বৃহস্পতিবার,২৫,এপ্রিল,২০২৪
31 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়আজো মুক্তিকামী মানুষের দিশারী

আজো মুক্তিকামী মানুষের দিশারী

কমরেড লেনিনের ১৫১তম জন্মবার্ষিকী

।। এম এইচ নাহিদ ।।

আজ রুশ বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড লেনিনের ১৫১তম জন্মদিন। রাশিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি গঠনের সময় সাইবেরিয়ার ‘লেনা’নদীর নাম অনুসারে রাখা ‘লেনিন’ছদ্মনাম হলেও ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ সারা দুনিয়ায় পরিচিত মহামতি লেনিন নামেই। রাশিয়ার ভোলগা নদীর তীরের সিমবির্স্ক শহরে এই মহান বিপ্লবীর জন্ম ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল। বাবা  ল্যা নিকোলায়েভিচ উলিয়ানভ ছিলেন কট্টর গণতন্ত্রবাদী সমর্থক। আর মা আলেক্সান্ড্রাভনা উলিয়ানভা ছিলেন একজন শিক্ষিকা। দাদা আলেক্সান্ড্রাভনাকে ফাঁসি দেওয়া হয় জার হত্যার ষড়যন্ত্রের অপরাধে। মূলত দাদার মৃত্যুর পর ভ্লাদিমির বিপ্লবী সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন।

সেই কিশোর বয়সেই ভ্লাদিমিরে হৃদয়ে নাড়া দেয় জার শাসনামলে রাশিয়ায় পুঁজিবাদের দ্রুত বিকাশ এবং পুঁজিবাদী শোষণের সাথে ভূমিদাস প্রথার সম্পর্ক। জার সরকারের স্বৈরাচারী শাসন, জমিদার ও পুঁজিপতিদের নিপীড়ন; কৃষক দরিদ্র ও অধিকারহীনতায় উৎপীড়িত মানুষের প্রতি সহমর্মীতায় তার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

কার্ল মার্কসের সাথে পরিচয়ের অনেক আগেই সাহিত্যপ্রেমী লেনিনের মনে আলোড়ন তুলেছিল নিকোলাই চেরনিশেভস্কির গ্রন্থ ‘হোয়াট ইজ টু বি ডান’-যা তিনি লিখেছিলেন রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে সেন্ট পিটার্সবার্গ ও পুলদুর্গে কারারুদ্ধ অবস্থায়। এই বই লেখার কারণে ঈর্ষানিত হয়ে এক অনুষ্ঠানে তুর্গেনভ চিৎকার করে বলেছিলেন,“তুমি একটা সাপ, আর ওই দ্রব্রলিউবভ একটি যাটল সাপ।”  কেবল তাই নয়,চেরনিশেভস্কিকে তুর্গেনেভ ও তলস্তয় ব্যঙ্গ করতেন ‘ছারপোকার গন্ধমাখা ভদ্রলোক’হিসেবে। কিন্তু কমরেড লেনিনের কাছে এই গ্রন্থ ছিল বিপ্লবের দিক নির্দেশনা। এই গ্রন্থে তিনি দেখেছিলেন কীভাবে সংগ্রাম করতে হয়, শত্রুকে চিহ্নিত করা যায় এবং নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে বাঁচতে হয়। এই গ্রন্থে খুঁজে পেয়েছিলেন,‘জীবন খুবই ছোট সময়ের জৈবিক প্রক্রিয়া, তাই সব মানুষের জন্য সুখ আনায়ন করা প্রয়োজন। যে পৃথিবী লোভ, ঘৃণা, অহমিকা ও শ্রেণিদ্বারা নিয়ন্ত্রিত সেখানে তা কখনোই সম্ভব নয়। সে জন্য একটা সামাজিক বিপ্লব প্রয়োজন।’ চেরনিশেভস্কির এই দর্শন থেকে চরমভাবাপন্ন হয়ে লেনিন রাশিয়ায় সামাজিক বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন।

