শুক্রবার,২৬,এপ্রিল,২০২৪
32 C
Dhaka
শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়কমরেড লেনিন ও বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন

কমরেড লেনিন ও বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন

।। শরীফ শমশির ।।

শরীফ শমসির

বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের প্রভাব কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের পরপরই ভাবা হয়। কারণ মার্কস-এঙ্গেলসের চিন্তাকে প্রসারিত করেই ১৯১৭-তে লেনিন নেতৃত্ব দিয়ে রুশ বিপ্লবে সফল হয়েছিলেন। মানব ইতিহাসে রুশ বিপ্লব যা বলশেভিক বিপ্লব নামেও খ্যাত তার প্রভাব সুদূর প্রসারী। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের চিন্তাকে ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তা প্রসূত বলে অনেকে সীমাবদ্ধ করতে চাইলেও কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের চিন্তার সূত্র ইউরোপীয় শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; পশ্চাদপদ রাশিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য উপনিবেশগুলোর মেহনতি মানুষের মুক্তির বিষয়টিও তাদের চিন্তার পরিধির মধ্যে ছিল। সেই চিন্তাসূত্রকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে কমরেড লেনিন রাশিয়ার মতো জার শাসিত প্রায় পশ্চাদপদ মধ্য এশিয়ায় বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই বিপ্লবের রণকৌশল ও রণনীতি তৈরি করতে লেনিনকে শুধু মধ্য এশিয়া নয় দূর এশিয়ায়ও নজর দিতে হয়েছিল। আর এশিয়ার বৃটিশ ভারতের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডেও ১৯১৭ সালের বিপ্লবের হাওয়া এসে লেগেছিল। প্রাচ্যের অন্যান্য নিপীড়িত জনগণের মতো ভারতবাসী তথা বাঙালিরাও রুশ বিপ্লবের মধ্যে তাদের জাতীয় মুক্তির পাশাপাশি শ্রেণীশোষণের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিল। আর এই স্বপ্নে কমরেড লেনিনের নাম জড়িয়ে পড়েছিল।
ব্রিটিশ শাসকশ্রেণী অনুভব করেছিল ভারতবর্ষে রুশ বিপ্লবের হাওয়া এসে লাগলে উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন তীব্র হবে এবং তা আর শুধু জাতীয় মুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা তাই বিভিন্ন সীমান্তে বিশেষ করে আফগান সীমান্তে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করে। তারপরেও ভারতবর্ষীয় যারা ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন করছিলেন তারা তাসখন্দ গিয়ে পৌঁছে এবং রুশ বিপ্লবের নেতাদের সংস্পর্শে আসেন। প্রবাসে এই তৎপরতায় মেক্সিকো থেকে সংযুক্ত হয়েছিলেন আরেক বাঙালি এম এন রায়। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের গোড়ার দিকে প্রবাসে বিশেষ করে তৃতীয় আন্তর্জাতিক তথা কমিনটার্নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সংগঠক, তাত্ত্বিক ও আদর্শগত নেতা ছিলেন কমরেড লেনিন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের গোড়ায় সমাজতন্ত্রের প্রতি দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সুবিধাবাদী নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ধ্বসে পড়ার পর শ্রমিক আন্দোলনে যে ভাঙন দেখা দেয় তার বিপরীতে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার তাগিদ থেকেই কমরেড লেনিন ১৯১৯ সালে এক ঐতিহাসিক আবশ্যকতায় তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠন করেন।
তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় মস্কোয় ১৯১৯ সালের ২-৬ মার্চ। এই কংগ্রেসে গৃহীত হয় সারা বিশ্বের প্রলেতারিয়দের প্রতি ঘোষণাপত্র, তাতে বলা হয় সমস্ত দেশের মেহনতিদের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ও সংহত করবে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক। এছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের সুবিধাবাদের স্বরূপ উদ্ঘাটন, নবীন কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর শক্তি বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের রণনীতি ও রণকৌশল রচনা করার ঘোষণা করা হয়। তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠনের মাধ্যমে কমরেড লেনিন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। এই তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সফলতা ছিল উপনিবেশিক দেশগুলোর সঙ্গে এর সম্পর্ক স্থাপন। ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশগুলোর আত্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার ও জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে সমর্থন করে তৃতীয় আন্তর্জাতিক এসব দেশের আন্দোলনে সাম্যবাদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। লেনিন বিশ্বের শ্রমিক আন্দোলনের মহৎ সহযোগি হিসেবে কৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করে তৃতীয় আন্তর্জাতিকে যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তা ছিল অনন্য এক বিপ্লবী আবিস্কার। এই কৃষকরা যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নকে রক্ষা করেছিল তেমনি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে কৃষকদের বিপ্লবী ভূমিকাকে তিনি নতুনভাবে সূত্রায়িত করেন। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের কারণে উপনিবেশের সাম্যবাদী আন্দোলনও সাহস পায় এবং বিশ্বে তাদের সমর্থনে তৃতীয় আন্তর্জাতিক এগিয়ে আসবে এই বিশ্বাসও তাদের জন্মায়। আর এভাবেই দেখা যায় কমরেড লেনিন ঔপনিবেশিক দেশগুলোর আশাপ্রদানকারী নেতায় পরিণত হন। ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম ছিল না। দেখা যাবে তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে কমরেড লেনিন ভারত সম্পর্কেও নীতি প্রণয়ন করছেন।
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে (১৯২০, ১৯ জুলাই-৭ আগস্ট) রচিত হয় কমিন্টার্নের কর্মসূচি, রণকৌশল ও সাংগঠনিক মূলনীতি। এই কংগ্রেসে অংশ নিয়েছিল ৩৭টি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও শ্রমিক সংগঠনের প্রায় দুই শতাধিক প্রতিনিধি। কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে কমরেড লেনিন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও মূল কর্তব্য নিয়ে ভাষণ দেন। পরের অধিবেশনগুলোতে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ে ভাষণ, জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নে প্রতিবেদন এবং পার্লামেন্ট প্রথা ও অন্যান্য বিষয়ে বক্তৃতা দেন। এই কংগ্রেসের ভিত্তিরূপে নেয়া হয়েছিল লেনিনের চিরায়ত রচনা “কমিউনিজমে বামপন্থার শিশুরোগ”। প্রথম প্রশ্নে কংগ্রেস সিদ্ধান্ত হিসেবে অনুমোদন করে লেনিন প্রস্তাবিত “প্রলেতারিয় বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তির প্রধান ও মূল হাতিয়ার হবে কমিউনিস্ট পার্টি।” এই কংগ্রেসে আরো অনুমোদিত হয়েছিল লেনিন প্রস্তাবিত ‘জাতীয়-ঔপনিবেশিক ও কৃষি প্রশ্ন’। জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্ন বিষয়ক রিপোর্ট চূড়ান্ত অনুমোদন হয়েছিল সংযোজনী থিসিসসহ। কমরেড লেনিন ২৬ জুলাই, ১৯২০-এ রিপোর্টটি উপস্থাপন করেন এভাবে, “কমরেডগণ, আমি শুধু একটা ছোটো মুখবন্ধ করব, তারপর আমাদের কমিশনের সেক্রেটারি কমরেড মারিং একটা বিশদ রিপোর্ট দিয়ে জানাবেন থিসিসে কী কী বদল আমরা করেছি। তারপরে বলবেন কমরেড রায় (এম এন রায়), তিনি সংযোজনী থিসিসটি সূত্রবদ্ধ করেছেন। সংশোধিত প্রাথমিক থিসিস (লেনিন কর্তৃক লিখিত) এবং সংযোজনী থিসিস-উভয়ই আমাদের কমিশন সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করেছে। অতি প্রধান, প্রধান সমস্ত প্রশ্নেই এইভাবে আমরা পরিপূর্ণ একমতে পৌঁছেছি।”
কমরেড লেনিন এবং এম এন রায়ের থিসিসে একটা বড় প্রশ্নে বিতর্ক হয়। প্রশ্নটি ছিল ঔপনিবেশিক বা পশ্চাদপদ দেশে ‘বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক’ আন্দোলনকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এবং কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সমর্থন করবে কি না? এম এন রায়ের বক্তব্য ছিল পশ্চাদপদ দেশে বিশেষ করে ভারতে যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলন হচ্ছে তা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নয় ফলে এটা সমর্থনযোগ্য নয়। এই বিতর্ক সমাধান হয় একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে; বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের স্থলে জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলন বলা হবে। এই বিতর্ক অবসানে কমরেড লেনিন লিখেছেন, “প্রত্যেকটি জাতীয় আন্দোলনই যে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলন বৈ নয়, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, কেননা পশ্চাৎপদ দেশের জনসমষ্টির অধিকাংশই হল কৃষক, যারা বুর্জোয়া-পুঁজিবাদী সম্পর্কের প্রতিনিধি। এইসব পশ্চাদপদ দেশে যদি আদৌ প্রলেতারীয় পার্টির উদ্ভব সম্ভব হয়, তবে তারা কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে নির্দিষ্ট সম্পর্ক স্থাপন না করে, কার্যক্ষেত্রে তাদের সাহায্য দান না করে কমিউনিস্ট রণকৌশল ও কর্মনীতি অনুসরণ করতে পারে- একথা ভাবা হবে ইউটোপিয়া।”
