মঙ্গলবার,১৯,মার্চ,২০২৪
33 C
Dhaka
মঙ্গলবার, মার্চ ১৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়‘কৃষিমূল্য কমিশন’ এখন সময়ে দাবি

‘কৃষিমূল্য কমিশন’ এখন সময়ে দাবি

॥ নিতাই চন্দ্র রায় ॥

Nitay-Roy-Comred
কমরেড নিতাই চন্দ্র রায়

কৃষি উৎপাদন, কৃষি গবেষণা, কৃষি উপকরণ বিতরণ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি বিস্তারে আমাদের দেশে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনে কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি বিস্তার ও ফলন বাড়ানোর জন্য দেশে ইউনিয়ন থেকে জাতীয় পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা রয়েছেন। কিন্তু কৃষকের কষ্টার্জিত উৎপাদিত ফসল বিক্রির ব্যাপারে তৃণমূল পর্যায়ে তেমন কর্মকা- চোখে পড়ে না। দেশের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নামের প্রতিষ্ঠানটির কর্মকা- জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ। কৃষক যদি তার পণ্য উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে বিক্রি করে লোকসানের সম্মুখীন হন, ঋণে জর্জরিত হন তাহলে কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ফলন বৃদ্ধির উৎসাহ ও উদ্যোম কোথা থেকে পাবেন কৃষক ?
স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় চারগুণ। ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে আটগুণ। ডাল, তেলবীজ ও মসলা ফসলসহ শাক-সবজি ও ফলমূলের উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির এ সুফল ভোক্তা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা ভোগ করলেও হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমী কৃষকের ঘরে তা এখনো পৌঁছে নি। বরং ভোক্তামূল্যে কৃষকের অংশ ৬৫ থেকে বর্তমানে ৪১ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। আমাদের দেশে কৃষকের জমি থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত কৃষি পণ্যের ৪ থেকে ৫ বার হাত বদল হয়। এ কারণে ভোক্তাকে কৃষকের বিক্রিত মূল্যের ৫ থেকে ৬ গুণ দামে কৃষিপণ্য ক্রয় করতে হয়। কৃষিপণ্যের এই ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণে কৃষক যেমন পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন, তেমনি ভোক্তাকেও বেশি দামে পণ্য কিনে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হতে হয়। বর্তমানে দিনাজপুর ও বগুড়ার ৬ টাকা কেজির আলু রাজধানী ঢাকা ও ময়মনসিংহের হাট-বাজারে ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকায়।
মিল মালিকদের খেয়াল-খুশির কাছে ধান উৎপাদনকারী কৃষক যে কত অসহায় তার প্রমাণ ২০১৯ সালে প্রকাশিত খাদ্য নীতি বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইফব্রি’র এক গবেষণা প্রতিবেদন। ওই সময়ে বোরো ধানের বাম্পার ফলনের কারণে বাজারে ধানের মূল্য পতন ঘটে। মিল মালিকেরা ১৪ টাকা কেজি দরে বাজার থেকে হাইব্রিড ধান কিনে চাল তৈরি করে সরকারি গুদামে ৩৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে প্রচুর লাভবান হন। আর দুর্ভাগা কৃষক উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ধান বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হন। একারণে কখনো কখনো কৃষক মনের দুঃখে রাস্তায় কৃষিপণ্য ফেলে প্রতিবাদ জানান। কখনো পাকা ফসলের ক্ষেতে আগুন দিয়ে মনের অশান্ত আগুন নেভান। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! মূল্য পতনের কারণে কখনো কৃষক আলু, মূলা, লালশাক, টমেটোর মতো সবজি চাষ করে মাটির সাথে মিশিয়ে জৈব সার তৈরি করেন। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাম সর্বস্ব কিছু কৃষক সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করে। এদেশে তে-ভাগা আন্দোলন ও টংক বিদ্রোহের মতো সফল দৃষ্টান্ত থাক সত্বেও ভারতের মতো মোদি সরকার কাঁপানোর কৃষক আন্দোল গড়ে তুলতে পারেন না।
বিশষজ্ঞদের মতে, ধান চাষকে লাভজনক করতে না পারলে কৃষক ধান উৎপাদনে, আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন। ফলণ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না। খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। বিদেশ থেকে উচ্চ দামে চাল আমদানি করতে হবে। এসব কারণে মিল মালিক , মজুদদারসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের জন্য কৃষিমূল্য কমিশন গঠন করা এখন সময়ে দাবি।
