শুক্রবার,২৬,এপ্রিল,২০২৪
31 C
Dhaka
শুক্রবার, এপ্রিল ২৬, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়স্মরণার্ঘ্যকিংবদন্তী কমিউনিস্ট বিপ্লবী অমল সেন

কিংবদন্তী কমিউনিস্ট বিপ্লবী অমল সেন

সমাজ বদলের লড়াইয়ে নবীনের প্রেরণা

।। আব্দুর রউফ।।

কমরেড অমল সেন-ব্রিটিশবিরোধী তে-ভাগা আন্দোলনের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গের নাম। যশোর-নড়াইলের এগারখান জনপদের মানুষের প্রাণের মানব দেবতা। আদর করে তারা ডাকতেন প্রিয় ‘বাসুদা’, ‘বাবুদা’ বলে। আমি কমরেড অমল সেন’কে দেখি নাই। কিন্তু তার লেখা বই, যশোর-নড়াইলের মানুষ এবং নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে যা জেনেছি, তাতে কমরেড অমল সেন ছিলেন এই উপমহাদেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃৎ। কেবল তে-ভাগার সংগ্রাম’ই নয়, ব্রিটিশ শাসকদের মদদে উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও তিনি লড়াইয়ে নেতৃত্বে দিয়েছেন অগ্রভাগ থেকে। ছিলেন মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার নায়ক। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানিদের রোষানলেও কম পড়েন নি। ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসনামলের ১৯ বছরই কেটেছে কারাগারে। তারপরেও লড়াই ছাড়েন নি অমল সেন। মহান মুক্তিসংগ্রামে তিনি বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট গ্রুপগুলো ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তুলেন লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। আজীবন লড়েছেন মানুষের জন্য। ইতিহাসের এই কিংবদন্তীর কথা গণমাধ্যমে তেমন তুলে ধরা হয় না। কেবল তিনি নয়, আজকের দিনের সকল গণমাধ্যম বুর্জোয়া নেতাদের যেভাবে তুলে ধরে, সেইভাবে কমিউনিস্ট নেতাদের তুলে ধরা হয় না। অথচ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ পরবর্তী সকল সংগ্রামে এদেশের বামপন্থী নেতাদের অনন্য ভূমিকা রয়েছে। তাই ইতিহাসের দায় থেকেই কমরেড অমল সেনকে নিয়ে দু’কলম লিখতে বসা।
আজীবন কমিউনিস্ট বিপ্লবী এই কিংবদন্তীর জীবনের ইতিহাস তুলে ধরার সাধ্য আমার নেই। তবে নবপ্রজন্মের সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে তার জীবনের অনেক ঘটনাই প্রেরণা যোগাবে-এই বোধ থেকেই কিছু তুলে ধরার চেষ্টা মাত্র। কমরেড অমল সেনের জন্ম ১৯১৩ সালের ১৯শে জুলাই ব্রিটিশ ভারতের বর্তমান নড়াইলের আফরা গ্রামে। জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়া কমরেড অমল সেন ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রমী মানুষ। বাপ-দাদার জমিদারি তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি, শৈশব কাল থেকেই ভাবতেন গরিব, মেহনতী, কৃষক ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে। কৈশোরেই স্বপ্ন দেখতেন সমাজ হবে শ্রেণিহীন-শোষণহীন সমাজ। তাইতো ওই বয়সেই যুক্ত হয়েছিলেন অগ্নিযুগের বাংলার বিখ্যাত বিদ্রোহী সংগঠন চর্চায়। হয়ে গেলেন অনুশীলনের সদস্য। এখান থেকেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের হাতেখড়ি। বেছে নেন অধিকার বঞ্চিত কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ। লড়াই নিজের বাপ-দাদার জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে। মিশে গেলেন একেবারে নিম্নবর্গ কৃষকদের সাথে। উচ্চবিত্তের ঘরে জন্ম নেওয়া অমল সেন হয়ে গেলেন এই নি¤œবর্গের কৃষক পরিবারের প্রাণের মানুষ। থাকতেন কৃষক পল্লীতেই। গড়ে তুলেছিলেন অভূতপূর্ব কৃষক সংগ্রাম, ইতিহাসে যা তে-ভাগা কৃষক আন্দোলন নামে খ্যাত।
নড়াাইলের তেভাগা আন্দোলন স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এই আন্দোলনে তার অংশের কৃষক সংগ্রামীরা তৎকালীন জমিদার, মহাজন এবং ব্রিটিশ রাজাদের হাত থেকে বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিল। সেই বিজয় ব্রিটিশ আমলের বিরুদ্ধে পাল্টা রাষ্ট্রগঠনের ভীত পর্যন্ত গড়ে দিয়েছিল। তে-ভাগা আন্দোলনের সময় ভারত ভাগ হয়ে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের জন্ম নেয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পরে এই অঞ্চলের কমিউনিস্ট নেতাদের জীবনে নেমে আসে দুর্বিষহ। ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তি যা করতে পারে নি, তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তান আমলে বিপ্লবী সংগ্রামীদের জীবনে নেমে আসে সেই নির্যাতন। পাকিস্তানের শাসনামলের ১৯ বছর জেলে থাকাকালীন তিনি সেই জেলখানাকে কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পরিণত করেছিলেন। শুধু রাজনীতি নয় সংস্কৃতি, নাটক, গান বাজনা এবং বামধারার আলোচনায় জেলখানাতেও কর্মীদের মাতিয়ে রাখতেন। কমরেড অমল সেন এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যার সংস্পর্সে এসে তাকে সকল বয়সী মানুষ তাকে পছন্দ করতেন। আগেই বলেছি সকলেই ভালোবেসে তাকে বাবুদা নামে সম্বোধন করতেন।