সবশেষে তিনি লিখেছেন, “কমিউনিস্ট হিসেবে আমাদের উপনিবেশের বুর্জোয়া মুক্তির আন্দোলনগুলোকে সমর্থন করা উচিত ও করব কেবল সেই ক্ষেত্রে, যখন এগুলো প্রকৃতই বিপ্লবী আন্দোলন, যখন কৃষক সম্প্রদায় ও ব্যাপক শোষিত জনগণকে বিপ্লবী প্রেরণায় শিক্ষিত ও সংগঠিত করার কাজে ঐ আন্দোলনের প্রতিনিধিরা আমাদের বাধা দেবে না।”
কমিন্টার্নের এই অধিবেশনে রায়-লেনিন তর্ক থেকে যেটা বেরিয়ে আসলো তা হলো ঔপনিবেশিক দেশে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলনে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে নিপীড়িত কৃষক ও জনসাধারণের সংগ্রাম বৈপ্লবিক আন্দোলনে প্রবাহিত হবে। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের এই কংগ্রেসে বামপন্থার শিশুরোগ, জাতীয়-ঔপনিবেশিক প্রশ্ন ছাড়াও কৃষি ও ঔপনিবেশিক শক্তির দেশের সুবিধাবাদী শ্রমিক আন্দোলনের বিরুদ্ধেও আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
তৃতীয় আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিন কর্তৃক উত্থাপিত ও কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত এসব সিদ্ধান্ত ভারতবর্ষে কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল তা গবেষণা সাপেক্ষে এম এন রায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে কীভাবে এসব সিদ্ধান্ত অবহিত করেছে তার সঠিক মর্ম পাওয়া যায় না। বরং কমরেড মুজফ্ফর আহমদ তার স্মৃতি কথায় যা লিখেছেন তাতে দেখা যায় এম এন রায় যথাযথ ভূমিকা পালন করেন নি। এবং শেষ পর্যন্ত তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আর থাকেনও নি। কমরেড মুজফফর আহমদের বয়ানে দেখা যায় ১৯২৫ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ রূপ পেলেও তাতে জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নে স্পষ্ঠতা ছিল না। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হলেও তার আগ পর্যন্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অনেক বীরত্বপূর্ণ লড়াই-সংগ্রামের গৌরবজনক উত্তরাধিকার হলেও জাত-পাতের ভারতে, কৃষকদের ভারতে তেমন কোনো বৈপ্লবিক জাগরণ তুলতে পারে নি। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন, কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা-সংগ্রাম, বৃটিশবিরোধী জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে সোভিয়েত সমর্থনে মিত্রশক্তির সমর্থন ইত্যাদি প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা বিভাগপূর্বকালে বিতর্ক এড়াতে পারে নি।
১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্র তৈরি হলে পূর্ব বাংলা যা এখন বাংলাদেশ নামে পরিচিত তা পাকিস্তানের অর্ন্তভুক্ত হয়। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে পূর্ব বাংলা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এক হাজার মাইল ভৌগলিক দূরত্বে শুধু ধর্মীয় নৈকট্য নিয়ে। তাই এ রাষ্ট্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বায়ত্বশাসন ও জাতীয় মুক্তির প্রশ্নটি নতুনভাবে উত্থাপিত হয়। এই সময় পঞ্চাশের দশকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে পূর্ব বাংলায়ও বামপন্থী প্রবণতা বেশি ছিল। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি যথাযথ ভূমিকা পালন করলেও ধীরে ধীরে বামপন্থা আবার মাথা চাড়া দেয়। ষাটের দশকে স্বায়ত্ত্বশাসন ও জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে লেনিনের সূত্রগুলো কমিউনিস্ট অনুসরণ করেছিল কী না তা আজ কোটি টাকার প্রশ্ন। আওয়ামী লীগ ভেঙ্গে ন্যাপ গঠন, সর্ব পাকিস্তান বিপ্লবের তত্ত্ব, পেটি বুর্জোয়া পার্টিতে প্রকাশ্যে কাজ করার কৌশল, কমিউনিস্ট পার্টিকে গোপন রাখতে বাধ্য হওয়া সর্বোপরি চীন-সোভিয়েত বির্তকে পার্টি ভাঙ্গা লেনিনীয় নীতিমালার ব্যত্যয় কী না তা পর্যালোচনা করা দরকার। যদিও পার্টিগুলো এসব বিষয় নিজ নিজ দলিলে পর্যালোচনা করেছেন। এসব পর্যালোচনা দলের উর্ধ্বে উঠেছে কী না তাও দেখা দরকার।
