শুক্রবার,২৯,মার্চ,২০২৪
24 C
Dhaka
শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতকার্ল মার্ক্সের জন্মদিনে

কার্ল মার্ক্সের জন্মদিনে

।। খান আসাদ ।।

খান আসাদ

কার্ল মার্ক্স ( ৫ মে, ১৮১৮ – ১৪ মার্চ, ১৮৮৩)। আজ তাঁর জন্মদিন।  

তিনি লিখেছেন সাম্যবাদের ঘোষণা পত্র (কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো)। তিনি লিখেছেন “পুঁজি” (ডাস ক্যাপিটাল)। পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে তিনি এমনভাবে ব্যবচ্ছেদ করেছেন, যা আর কেউ করেনি। মানুষের সাম্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর মত যৌক্তিক আশাবাদও মনে হয় অন্য কোন চিন্তাবিদ মানুষের সামনে তুলে ধরেনি। সমাজবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ, সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন ও পরিবর্তনের সূত্র বর্ণনার মধ্যদিয়ে মানুষকে দিয়েছেন এক ভবিষ্যতের অপার আশাবাদ। 

তিনি এমন একজন চিন্তাবিদ, যিনি দুনিয়াটা বদলাতে চেয়েছিলেন। ফলে, দুনিয়াকে যারা পুরাতন ব্যবস্থায় আটকে রাখতে চান, নিজেদের শ্রেণি স্বার্থে, এবং দুনিয়াকে যারা বদলে ফেলাতে চান, সাম্য ও শান্তির এক সমৃদ্ধ ভবিষ্যতে, সবাইকেই মার্ক্সকে নিয়ে ভাবতে হয়। মার্ক্সের চিন্তা ও কাজের প্রাসঙ্গিকতা তাই আরও অনেক দিন থাকবে, যতদিন না মানুষ একটি সাম্যবাদী সমাজে পদার্পণ করছে। ভবিষ্যতে, এই মানুষটির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হবে, মানবমুক্তির জন্য তাঁর নিরলস সাধনাকে স্মরণ করে।

প্রুসিয়ার ট্রিয়েরে জন্ম ৫ মে, ১৮১৮। ১২ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা। ১৮৩০ থেকে ১৮৩৫, ট্রিয়েরেতেই পড়েছেন, জেসুইট হাই স্কুলে। রাজনীতির প্রথম পাঠ, ১৮৩২ সালে স্কুলে পুলিশ তল্লাসি হয়েছিল, কারণ স্কুলের অধ্যক্ষ ছিলেন একজন কান্টিয়ান লিবারেল। ১৮৩৫ এর অক্টোবরে, মার্ক্স বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ছাত্র জীবন খুব সুখের হয়নি। শান্তি ভঙ্গের কারণে একবার গ্রেফতার হন। দুই সেমিস্টার পরে, চলে যান বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে, আইন ও দর্শন পড়তে। এখানেই হেগেলের চিন্তার সাথে পরিচয়।

১৮৩৬ সালে পরিচয় জেনীর সাথে, মার্ক্সের চেয়ে চার বছরের বড়। বাগদান করেন গোপনেই। রাজনৈতিক সক্রিয়তা ছিল পুরোদমে। ১৮৪১ সালে ইয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে শিক্ষকতার পেশায় যোগ দিতে দেয়া হয়নি।  ১৮৪২ সালে রাইনিশে সাইটুং নামের একটি উদারনৈতিক পত্রিকার সম্পাদক হন। পরের বছর তিনি জেনীকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করে, প্যারিসে চলে যান।

১৮৪৩ সালে প্যারিস ছিল ইউরোপের বিপ্লবী রাজনীতির কেন্দ্র। এখানেও পত্রিকা প্রকাশের চেষ্টা করেন, এবং ১৮৪৪ সালে পরিচয় হয় ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের সাথে। দুই জনের বন্ধুত্ব এক নোতুন কর্মোদ্যোগের সূচনা করে। ১৮৪৫ সালে দুজনে মিলে লিখে ফেলেন, “দি হোলী ফ্যামিলি”। প্যারিস থেকেও বিতাড়িত হলেন। চলে গেলেন ব্রাসেলসে। এই সময় পরিচিত হলেন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের সাথে। লিখলেন, “দি জার্মান আইডিওলজি”।

