বিজয় উৎসবে বজ্রকণ্ঠে তারুণ্যের উচ্চারণ
অপশক্তির বিষবৃক্ষের মূলোৎপাটন চাই
নতুন কথা প্রতিবেদন : ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। ’৭১-এর এই ষোলতেই বাঙালির জীবনবাজি রাখা মুক্তিসংগ্রামের অবসান হয়। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঙালি ছিনিয়ে আনেন কাঙ্খিত বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক এক স্বাধীন দেশ। আকাশে উড়তে থাকে লাল-সবুজের পতাকা। ডিসেম্বরের ১৬ তাই বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় দিন। আনন্দ-উচ্ছ্বাসের দিন। এ বছর ছিল মহান বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকী। ফি বছরের চেয়ে এবারের বিজয় উৎসব ছিল একটু ভিন্ন চেতনার, বিশেষ গুরুত্বের। কারণ চলছে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উৎসব। সামনের ২৬ মার্চ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। তাই অন্যান্য বছরের তুলনায় এবারের বিজয় উৎসব বেশ গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করেছে বাংলাদেশ। করোনার কারণে নানা বিধি-নিষেধ থাকলেও বিজয় উৎসব-আয়োজনে এতটুকু কমতি ছিল না। গোটা দেশ সেজেছিল লাল-সবুজের বর্ণিল সাজে। সরকারি-বেসরকারি ভবনে শোভা পেয়েছে রক্তলাল পতাকা। রাজধানী ঢাকাসহ জেলা-উপজেলা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক, সড়ক দ্বীপ, গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা ছিল আলোকসজ্জায় সজ্জিত। মরণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণের আতঙ্ক থাকলেও সে ভয়কে তুচ্ছ করে জাতীয় স্মৃতিসৌধ সহ সারাদেশের স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল নেমে ছিল। শিশু থেকে বৃদ্ধ-সবাই সেজে ছিলেন লাল-সবুজের সাজে। হৃদয়ে দেশপ্রেম, কণ্ঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার দৃঢ় শপথ আর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত অপশক্তি ও নব্য রাজাকারদের বাংলাদেশ থেকে সমূলে উৎখাতের বজ্র কঠিন উচ্চারণ। এবারের বিজয় দিবসে ধর্মের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কঠোর হুশিয়ারি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। এখানে সকল ধর্মের মানুষ সমান সুযোগ পাবেন। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপশক্তিকে রুখতে প্রধানমন্ত্রীর এই দৃঢ় উচ্চারণে উৎসাহিত হয়ে নতুন প্রজন্ম তার পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
১৬ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সাথে সাথে করোনা সংক্রমণের ভয়কে দূরে ঠেলে ঘর থেকে রাস্তায় নেমে আসেন হাজার হাজার মানুষ। রাজপথ ও অলিতে গলিতে লাল-সবুজের ব্যাপক সমারোহ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। জাতীয় স্মৃতিসৌধ সহ সারাদেশে জাতির সূর্যসন্তান বীর শহীদদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করার সময় তারুণ্যের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তিকে আরো দাঁতভাঙা জবাব দিতে আমরা সকলেই ঐক্যবদ্ধ। সমূলে উৎপাটন করতে হবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিষবৃক্ষ। ছিল যুদ্ধাপরাধী রাজাকার ও মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার শপথ। তাদের কণ্ঠে ছিল নব্য রাজাকারদের প্রতিরোধের সুর। তারা এও শপথ করেছে অচিরেই একাত্তরের ঘাতক ও তাদের আজকের দোসর নব্য রাজাকারদের এখনই সমূলে উৎখাত করতে হবে। তা না হলে আগামীর বাংলাদেশ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ উত্থানের ভয়ঙ্কর বাংলাদেশ।
তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের সাথে সব শ্রেণিপেশার মানুষ এবার বিজয় উৎসবে শপথ নিয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যারা ধ্বংস করতে চায়, যারা দেশটাকে আবার পাকিস্তানি কায়দায় ফিরিয়ে নিতে চায়, তাদেরকে আর ছাড় নয়। এবার হবে প্রতিরোধ। প্রতিরোধ লড়াইয়ের মাধ্যমেই ভাস্কর্যবিরোধী অপশক্তিকে দমন করতে হবে। আগামীতে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর উৎসব হবে জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ ও পাকিস্তানি প্রেতাত্মামুক্ত অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ। যেটা ছিল বাহাত্তরের সংবিধানে, ছিল বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও রাজনৈতিক নীতিতে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী অপশক্তিকে প্রশ্রয় দিবেন না। জাতির জনকের স্বপ্ন ছিল অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের স্বপ্ন। কেবল স্বপ্নই নয়, বুকে ধারণ করতেন বলেই, ৭২ এর সংবিধানে তা সন্নিবেশিত করেছিলেন। সাথে ছিল জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র। এই চার মূলনীতির ভিত্তিতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দল আওয়ামী লীগ ও জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা এখন ক্ষমতায়। তারপরেও সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী অপশক্তি বাঙালির গর্ব শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছে। ইতোমধ্যে তারা ঢাবির মধু’র ভাস্কর্য, কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধু ও বাঘা যতীনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলেছে। এমন দুঃসাহস দেখানোর পেছনে অনেক কারণ আছে। বিমানবন্দরে লালন ভাস্কর্য এবং সুপ্রিম কোর্টের সামনে নারী ভাস্কর্য অপসারণের দাবিতে সাড়া দেওয়ায় আজকে তারা এত উৎসাহিত হয়েছে। তাছাড়া কওমী মাদ্রাসায় উচ্চ শিক্ষার স্তর দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমানের মর্যাদা দান’ই আজ হয়তো কাল হয়েছে। ওরা সাহস পেয়েছে ওদের সুপারিশে পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তনে। আপোষকামীতার মনোভাবই হয়তো সর্বনাশ ডেকে এনেছে। তাই এখন থেকে সরকার ও প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওদের শেকড় উপড়ে ফেলার বিকল্প নেই। সাম্প্রদায়িকতার রাহুগ্রাস থেকে প্রিয় বাংলাদেশকে মুক্ত করতেই হবে-এটাই ছিল ৪৯তম বিজয় দিবসের মূল অঙ্গীকার।