বিশেষ করে ষাটের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভারতের ‘নকশাল’ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব যথেষ্ঠ ক্ষতি করেছে। এ সময় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হয়ে একদল সোভিয়েত নির্ভর রাজনীতি করেছে যা পেটিবুর্জোয়ার অধিক নয় আর অধিকাংশ চীনাপন্থী রাজনীতি নকশালের ছদ্মাবরণ ছাড়া আর কিছু ছিল না। জাতীয় প্রশ্নে অর্থাৎ পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলার মুক্তির প্রশ্নে কমিউনিস্টরা মোটা দাগে তিন ভাগে বিভক্ত ছিল: এক ভাগ মস্কোপন্থী, দ্বিতীয় ভাগ নকশাল এবং তৃতীয় ভাগ জাতীয় মুক্তির মধ্যে বিপ্লবী সম্ভাবনা তৈরি করার চিন্তা করেছিল। এই তৃতীয় পন্থাই মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে প্রবাসে গঠন করেছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। বিস্তারিত আলোচনা ব্যতিরেখেও একথা বলা চলে যখন নকশালপন্থীরা গণসংগঠন বিলুপ্ত করে বামপন্থার শিশুরোগে আক্রান্ত হয়ে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যায়িত করছিল; যখন মস্কোপন্থীগণ সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায় জাতীয় মুক্তির জাতীয়তাবাদী ধারায় সংযুক্ত হয়ে পড়েছিলো তখন জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি লেনিনের জাতীয় ও ঔপনিবেশিক নীতির আলোকে জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে বৈপ্লবিক শক্তির উত্থানের জন্য কাজ করেছে। জয়-পরাজয় ইতিহাসের বিষয় কিন্তু সঠিক অনুধাবন ইতিহাসকে পাল্টাবার শক্তি। বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির সময় আমরা দেখি চীনের অনুকরণে বা মাওসেতুঙের চিন্তাকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে রিসার্চ বা গেরিলা যুদ্ধ করার প্রবণতা প্রবল হয়ে উঠেছিল। পার্টিগুলোর মধ্যে সত্তরের দশকে লেনিনের চিন্তার অনুসরণ খুব কমই ছিল; কোথাও কোথাও ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশে নানা চড়াই-উৎরাই, ভাঙন, দ্বন্দ্ব মিলিয়ে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা আজ বহুধা বিভক্ত শুধু নয়, শক্তি হিসেবেও ক্ষীয়মান। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কমরেড লেনিন নতুন করে পথ দেখাতে পারেন। কমরেড লেনিনের সৃজনশীল অধ্যয়ন ও প্রয়োগ বাংলাদেশের বিপ্লবী শক্তিকে শক্তিশালী করতে পারে। সময়ের বিবেচনায় বামপন্থীদের ঐক্যের চেয়েও জরুরি হলো বামপন্থী আন্দোলনকে বেগবান করা। যে ভারতবর্ষকে নিয়ে লেনিন ভেবেছিলেন, কমিন্টার্নে যেসব নীতিমালা গ্রহণ করেছিলেন যেমন বামপন্থার শিশুরোগ পরিহার করা, জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে কৃষক-শ্রমিকের বৈপ্লবিক মৈত্রী, শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালীকরণ, সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা করা, আন্তর্জাতিক সুবিধাবাদী শ্রমিক আন্দোলনের বিরোধীতা করা, বুর্জোয়া নির্বাচন ব্যবস্থাকে বামপন্থী ত্যাগের মাধ্যমে বিপ্লবের প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা এবং সর্বোপরি শ্রমিক ও নিপীড়িত মানুষের ঐক্য নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে বামপন্থীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাংলাদেশে বিপ্লব কোন পথে আসবে। কিন্তু লেনিন একটি পর্যবেক্ষণ আজো প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উদ্ধৃত করলাম।
“সাম্রাজ্যবাদের যুগে প্রত্যক্ষ-নির্দিষ্ট তথ্যের নির্ণয় করা এবং সমস্ত ঔপনিবেশিক ও জাতীয় সমস্যার সমাধানে বিমূর্ত প্রত্যয় থেকে নয়, প্রত্যক্ষ বাস্তবের ঘটনা থেকে এগুলো প্রলেতারিয়েত ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের পক্ষে বিশেষ জরুরি।” বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লব দরকার যা এখনো ইতিহাসের গর্ভে মনে হলেও কমরেড লেনিনের চিন্তা বা প্রস্তাবসমূহ অধ্যয়নের আলোকে তার ভূমিকা হওয়া সম্ভব। কমরেড লেনিনের জন্মজয়ন্তীতে এই আশাবাদ বাস্তবসম্মত। কমরেড লেনিন বেঁচে থাকুক শ্রমিক ও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

সর্বশেষ