বৃহস্পতিবার,২৮,মার্চ,২০২৪
24 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪
Homeজাতীয়করোনাময় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বর্তমান বাস্তবতা

করোনাময় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বর্তমান বাস্তবতা

রাজশাহী প্রতিনিধিঃ গত সোমবার ৯ আগস্ট ছিল আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। করোনায় বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ৩০ লাখ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এবং এদেশের প্রগতিশীল ও সাংস্কৃতিক মানুষ পূর্বের মতো জাকজমকপূর্ণভাবে দিবসটি পালন না করলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ বিষয়ে তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। জাতিসংঘ ৯ আগস্ট বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে পালন করে আসছে ১৯৯৪ সাল থেকে।

বিশ্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা এবং তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে সংরক্ষণ ও চর্চাকে অব্যাহত রাখতে জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী দিবস উদ্যাপনের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসনীয়।

বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও তাদের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য জাতিসংঘ ও আদিবাসী জাতি এক নতুন অংশীদারিত্ব শিরোনামে ১৯৯৩ সালকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা করে। আদিবাসীদের অধিকার, মানবাধিকার ও স্বাধীনতাসংক্রান্ত বিষয়সমূহ নিয়ে ১৯৮২ সালের ৯ই আগস্ট জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠীবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনটিকে স্মরণ করার জন্য জাতিসংঘ ১৯৯৪ সালের ২৩শে ডিসেম্বর ৯ই আগস্টকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অবহেলিত, সুযোগবঞ্চিত আদিবাসী জাতিসমূহের সমস্যাগুলোর ওপর মনোযোগ আকর্ষণ করা এবং তাদের অধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা। আদিবাসীদের সার্বিক অবস্থার উন্নতির লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালে ১৯৯৫-২০০৪ সাল পর্যন্ত সময়সীমাকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক এবং ২০০৪ সালে ২০০৫-২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়সীমাকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেও বেসরকারিভাবে উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংগঠনসমূহের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে। এখানে বাংলাদেশের আদিবাসীদের অধিকার, সংস্কৃতি, ভূমি-সমস্যার সমাধানসহ সাংবিধানিক স্বীকৃতির মতো বিষয়সমূহের ওপর সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আলোকপাত করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে প্রায় ৫৫টির বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে এবং প্রায় ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী বাস করছে। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সময়ে উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে তাদের আখ্যায়িত করেছে। এছাড়াও ২০১০ সালে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে, যদিও এই জনগোষ্ঠী উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে নয় বরং আদিবাসী হিসেবেই নিজেদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতে চায়।

জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করলেও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনে সেই উন্নয়নের ছোঁয়া তেমন একটা লাগেনি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের গবেষণা প্রতিবেদন ২০১৩-এর তথ্য মতে সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে স্যানিটেশন কভারেজ ২৪.২ শতাংশ যেখানে বাংলাদেশের স্যানিটেশন কভারেজ বিবিএস ২০১১-এর তথ্য মতে ৬২.৩ শতাংশ।

এছাড়াও আদিবাসীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার চিড়াকুটা গ্রামে ২০১৫ সালে সান্তালদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ২০১৬ সালে সান্তাল পল্লী উচ্ছেদ, জোরপূর্বক আদিবাসীদের ভূমি দখল, বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে আদিবাসীরা উদ্বিগ্ন। অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, শিক্ষার অনগ্রসরতা, পেশাগত বৈচিত্র্যের অভাব, ভূমিহ্রাস, অসচেতনতা, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আদিবাসীদের পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ না থাকা, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন না করা ইত্যাদি বহুবিধ কারণে আদিবাসীদের উন্নয়ন আশানুরূপ নয়। তাই তাদের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বিত আদিবাসীবান্ধব উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি জাতিসংঘ ঘোষিত আদিবাসী অধিকারসংক্রান্ত ঘোষণাপত্রের অনুসমর্থন ও বাস্তবায়ন, আইএলও কনভেনশন নং ১০৭ বাস্তবায়ন ও ১৬৯ নং কনভেনশন অনুস্বাক্ষরের বিষয়ে যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।

২০২০ সালে পার্লামেন্টে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা ‘আদিবাসী অধিকার আইন’ বিষয়ে একটা বিল উপস্থাপন করেছিলেন। সেটা আলোর মুখ দেখেনি। মাতৃভাষায় শিক্ষা খুবই জরুরি। প্রাক-প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা অর্জনের সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ১০ বছরেও এটা বাস্তবায়িত হয়নি। পাহাড় ও সমতল- সব জাতিসত্তার শিশুদের শিক্ষার জন্য পৃথক একটা ইনস্টিটিউট করা দরকার। সেখান থেকে সাঁওতাল, মুন্ডা, গারো, চাকমা ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর ভাষার বইপুস্তক প্রকাশিত হবে। এটি জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে সম্পূর্ণ আলাদা থাকবে। এই মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট শুধু বইপুস্তক রচনা করবে, তা নয়, ছোট ছোট ভাষাকেও বাঁচিয়ে রাখবে।’

সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমিকমিশন তাদের ভূমিসংক্রান্ত জটিলতার নিরসন করতে পারে। আর্থসামাজিক উন্নয়নকল্পে দক্ষতাবৃদ্ধিসহ আদিবাসী যুব সমাজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব ও জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে আদিবাসী নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ, জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ প্রভৃতি বিষয়ে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ অত্যন্ত জরুরি।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাতে যে সকল লক্ষ্য ও টার্গেট নির্ধারিত হয়েছে সেখানেও আদিবাসী জাতিসমূহের উন্নয়নের বিষয়টি আরো বিশদভাবে আলোচিত হওয়া উচিত। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম অঙ্গীকার হচ্ছে ‘খবধারহম হড় ড়হব নবযরহফ’ অর্থাৎ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্য থেকে কোনো জাতিগোষ্ঠীই বাদ পড়বে না। সেজন্য সকল সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনসমূহের একসঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি।

সর্বশেষ