ম ভঙ্গিতে একটু হাসলেন। বুঝলাম, বাচ্চা ছেলেটির অভিযোগ ধরে তিনি লোকটিকে শাসন করছেন। কয়েকবার ‘খেতা পুড়ি, খেতা পুড়ি’, বলে সেই লোককে বিদায় করলেন।
আরেকবার আমাদের নিয়ে তাঁর খুবই প্রিয় একজন মানুষের ভাইয়ের বউভাতের অনুষ্ঠানে গেলেন। গেলেন বেশ রাত করেই। সন্ধ্যা থেকেই অনুষ্ঠানস্থল থেকে ফোন আসছিল। তিনি নড়ছিলেন না। বোধ হয় কোনো কারণে মেজাজ আগে থেকেই খারাপ ছিল। শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে ১০টার দিকে গম্ভীর ভঙ্গিতে আমাদের নিয়ে রওনা দিলেন। মাইক্রোবাসে আমরা সাত-আটজন। অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখা গেল, খাওয়াদাওয়া শেষ করে অতিথিরা সবাই চলে গেছেন। শুধু আমাদের জন্য একটা টেবিল সাজানো। বসার সঙ্গে সঙ্গে খাবার সার্ভ করা হলো। আমরা খাবার মুখে দেওয়ার জন্য তৈরি। হুমায়ূন ভাই হঠাৎ খাবারের প্লেট ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। রাগে ফেটে পড়া গলায় তাঁর সেই প্রিয় মানুষটিকে বললেন, ‘তুমি জানো না, আমি ঠান্ডা খাবার খাই না।’ বলেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করলেন। কোনোভাবেই তাঁকে আর ফেরানো গেল না। সোজা গিয়ে মাইক্রোবাসে উঠলেন। তাঁর দেখাদেখি আমরাও উঠলাম। ড্রাইভারকে একটা হোটেলের কথা বললেন, ‘ওখানে চলো।’
রাত সাড়ে ১১টার দিকে একটা খুব নামকরা হোটেলে নিয়ে আমাদের খাওয়ালেন। হুমায়ূন ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু করিম। আমারও খুব প্রিয় মানুষ করিম ভাই। তিনি হুমায়ূন ভাইকে বললেন, ‘খাবার তো তেমন ঠান্ডা ছিল না। তুমি এমন করলে কেন?’
হুমায়ূন ভাই হেসে বললেন, ‘ইচ্ছা করে করেছি।’
ইমদাদুল হক মিলন