শুরুতেই বলেছি, এদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে কমরেড অমল সেন-এর অবদান অসামান্য। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ইপিসিপির (এম-এল) ভ্রান্ত লাইনকে প্রত্যাখ্যান করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন তৈরিতে দৃঢ় ভূমিকা রেখেছেন। এ ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। নকশালপন্থার চরম ভ্রান্তির বিপরীতে এই সমন্বয় কমিটি দেশের অভ্যন্তরে প্রতিরোধযুদ্ধ সংগঠিত করে, যার প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলার শিবপুর অঞ্চল। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কমরেড অমল সেন এর এমন সিদ্ধান্তের ফলে অনেক বিপদগামী কমিউনিস্ট তরুণকে বিভ্রান্তির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তীতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কমিউনিস্ট গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে পার্টিকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই উদ্যোগ পুরোপুরি সফল হয়েছে এমনটি বলা যাবে না। তারপরও বাংলাদেশ-উত্তরকালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি, কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার গ্রুপ) ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী)। মূলত তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই এই ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে ওঠে। তিনি হন সাধারণ সম্পাদক। এই লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিই দ্বিতীয় কংগ্রেসে ১৯৮০ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি নাম ধারণ করে। তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি বিকাশে কাজ করে গেছেন। দীর্ঘ সময় ছিলেন পার্টির সভাপতি। রাজশাহীতে ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে বার্ধক্যজনিত কারণে সেই দায়িত্ব থেকে অবসর নেন। কেবল রাজনৈতিক সংগ্রামেই নয়, এগারখানের মানুষের জীবনাচরণ বদলে দিতে এবং তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। সেই সময়েই তিনি ওই জনপদের মানুষকে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করাতে শিখিয়েছেন। সামাজিক কুসংস্কার থেকে তাদের বের করে নিয়ে আসেন। অধিকার আদায় এবং মানুষের জীবন বদলানোর লড়াইয়ের এই কিংবদন্তী সবাইকে কাঁদিয়ে ৮৯ বছর বয়সে চলে যান ২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি। প্রতি বছর ১৭ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকা, নড়াইলের বাকড়ি ও সারাদেশে গভীর শ্রদ্ধায় পালন করা হয় কমরেড অমল সেনের মৃত্যুবার্ষিকী। এবছর ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীও পালন করা হয় ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
কমরেড অমল সেনের জীবনের এই দীর্ঘ পরিক্রমায় শুধু সমাজের শোষিত মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলে গেছেন। সা¤্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার বিপরীতে এক সমতাভিত্তিক ও জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আহ্বান করে গেছেন। তিনি জীবনের সকল বিলাসিতাকে বিসর্জন দিয়ে, খেটে খাওয়া গরিব কৃষকদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার থেকেছেন। আজ আমাদের নবীন প্রজন্ম এই সমস্ত বীর বিপ্লবীদের জীবনের কর্ম ও ইতিহাস সম্পর্কে জানে না। আমাদের নতুন প্রজন্মকে নির্দিষ্ট কিছু ইতিহাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে। যে কারণে আমাদের দেশের এই আজীবন বিপ্লবী, অমূল্য ত্যাগী মানুষগুলোর ইতিহাস আমরা জানতে পারছি না। কমরেড অমল সেন যে, জনগণের বিকল্প শক্তির কথা বলে গেছেন সেই দীক্ষা আমাদের নতুন প্রজন্মকে গ্রহণ করতে হবে। সেই শিক্ষায় আমাদের সমাজটাকে নতুনভাবে সাজাতে হবে। পাল্টাতে হবে এই ঘুনে ধরা সমাজকে। কমরেড অমল সেন চলে গেছেন। রেখে গেছেন সমাজবদলের এমন এক আদর্শ যার কখনো মৃত্যু ঘটবে না। তিনি তার কর্মের মধ্যেমে আজীবন বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। কমরেড অমল লাল সালাম।
লেখকঃ সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

সর্বশেষ