‘রাবোচেয়ে দেলো’(শ্রমিক আদর্শ)পত্রিকার প্রথম সংখ্যা বের করেই লেনিন পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। কিন্তু দমে যান ‍নি। পিটার্সবুর্গ জেলে ১৪ মাসেরও বেশি সময় থাকাকালে লেনিন লিখে ফেলেন মার্কসবাদী পার্টির প্রথম খসড়া কর্মসূচী। জেল থেকেই বই ও পত্রিকার লাইনের ফাঁকে ফাঁকে দুধ দিয়ে লিখতেন। এমনিতে তা চোখে পড়ত না। কিন্তু আগুনে কাগজটা গরম করলেই তা বেশ ফুটে উঠত। জেলের রুটি ছিল দোয়াত। আর তাতে থাকা দুধ ছিল কালি। ‘ইস্ক্রা’(স্ফুলিঙ্গ) নামক বিপ্লবী পত্রিকা বের করেন প্রবাস জীবন থেকে। সঙ্গী ছিলেন জুলিয়ান মার্টয়।

জার স্বৈরশাসনে বিরুদ্ধে মেহনতিদের শ্রমমূল্য প্রতিষ্ঠার জন্য জার পুঁজিপতিদের হত্যা করা ‘নারোদবাদীরা’ মাথা চারা দিয়ে উঠেছিল। জার শাসনের বিরোধীতাকারী হলেও লেনিন নারোদবাদীদের বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ তিনি হত্যাযজ্ঞ এবং সন্ত্রাসকে কিছুতেই মানতে পারেন নি। লেনিন গুরুত্ব দিতেন মার্কস এবং এঙ্গেলসের ধারণা ও তত্ত্বকে। ১৮৯২ সালে সামারায় প্রথম মার্কসবাদী দল গঠন করেন।
১৮৯৩ সালে সামারা থেকে রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী পিটার্সবার্গে এসে লেনিন বিপুল উদ্যম আর উদ্দীপনায় বিপ্লবী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে অবিচল থাকায় পিটার্সবুর্গে মার্কসবাদী স্বীকৃত নেতা হয়ে ওঠেন।
এ সময় নারোদবাদীরা লেনিনের নীতিকে ভিত্তিহীন বলে নানা প্রচারণা চালান। শুধু তাই নয়, সরকার কতৃক অনুমদিত পত্র-পত্রিকায় মার্কসবাদকে বুর্জোয়াদের স্বার্থের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টাকারী তথাকথিত ‘বৈধ মার্কসবাদী’রাও তার বিপক্ষে মাঠে নামে। লেনিন নারোদবাদী ও ‘বৈধ মার্কসবাদী’দের বিরুদ্ধে মেহনতি মানুষদের বুঝিয়ে এবং বড় বড় কল-কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘বিপ্লবী মার্সকবাদী পার্টি’ গড়ে তোলার তোলার চেষ্টা করেন।
১৮৯৭ সালের লেনিনকে ৩ বছরের জন্য সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে। তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি। পুরোদমে পড়াশোনা ও লেখালেখি শুরু করেন। এখানেই লিখেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রাশিয়ায় পুজিঁবাদের বিকাশ’ শীর্ষক বই।
পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্থানে গোপনে রাজনৈতিক কাজ করে প্রায় দশ বছর পর ১৯১৭ সালের ৩ এপ্রিল রাতে লেনিন রাশিয়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হন। সেখানে শ্রমিক শ্রেণী ও গরিব কৃষকদের ক্ষমতা দখলের জন্য লেনিন বুজোর্য়া জার সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থান, প্রলেতারীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। লেনিন ও বলশেভিক পার্টির নেতৃত্ব শ্রমিক, লালরক্ষী, সৈন্য ও নাবিকদের আত্মৎসর্গী সংগ্রাম ও বীরত্বের ফলে বিশ্ব ইতিহাসে এক মহাসাফল্যের ঘটনা ঘটে-জমিদার ও পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়।
২৫ অক্টোবর সকাল ১০ টায় পেত্রগ্রাদ সোভিয়েতের অধীনস্থ সামরিক বিপ্লব কমিটি লেনিনের বিবৃতি প্রকাশ করে ঘোষণা দিল, ‘যে আদর্শের জন্য জনগণ লড়ছিল তা সফল হয়েছে।’
যাত্রা শুরু হয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের। কমরেড লেনিন হয়ে উঠেন রুশ বিপ্লবের মহানায়ক। তিনি কেবল অত্যাচারি জার শাসনের হাত থেকে রাশিয়ার জনগণকেই বাঁচান নি, বিশ্বের অগণিত মানুষের মুক্তির দিশারী হয়ে আছেন আজো। দুনিয়ার মুক্তিকামী জনতার আদর্শের মূর্তপ্রতীক কমরেড লেনিন মৃত্যুবরণ করেন ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি। ১৫১তম জন্মদিনে জানাই সংগ্রামী লাল সালাম।

সর্বশেষ