সোমবার,২৯,এপ্রিল,২০২৪
31 C
Dhaka
সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতআজো লড়াইয়ে অবিচল

আজো লড়াইয়ে অবিচল

ছাত্র মৈত্রী’র ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী

॥ আরিফুজ্জামান ॥

আরিফুজ্জামান

গত ৬ ডিসেম্বর ছিল আমাদের প্রাণের স্পন্ধন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’র ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। শিক্ষা-কাজের সংগ্রাম ও সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের শপথে ১৯৮০ সালের এ দিনে প্রিয় মৈত্রী’র জন্ম নিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায়। সেদিন প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের চারটি সংগঠনের ঐতিহাসিক ঐক্যের মোহনায় ‘মৈত্রী’ তার লড়াইয়ের যে মেজাজ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তা আজো প্রবাহমান। ৪১ বছরে মৈত্রী কখনো আপস করে নি। সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যেমন গর্জে উঠেছে, তেমনি মেহনতিদের সন্তানদের শিক্ষার অধিকার আদায়ে লড়ছে অবিরাম। লড়ছে গণবিরোধী যেকোনো নীতির বিরুদ্ধে। এ লড়াই কখনো মসৃণ ছিল না। বাধা এসেছে বহু বার। প্রাণ ঝরেছে শহীদ জামিল, রীমু, রূপম সহ আরো অনেকের। তারপরেও কালে কালে ‘মৈত্রী’ সেনারা শহীদের রক্তস্নাত এ সংগঠনকে এগিয়ে নিয়েছে লড়াইয়ের মাধ্যমে। ৪২ বছরের নবযাত্রায় আরো বজ্রকঠিন নতুন শপথে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার লাল-হলুদের পতাকাবাহী লড়াকু যোদ্ধাদের।
মহান ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত ইতিহাসের পথ ধরে ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল গড়ে ওঠে উপমহাদেশের প্রথম প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’। তারই ধারাবাহিকতার উত্তরাধিকার ‘বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে বহুধাবিভক্ত হয় ছাত্র ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশের ঐক্যের তাগিদ থেকেই মৈত্রী’র জন্ম হয়েছিল। ১৯৮০ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতীয় ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় ছাত্রদল-এর দু’টি অংশ এবং বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী। পরবর্তীতে ঐক্যের ধারাবাহিক সংগ্রামে ১৯৮১ সালে জাতীয় ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশ, ১৯৮৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের একটি অংশ মিলিত হয়। ১৯৮৮ সালের ৭ এপ্রিল বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী’র ঐক্যের মধ্য দিয়ে সংগঠনের নাম হয় বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। একাত্তরের পরাজিত ঘাতক মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক চক্রের বিরুদ্ধে ছাত্র মৈত্রী’র বীরোচিত লড়াই এদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায় রচনা করেছে। লড়াইয়ের পথে মৈত্রী এখনো অবিচল। এ লড়াইয়ে মৈত্রী হারিয়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শহীদ জামিল আক্তার রতন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জুবায়ের চৌধুরী রীমু, শহীদ দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য রূপম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ফারুকুজ্জামান ফারুক, যশোরের শহীদ আইয়ুব হোসেন, রাজবাড়ীর শহীদ বনি আমিন পান্না, শহীদ আতিকুল বারী, ঝিনাইদহের শহীদ রাজু আহম্মেদ বাবলু, পাবনার শহীদ আসলাম, ঢাকা মহানগরের শহীদ আশরাফুল ইসলাম নাসিম, শহীদ রেজাউল করিম সেলিম, বরিশালের শহীদ শামীম আহমেদ এবং রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শহীদ রেজওয়ানুল ইসলাম চৌধুরী সানি কে। ছাত্র মৈত্রীর প্রতিষ্ঠাতা কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন আজকের গণমানুষের প্রিয় নেতা রাজশাহীর সাংসদ কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আতাউর রহমান ঢালী আর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন ইতিহাসবিদ মেসবাহ কামাল।
জন্মের প্রারম্ভেই মৈত্রী লড়াইয়ে নামে স্বৈরশাসক সামরিক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে। ওই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পোস্টার টানাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম গ্রেপ্তার হন মৈত্রী সেনারা। তারপরেও লড়াই জারি রেখেছে। ৪১ বছরে বহু লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছে মৈত্রী। ‘মৈত্রী’ লড়াইয়ের সংগঠন, অধিকার আদায়ের সংগঠন, প্রতিবাদে গর্জে ওঠার সংগঠন।
কেবল সংগ্রামে নয়, জনজীবনের নানামুখী সঙ্কটেও মানুষের পাশে ‘মৈত্রী’ ছিল, আছে এবং থাকবে। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালে ‘মৈত্রী’ জেলায় জেলায় ব্রিগেড গড়ে অ্যাম্বুলেন্স, অক্সিজেন, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার সহ স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে ছুটেছেন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। খাবার তুলে দিয়েছেন অনাহারী মানুষের মুখে। ফলে ‘মৈত্রী’ শিক্ষার অধিকার আদায়ে শিক্ষার্থীদের প্রাণের সংগঠন এবং গণমানুষের মুক্তির লড়াইয়ে মানুষের পাশে থাকার সংগঠন।
কিন্তু দীর্ঘ ৪১ বছরের পথ চলা সংগ্রামের লক্ষ্য পূরণে প্রিয় ‘মৈত্রী’ কে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে আরো এগিয়ে যেতে হবে। স্বপ্নের বাংলাদেশ ও শিক্ষা ব্যবস্থা কায়েমর লক্ষ্যে নিজেদের জীবন বিলিয়ে উত্তসূরীরা যে বাংলাদেশ রেখে গেছেন, সেখানে আজ শকুনের বসবাস। চারিদিকে অশান্তির বাজনায় ঘুম ভাঙ্গে প্রিয় মানুষের লাশ দেখে। মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাসবাদ এখনো আমাদের পথ চলার সঙ্গী। রাষ্ট্রের অসংগতি সবখানেই দৃশ্যমান, মানুষের মৌলিক অধিকার মুখে আছে, বাস্তবে নেই। নিত্যপণ্য সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। জনতা জিম্মি পুঁজিবাদী সিন্ডিকেটের কাছে। করোনার ত্রাণ আমলাতন্ত্রের পকেটে, সড়ক-মহাসড়ক যেন মৃত্যু ফাঁদ, প্রশ্নবিদ্ধ শিক্ষার মান। বাড়ছে বেকার মিছিল। দাবি আদায়ে শ্রমিক মাঠে নামলেই খেতে হয় লাঠি-গুলি-টিয়ারসেল। মাথাপিছু জাতীয় গড় আয় বাড়লে তাতে গরিব-মধ্যবিত্তের লাভ হয় নি, লাভ গেছে বড়লোকের পকেটে। ব্যাংক গুলো দেউলিয়াত্বের অপেক্ষায়, ডিজিটাল আইন আজ গলার কাঁটা, নির্বাচনী উৎসব নয়, চলছে ক্ষমতা বনাম ক্ষমতার খেলা। ফলে লড়াইয়ের পরীক্ষিত সংগঠন ছাত্র মৈত্রী’র লড়াই এখনো অব্যাহত। এ লড়াই জারি না থাকলে মানুষের সত্যিকার মুক্তি আসবে না। তাই লড়াইয়ে অবিচল থাকতে হবে-এই হোক এবছর বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী’র ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। শুভ জন্মদিন প্রিয় ছাত্র মৈত্রী।

লেখকঃ রাজনৈতিক শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।

সর্বশেষ