শনিবার,২৭,এপ্রিল,২০২৪
30 C
Dhaka
শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
Homeজাতীয়চলে গেলেন প্রিয় বন্ধু সহযোদ্ধা কমরেড সাইদ, সবার ‘সাইদ ভাই’

চলে গেলেন প্রিয় বন্ধু সহযোদ্ধা কমরেড সাইদ, সবার ‘সাইদ ভাই’

।। ড. সুশান্ত দাস ।।

২২ আগষ্ট, ২০২১ সাল, ভোর প্রায় সাড়ে পাঁচটা, চলে গেলেন খুলনার প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা, কৃষক- শ্রমিকের প্রানপ্রিয় বন্ধু, খুলনার প্রগতিশীল আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, সাবেক সংসদ সদস্য, দিঘলিয়া হাইস্কুলের প্রথিতযশা শিক্ষক কমরেড সাইদুর রহমান। রেখে গেলেন অসংখ্য সংগ্রামের স্মৃতি আর স্বাক্ষর, অশ্রুশিক্ত হাজার হাজার গুণগ্রাহী মানুষ ও কমরেডদের। কিছুদিন আগে তাঁর বহু সংগ্রামের সাথী, সহধর্মিনী আমদের ছেড়ে চলে গেছেন। সেদিন অশ্রুভারাক্রান্ত কন্ঠে বলেছিলেন, দাদা, আপনার ভাবী চলে গেলেন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে।‘  কারণ কিছুদিন আগেই কমরেড সাইদের ‘ওপেন হার্ট’ সার্জারি হয়েছিল। ভাবী প্রাণান্ত চেষ্টায় তাকে সারিয়ে তুলেছিলেন। পুত্র কন্যারা বড় হয়ে গেছে। ভাইপো, ভাইঝি, ভাই ভাবি নিয়ে তবুও তাঁর বড় সংসার। আর ছিল সহযোদ্ধা কমরেডরা। ব্যক্তিজীবনের একাকীত্ব তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের পার্টির অভিভাবক। কিংবদন্তির শ্রমিক নেতা কমরেড হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি খুলনা জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘকাল পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ছিলেন। নবম কংগ্রেসে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ছিলেন জাতীয় কৃষক সমিতির সহ সভাপতি।

তিনি ছিলেন খুলনার ভূমিপুত্র। ছাত্রজীবন থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। খুলনার বি এল কলেজ বৃটিশ আমল থেকেই প্রগতিশীল আন্দোলনের সূতিকাগার। কমরেড সাইদের জন্মস্থান ছিল এই বি  এল কলেজের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদীর অপর পাড়ে। প্রাকৃতিক কারণেই এই এলাকা ছিল সকল আন্দোলনের ‘পশ্চাদভূমি’। কিংবদন্তীর কমিউনিস্ট নেতা কমরেড নজরুল ইসলামের হাত ধরে তিনি পার্টিতে আসেন। তাঁর বড় ভাই ছিলেন কমরেড নজরুল ইসলামের ঘনিষ্ট বন্ধু। তখন দৌলতপুর, খালিশপুর, দিঘলিয়া, আটরা, পাশে ডুমুরিয়া, ফুলতলা ছিল বামপন্থী আন্দোলনের লাল দূর্গ। কমরেড সাইদ এই পরিবেশেই গড়ে উঠেছিলেন। ভৈরব নদীয় দুই পার্শ্বে গড়ে ওঠা জুটপ্রেস, জুট্মিল শ্রমিকদের আন্দোলনের সূতিকাগার। দিঘলিয়া থেকে শুরু করে নড়াইল জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত কৃষক এলাকা ছিল কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক ভিত্তিভূমি।

কমরেড সাইদ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বড় ভাই ভাবিসহ গোটা পরিবারই ছিল প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রতি সহমর্মী। তাঁর ভাই ভাবিসহ গোটা পরিবার  সারাজীবন তাঁর আন্দোলন সংগ্রামের পাশে থেকেছেন।

তিনি দীঘলিয়া হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এবং ‘সাইদ মাস্টার’ হিসেবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন ছাত্রদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তাঁর অনেক ছাত্র ছাত্রী পরবর্তী জীবনে বহু উচ্চপদে গেছেন। তারাও তাকে শ্রদ্ধা করতেন। এত বড় রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্বেও তাঁর শিক্ষক পরিচিতি কখনো ম্লান হয়নি। এ এক অনন্য উদাহরণযোগ্য এবং অর্থবহ ঘটনা।

তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন আমার সমবয়সী, ঘনিষ্ট বন্ধু। আজ তাই বহু স্মৃতি ভীড় করে আসছে। কখনো কখনো কলম  থেমে যায় স্মৃতির ভারে। আমি ১৯৭৫ সালের শেষদিকে রাজশাহী জেলা থেকে এসে পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে খুলনা অঞ্চলে কাজ শুরু করি।  দৌলতপুর জুটপ্রেস এলাকা এবং  দিঘলিয়া ছিল আমার পার্টি ও সংগঠন গড়ে তোলার মূল ক্ষেত্র। তখন জুটপ্রেস নেতা প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা ধলা মিয়া, মজিবর রহমান, আয়ুব আলী, হাকিম, আনসার আলী, আলাউদ্দিন সিং, হোসেন আলী এরা সবাই ছিলেন শ্রমজীবি মানুষের মধ্য থেকে উঠে আসা নেতা। কমরেড আয়ুব আলী বলতেন, ‘ কমরেড, পাটের বোঝা মাথায় তুললে সমাজতন্ত্র পেটে চলে আসে, ফেললে তখন মাথায় আসে।‘  গভীর দার্শনিক উক্তি। কমরেড সাইদ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নিয়েও এই শ্রমিক নেতাদের সহযোদ্ধা ও নেতা হয়ে ওঠেন। আমি প্রায় অলৌকিকভাবে এদের পরিবারের অংশ হয়ে গিয়েছিলাম। একযুগের বেশী সময় এদের সহযোদ্ধা হিসেবে  থেকে পার্টির কাজে অন্যত্র চলে গেছি, কিন্তু এরা আমাকে ভোলেনি। আজ কমরেড সাইদের মৃত্যুর খবরটা আমাকেই প্রথম দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর আগের দিন তাঁর মেয়ে টেলিফোন করে বলছিলো, ‘কাকু, আব্বু ভালো করে কথা বলতে পারছে না। আপনাকে টেলিফোন করতে বলছে তাঁর অবস্থা জানানোর জন্যে’। আজ তিনি চলে গেলেন। আমি শুধু তাঁর সহযোদ্ধা ছিলাম না , ছিলাম তাঁর পরিবারের অংশ।

তিনি আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জননেতা  হয়ে ওঠেন। তিনি বারবার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। সংসদ সদস্য হয়েছেন। তাঁর সংসদ নির্বাচনে আমি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহবায়ক ছিলাম। সেই নির্বাচনী লড়াইএর কঠিন সময় আমরা বহু  বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি সাধারণ মানুষের  মধ্যে।

তিনি ১৯৮০ সালে পার্টির খুলনা জেলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। আমি তখন পার্টির জেলা কমিটির সম্পাদক। আমরা সমবয়সী হলেও কোন আচরণেই তিনি পার্টির শৃংখলার বাইরে ব্যবহার করেননি।  আমৃত্যু তিনি আমাকে ‘নেতা’ মেনেছেন। এ এক অসাধারণ পার্টি চেতনা। তিনি পার্টির বহু কঠিন সময়ে তাঁর দৃঢ় এবং স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে  অবস্থান নিয়েছেন। তিনি  সারাজীবন পার্টির আভ্যন্তরীণ কোন দ্বন্দ, ব্যক্তিগত ভালোলাগাকে প্রশ্রয় দেননি। সেজন্যেই কংগ্রেস তাকে সর্বস্মমতিক্রমে ‘কন্ট্রোল কমিশনের চেয়ারম্যান’ নির্বাচিত করেন। সকল কমরেডদের অধিকার তাঁর হাতে সুরক্ষিত ছিল।

ব্যক্তিগত ভাবে তিনি ছিলেন অসম্ভব সাহসী মানুষ। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৭৮-’৭৯ সালে জুটপ্রেস শ্রমিকদের আন্দোলনের সময় এক শ্রমিক জনসভায় মালিকদের গুন্ডারা  লাঠিসোঠা নিয়ে আক্রমন  করে। সেই জনসভার বক্তৃতা মঞ্চে ছিলেন কমরেড নজরুল ইসলাম, কমরেড কামরুজ্জান লিচু, কমরেড হাফিজুর রহমান, ধলা মিয়া, মজিবর রহমান সহ শ্রমিক নেতারা। আমিও মঞ্চে ছিলাম পার্টির জেলা নেতা হিসেবে। গুন্ডাদের উদ্দেশ্য ছিল নেতাদের আক্রমন করা এবং জনসভা ভেংগে দেওয়া। সেদিন কমরেড সাইদ লাঠি হাতে শ্রমিকদের নিয়ে রুখে দিয়েছিলেন সে আক্রমণ। পরবর্তী জীবনে বহুবার জীবন সংকট করেও তিনি এ ধরণের লড়াইএ অংশ নিয়েছেন।

কমরেড সাইদ কোনদিন শ্রমজীবি কৃষক-শ্রমিক আর পার্টির সংগ্রাম থেকে সরে দাঁড়াননি, ছেড়ে যাননি হাজার প্রতিকূলতা সত্বেও।  থেকেছেন অভিভাবক হয়ে। আজো তাঁর প্রয়োজন ছিল সবচাইতে বেশী, কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে চলে গেলেন। কিন্তু রেখে গেলেন বহু সংগ্রাম আর লড়াইএর স্বাক্ষর। জীবন যায়, জীবন আসে, কিন্তু তাকে অর্থবহ করে রাখে এই এগিয়ে চলার সংগ্রামী ইতিহাস। কমরেড সাইদ লাল সালাম। আপনার পতাকা বহন করবে আপনার উত্তরসূরিরা যারা দেখেছে আপনাকে লড়াইএ ময়দানে।

লেখক: সুশান্ত দাস, পলিটব্যুরো সদস্য , বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি

সর্বশেষ