সরকার নানাভাবে কৃষদের সহায়তা করে। কৃষিতে সহায়তা প্রদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো নূন্যতম সহায়ক (এমএসপি) মূল্য প্রদান। এর মাধ্যমে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান। ভোক্তারাও যৌক্তিক মূল্যে মানসম্মত কৃষিপণ্য ক্রয় করতে পারেন। ভারতে এই নূন্যতম সহায়ক মূলের ঘোষণা দেওয়া হয় ফসল রোপণের আগে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষকের কষ্টের কথা জানতেন। তাদের কঙ্কালসার দেহ, অভাব-অনটন তাঁকে দারুণভাবে ব্যথিত করতো। তিনি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীনতার পর ধান, গম, পাট , আখ ও তুলার সরকারি মূল্য ঘোষণা করেন।
এখনো দেশের গরিব জনগোষ্টি তাদের উপার্জিত আয়ের প্রায় ৬০ ভাগ ব্যয় করেন খাদ্য কেনার কাজে। কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও জীবিকা নির্বাহের জন্য দেশের সিংহভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল। জিডিপির ১২ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। রপ্তানি ও শিল্পের কাঁচামাল যোগতে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। তাই উৎপাদকারী কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের জন্যই একটি ইতিবাচক ও গ্রহণযোগ্য মূল্যনীতি প্রয়োজন।
এ নীতির মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য ওঠা-নামা সীমিত রাখা এবং পণ্যের উৎপাদন ও গুণগতমাণ বাড়িয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি ও আমদানির হ্রাসের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও মূল্য নীতিমালার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষিপণ্যের উৎপাদন খরচ ও সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণের জন্য রয়েছে ‘কৃষি মূল্য কমিশন’। আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ভারতে কৃষিমূল্য কমিশন কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থে ১৯৬৫ সাল থেকে সফলতার সাথে কাজ করে আসছে। ১৯৮৫ সালে এটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়- ‘কৃষি খরচ ও মূল্য কমিশন’ । একজন চেয়ারম্যান, একজন সদস্য সচিব, একজন সরকার কর্র্তৃক নিয়োগকৃত প্রতিনিধি এবং দুইজন কৃষক প্রতিনিধিসহ (যারা কৃষি কাজের সাথে সরাসরি জড়িত) প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ এবং অন্যান্য লোকবল এই কমিশন গঠিত হয়। কমিশন উৎপাদিত ফসলের উৎপাদন খরচের শতকরা ৫০ ভাগ লাভ ধরে নূন্যতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি’র জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ পেশ করে। মোট উৎপাদিত ফসলের কমপক্ষে শতকরা ১৫ ভাগ সরকার সহায়ক মূল্যে ক্রয় করে। নূন্যতম সহায়ক মূল্যের সুপারিশ কালে কৃষিপণ্যের রপ্তানি মূল্য ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়।
ভারতের ‘কৃষিমূল্য ও খরচ কমিশন’ প্রতিবছর ২৩ টি কৃষিপণ্যের নূন্যতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে। এছাড়া রয়েছে ৪টি অর্থকরী ফসল, যেমন-আখ, তুলা, কাঁচাপাট ও নারকেলের শুষ্ক শাঁস। আর বাংলাদেশে সরকার ধান, গম, আখ ও তুলার প্রতিবছর সরকারি মূল্য ঘোষণা করে। সরকার মাত্র উৎপাদিত ধান-চালের ৪ ভাগ সরকারি দামে সংগ্রহ করে। সরকার কর্তৃক সংগৃহীত চালের শতকরা ৮২ ভাগ কেনে মিল মালিকদের কাছে থেকে এবং ১৯ ভাগ কেনে কৃষকদের নিকট থেকে, কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে যা মোটেও সহায়ক নয়।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশেও একটি জাতীয় কৃষিপণ্যের মূল্য কমিশন গঠনের দাবি জানিয়ে আসছেন দেশের কৃষক সংগঠন ও কৃষি বিশেষজ্ঞগণ। আমাদের জাতীয় কৃষিনীতি ২০১৯-এ জাতীয় মূল্য কমিশনের কথা বলা হলেও তার প্রতিফলন এখনো দৃশ্যমান নয়। কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রদান, কৃষকের উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং টেকসই খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে -এ ব্যাপারে সাহসী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