১৮৪৬ সালে ইউরোপের সমাজতন্ত্রীদের সংগঠিত করতে, গঠন করলেন, কম্যুকিস্ট করেস্পন্ডেন্স কমিটি। ১৮৪৭ সালে বৃটেনের সমাজতন্ত্রীরা সম্মেলন করে, গঠন করলেন কমিউনিস্ট লীগ। মার্ক্স ও এঙ্গেলসকে আমন্ত্রণ জানালেন একটি ঘোষণাপত্র তৈরি করে দেয়ার জন্য। ১৮৪৮ সাম্যবাদী ইস্তেহারের প্রথম প্রকাশ। ১৮৪৯ সালে বহিষ্কৃত হলেন বেলজিয়াম থেকেও। ফিরে গেলেন প্যারিসে, কিন্তু আবারও বহিষ্কৃত হলেন। অগত্যা যেতে হলো লন্ডনে।

লন্ডনে কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কাজ। সাংবাদিকতার চেষ্টা, কিন্তু তেমন কোন আয় ছিলোনা। বন্ধু এঙ্গেলসের উপর নির্ভরতা ছিল আমৃত্যু। লন্ডনে, ১৮৫২ সাল থেকেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিশ্লেষণের কাজে এগুচ্ছিলেন। ১৮৬৭  সালে প্রকাশিত হল পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ড। মার্চ ১৪, ১৮৮৩ পর্যন্ত ছিলেন লন্ডনেই। আমৃত্যু কষ্টকর জীবন যাপন করছেন, পুঁজিবাদের অনুসন্ধানে ও সাম্যবাদের স্বপ্নে।

মার্ক্স পরবর্তি পৃথিবীতে, মার্ক্সের চিন্তা একটি “মতবাদ” হিসেবে আবির্ভূত হয়। একদিকে যারা বিপ্লব প্রত্যাশী, মার্ক্স তাঁদের জন্য শিক্ষক হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে অনেকেই মার্ক্সকে গণ্য করেন, একটি সেক্যুলার ধর্মের নবীর মত। মার্ক্স এর লেখার পাঠক, আদিবাসীদের সাথে জঙ্গলে থাকা সশস্ত্র গেরিলা যোদ্ধা, একই সাথে ইউরোপ ও আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে উচ্চবিত্তের সন্তান। মার্ক্সবাদের বিপক্ষেও লেখা হয়েছে হাজার হাজার পৃষ্ঠা।

মার্ক্স আসলে কে?

মার্ক্স একজন বিচারবাদী চিন্তাবিদ, ক্রিটিকাল থিংকার, কোন পয়গম্বর বা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নন। তাই, অনেকেই যখন মার্ক্স এর “প্রেডিকশন ভুল হয়েছে” বলে মন্তব্য করেন, এদের মৌলিক বিভ্রান্তি মার্ক্স কে চেনায়। একই ভাবে, অনেক দেশের অনেক সাম্যবাদী তাত্ত্বিক, মার্ক্সএর সকল বিশ্লেষণকে অভ্রান্ত মনে করেন, যেন কার্ল মার্ক্স কোন অলৌকিক মহাপুরুষ, যিনি পৃথিবীতে প্রথম একটি অভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক মতামত দিয়েছেন।

কেন মার্ক্স একজন বিচারবাদী চিন্তাবিদ বা ক্রিটিকাল থিংকার? মার্ক্স কয়েকটি জ্ঞানকাণ্ডের সম্মিলিত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। একদিকে দর্শন, অন্যদিকে সমাজবিজ্ঞান (প্রধানত অর্থনীতি) এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ সমাজতন্ত্র, এই তিনটি জ্ঞানকাণ্ডের তাত্ত্বিক বিবর্তনের সফল প্রতিনিধি। ক্রিটিকাল থিয়োরি বা ক্রিটিকাল চিন্তার কাজ কি? বিচারবাদী চিন্তাবিদের লক্ষ্য বৈষম্য ও নিপীড়নের পক্ষের যে ভাবনা চিন্তা তা উন্মোচিত করা। এই উন্মোচন বৈষম্যের অবসান ঘটানো  ও একটি সাম্যের মানবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য। একদিক থেকে দেখলে, এটি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, শোষণ ও বৈষম্যকে সমাজ বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিশ্লেষণ, এবং একই সাথে একটি সাম্যের ব্যবস্থার জন্য সৃজনশীল চর্চা। জ্ঞানের লক্ষ্য বৈষম্য থেকে মুক্তি। মার্ক্স গোটা জীবন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উন্মোচনের কাজ করেছেন, একই সাথে সাম্যবাদীদের সংগঠন গড়ে তুলেছেন, ভবিষ্যৎ সাম্যবাদী সমাজের লক্ষ্যে। এই কাজটি রাজনৈতিক আন্দোলনের।

