শনিবার,২৭,এপ্রিল,২০২৪
30 C
Dhaka
শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
Homeসীমানা পেরিয়েএ কান্নার শেষ কোথায়!

এ কান্নার শেষ কোথায়!

রক্তাক্ত ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা

এম এইচ নাহিদ: “ফিলিস্তিনে হামলা থামানোর জন্য আমরা ঘড়ি ধরে বসে নেই”-বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ এবং যুদ্ধ বন্ধের আহ্বানের পরেও দাম্ভিকতার সাথে এমন উক্তি করেছিল বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশ্বনেতাদের চাপে অবশেষে ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। কিন্তু টানা ১১ দিনে ইসরায়েলি হামলায় ফিলিস্তিন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। মুহুর্মুহু বোমাবৃষ্টিতে ঝরেছে অনন্ত ২৪০ প্রাণ। যার মধ্যে ৬৩ জনই শিশু। ইসরায়েলি সৈন্যদের বর্বর হামলায় রক্তাক্ত ফিলিস্তিনের আকাশে এখনো কান্নার আওয়াজ। আন্তর্জাতিক নানামুখী চাপে যুদ্ধবিরতি হলেও ফিলিস্তিনিদের এ কান্নার শেষ কোথায় তা বলতে পারছে না কেউ। বছরের পর বছর এভাবেই প্রাণ দিতে হয় ফিলিস্তিনিদের। নিজভূমে তারা আজ পরবাসী। স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রত্যাশা আজো পূরণ হয় নি। কবে হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আপাতত বোমা হামলা ও ইসরায়েলি আক্রমণ থেমে গেলেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটছে না আরব বিশ্বের এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের।
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা ও গণহত্যা নতুন নয়। এ বর্বরতা চলছে বহু বছর থেকেই। এবারের হামলা মূলত জেরুজালেমে বসবাসরত কয়েকঘর আরব পরিবারকে কেন্দ্র করে। ইসরায়েল তাদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা করছিল। প্রতিবাদে সংগঠিত হতে থাকেও আরবরাও। হামাস জানিয়ে দেয় আরবদের বহিষ্কার করা হলে তারা বসে থাকবে না। অন্যদিকে ইসরায়েলের নির্বাচনে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়ে তাকে বাদ দিয়ে গঠিত সরকার ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠে নেতানিয়াহু। ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষায় তিনি’ই যোগ্য প্রমাণ করতেই এ হামলা। হামলায় নিহত হলেন ৬১ জন নিষ্পাপ শিশু সহ ২৪০ জন নিরীহ ফিলিস্তিনি। আহত হাজারো মানুষ। ৫২ হাজারের বেশি মানুষ আজ গৃহহারা। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত ৮ শতাধিক ঘরবাড়ি। ধ্বংস হয়েছে ৫০ টির বেশি স্কুল। হুমকির মুখে পড়েছে ৪২ হাজার শিক্ষার্থীর স্কুল জীবন। ইসরায়েলের বর্বরতা যাতে বিশ^বাসী দেখতে না পারে তার জন্য দ্যা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও আল জাজিরা সহ কয়েটি গণমাধ্যম অফিস বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ওদের হাত থেকে রক্ষা পায় নি ঘুমন্ত শিশুও। ধ্বংসস্তুপের নিচে জীবিত মানুষের আর্তনাত। ক্ষোভে উত্তাল বিশ^বাসী। যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায় চীন ও রাশিয়া। একই আহ্বান জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) মাধ্যমে তদন্ত করে এই বিবাদের অবসান চায় ইসলামিক সংস্থা (ওআইসি) । নিন্দা জানায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সৌদি আরব, কাতার ও মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও যুক্তরাষ্ট্রকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়। ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য সুরক্ষাবাহিনী গঠনের আহ্বান করে তুরস্ক। শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’ বলে মন্তব্য করলেও মার্কিন নাগরিক, নিজ দলের সিনেটর এবং আন্তর্জাতিক চাপে তিনিও যুদ্ধ বিরতির আহ্বান জানান। ফলে নেতানিয়াহু দাম্ভিকতা ভাব দেখালেও যুদ্ধবিরতি করতে বাধ্য হয়।
কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য এ বিরতি স্থায়ী সমাধান নয়। এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের কান্নাও থামবে না। এই যুদ্ধ বিরতি কতটা স্থায়ী হয় তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন হামাস নেতা বাসেম নায়েম। তিনি বলেছেন, “ফিলিস্তিনিদের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত না করে বা ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ না করে এ যুদ্ধবিরতি ভঙ্গুর হবে।” সত্যি তাই। ২০১৪ সালেও ২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি হত্যার পরও যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। কিন্তু স্থায়ী সমাধান ফিলিস্তিনিরা পান নি।
কিন্তু কেন? বিশ্লেষকরা বলছেন, আরব বিশে^র অনঐক্য, নীরবতা, গণতন্ত্রহীনতা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলকে অন্ধ সমর্থন’ই ফিলিস্তিনিদের কান্নার মূল কারণ। দায়ি অথর্ব জাতিসংঘও। এবারের হামলায় দুনিয়ার সবাই প্রতিবাদ করেছে। তারপরেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় নি। কারণ মানবতার জয়গান গাইলেও অনেকেরই তা ছিল লোক দেখানো। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির কথা বলেছে অনেকটা চাপে পড়ে। এই যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই জাতিসংঘ সর্বসম্মতভাবে বিবৃতি দিতে পারে নাই। যুদ্ধের কিছু দিন আগে ইসরায়েলের কাছে দেশটি ৭৩৫ কোটি মার্কিন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার, অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এবং তেল সম্পদ লুণ্ঠনের আমেরিকার বড় অস্ত্র ইসরায়েল। অন্যদিকে আরব রাষ্ট্রগুলোর অনেকে প্রতিবাদ করলেও তা জোরালো ছিল না। বাহারাইন, মরোক্ক এবং সুদান ইসরায়েলি বর্বরতায় কোনো নিন্দা জানায় নি। আমিরাত ইসরায়েলি হামলার নিন্দা করলেও হামাসের ক্ষেত্রে কঠির শব্দ ব্যবহার করেছে, যা ইসরায়েলের পক্ষেই প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো গাজায় হামলা বন্ধের আহ্বান করেছে ঠিকই,তবে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলে নি। সৌদি আরব বরাবরই যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে ইসরায়েলকেই সমর্থন করেছে। ২০১৮ সালে সৌদি যুবরাজ যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনিদের করা সমালোচনা করে বলেছিলেন, “ দাবি দাওয়া নিয়ে ফিলিস্তিনিদের নমনীয় হতে হবে।” গত বছর আরব-আমিরাত ও বাহারাইন ইসরায়েলের সাথে সমঝোতা চুক্তি করে। নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মতে আরব দেশগুলোর সবচেয়ে বড় শত্রু হামাস। সেই কারণে হামাস নিধনে আরবরা গোপনে ইসরায়েলকে উৎসাহ দেয়। সিএনএন-এর ভাষ্য, “ সৌদি আরব, মিসর, জর্ডান ও উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো মনে করে হামাস ধ্বংস হলে প্রত্যেকের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে।” তারা মনে করে ইরানকেও দু’ঘা দেওয়া যাবে। আরব রাষ্ট্রগুলোর বড় ভয় ইরান। বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য এক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় মুসলিম দুনিয়ার টানাপোড়েনের সুযোগ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের এই অনঐক্যে’ই ফিলিস্তিনিদের কান্নার আওয়াজ থামছে না। ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূতও গণমাধ্যমকে বলেছেন, “ আরব বিশ^ বিভক্ত এবং এই বিভক্তি অনেক দিনের। আরবদের মধ্যে বিভক্তি আমাদেরকে দুর্বল করে দিচ্ছে। ফিলিস্তিনিদেরকে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে দুর্বল করছে।” আরব বিশে^র অনঐক্যের কারণে জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারে না ওআইসি।
ফলে যতদিন আরব বিশ্বের ঐক্য না হবে, তারা ইসরায়েলকে চাপ প্রয়োগ না করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নতজানু নীতি পরিহার না করবে, ততোদিন ফিলিস্তিনের কান্না থামবে না। এ সংকটের স্থায়ী সমাধানও হবে না-এমন মন্তব্য আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের।

সর্বশেষ