প্রতিবছর বাংলাদেশে কৃষি পণ্যের নূন্যতম সহায়ক মুল্য প্রদানের কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। তবে সরকারিভাবে প্রতিবছর কৃষকের কাছে থেকে যৎ সামান্য ধান, গম কেনা হলেও, তার সুফল কৃষের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে না। মধ্যস্বত্বভোগী ও ক্রয় কাজের নিয়োজিতরাই তাতে লাভবান হন। দেখা গেছে, দেশে উৎপাদন খরচের ওপর ৬ থেকে ১০ শতাংশ মুনাফা দেখিয়ে কৃষি পণ্যের সরকারি মূল্য নির্ধারিত হয়। আবার উৎপাদিত ধানের শতকরা ৯৬ ভাগ ক্রয় করেন মিল মালিক , ব্যবসায়ী ও মজুদদারগণ তাদের মনগড়া দামে। সরকারিভাবে ক্রয় করা হয় মাত্র ৪ শতাংশ খাদ্যপণ্য, যার প্রভাব বাজারে নেই বললেই চলে।
ভারতে তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে প্রায় দেড় বছর ধরে আন্দোলনে উত্তাল ছিল রাজধানী নয়াদিল্লী। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থানে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে দিল্লির বাইরে তাবু খাটিয়ে অবস্থান করে আসছিলেন কৃষক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ১৯ নভেম্বর কৃষকের আন্দোলেনে কাছে নতি স্বীকার করে বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহের ঘোষণা দেন। ২৪ নভেম্বর, ২০২১ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় কৃষি আইন প্রত্যাহারের বিল অনুমোদন করা হয়। ওই ঐতিহাসিক আন্দোলনের মূলে ছিল নূন্যতম সহায়ক মূল্য তুলে দেয়ার অজানা আতঙ্ক। সরকারের দাবি ছিল- এই আইনে বড় ব্যবসায়ীদের মনোপলি বন্ধ হবে। কৃষক যেখানে খুশি, যার কাছে খুশি, তার ফসল বিক্রি করতে পারবেন। বাজারে সর্বোচ্চ মূল্য পাবেন। পরিবহন খরচ কমবে। অপর দিকে কৃষকদের অভিযোগ ছিলÑএই আইন বাস্তবায়িত হলে সরকার ধীরে ধীরে নূন্যতম সহায়ক মূল্যে বাজার থেকে ফসল কেনা বন্ধ করে দেবে। কৃষকদের পুঁজিপতিদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। ব্যবসায়ীরা কৃষকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করবে নীলকরের মতো।
ভারতের কৃষক আন্দোলনের সফলতা কথা বিবেচনা করে আমাদের কৃষকদেরকেও ‘কৃষিমূল্য কমিশন’ ও নূন্যতম সহ্ায়ক মূল্যের দাবিতে সারা দেশে কর্মসূচি ভিত্তিক ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন কৃষি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, কৃষি বিজ্ঞানী , কৃষি বিশেষজ্ঞ , সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকেও এব্যাপারে যথাযথ ভুমিকা পালন করতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও সভাপতি, ত্রিশাল উপজেলা ওয়ার্কার্স পার্টি, ময়মনসিংহ।

সর্বশেষ