মার্ক্সীয় দর্শন যতটা কঠিন মনে করা হয়, ততোটা নয়। দর্শনের মৌলিক যে দুটি প্রশ্ন, বাস্তবতা কি? (অন্টলজিকাল), এবং কিভাবে জ্ঞান অর্জন করা যায়? (এপিস্টেমোলজিকাল), এর উত্তরে মার্ক্স বলেন “দান্দ্বিকতার” কথা। বাস্তবতা দ্বন্দ্বময়। দ্বন্দ্বময় মানে “দুই বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রাম”। যে বাস্তবতায় আমাদের জীবন ও বসবাস, এখানে আমাদের নিজের মধ্যে চিন্তার দ্বন্দ্ব রয়েছে, পরিবারে রয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব সমাজে ও রাষ্ট্রে রয়েছে। বুঝতে চাইলে বা দেখতে চাইলে কমনসেন্স দিয়েও তা বোঝা যায়। একটু তলিয়ে দেখলেই বুঝি, আমরা নানা রকম দ্বন্দ্বিক সম্পর্কের মধ্যে আছি।

এই যে দ্বন্দ্বমূলক বাস্তবতা, এ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হলে, আমাদের শুরু করতে হবে, তথ্য দিয়ে, কল্পনা দিয়ে নয়। এই যে তথ্য দিয়ে শুরু করা, এটিই মার্ক্সীয় পদ্ধতি, সমাজবিজ্ঞানের। তথ্য আবার সাজাতে হবে, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায়। তথ্যকে একদিকে ঐতিহাসিকভাবে, অন্যদিকে অন্যান্য দ্বন্দ্বের সাথে সম্পর্কিত করে সাজাতে হবে। যেমন রাজনীতি বুঝতে হলে, অর্থনীতি দেখতে হবে। কেন মানুষ অন্য ধর্মের লোক হত্যা করে? ধর্মের জন্যই কি? মার্ক্স বলেন অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, যেমন বাংলাদেশে জমি বা ভারতে ব্যবসা দখল, “সংখ্যালঘুদের”। মার্ক্স শুরু করেছেন, তথ্য দিয়ে, তারপর সমাজবিজ্ঞানের পদ্ধতি ব্যবহার করে, সমাজের সত্যকে জেনেছেন।

কেন জ্ঞান অর্জন? এর কারণ মার্ক্স যেভাবে বলেছেন, সেটি গুরুত্বপুর্ন। দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করাই যথেষ্ট নয়, দরকার এই বৈষম্যমূলক সম্পর্ক ও ব্যবস্থাটি বদলানোর।

কি দিয়ে এই ব্যবস্থা প্রতিস্থাপিত হবে? 

সাম্যবাদ দিয়ে। সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা দিয়ে। যে ব্যবস্থায় উৎপাদন উপায়ের ব্যক্তিমালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী পাবে, ও যোগ্যতা অনুযায়ী দেবে। কিভাবে মানুষ প্রয়োজন অনুযায়ী পাবে? পাবে, কারণ প্রযুক্তির বিকাশের ফলে, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ এমন মাত্রায় হবে যে, মানুষের প্রয়োজনীয় সকল কিছুই তৈরি হবে। মার্ক্সের সমাজের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে এই ধারনা, সঠিক বলেই তো মনে হচ্ছে।

পরিশেষে, মার্ক্স ইতিহাসের একটি পর্যায়ে জন্মেছেন, একটি বিশেষ সমাজব্যবস্থায়। সেই সময় ও সেই প্রেক্ষিতের প্রভাব মার্ক্সের চিন্তায় রয়েছে। পরিবেশ প্রতিবেশ নিয়ে, নারীবাদ নিয়ে, সমাজ মনোবিজ্ঞান নিয়ে, ভারতীয় সমাজে কৃষকের অবস্থা নিয়ে মার্ক্স “সব কিছু বলে” যান নি। সেটা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে, তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। মার্ক্স আমাদের যা দিয়েছেন, তা বাস্তবতাকে বোঝার একটি সমাজবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও একটি সাম্যবাদী মতাদর্শ।

আপনি যদি বৈষম্য ও সহিংসতার পক্ষের সকল ভাবনাকে উন্মোচন করতে চান, একটি সাম্যের সমাজের লক্ষ্যে। আপনি একজন বিচারবাদী চিন্তাবিদ। একজন মার্ক্সবাদীও।   

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

সর্বশেষ