বৃহস্পতিবার,২,মে,২০২৪
30 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মে ২, ২০২৪
Homeজাতীয়টিকা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতি : সাবধানে এগোতে হবে বাংলাদেশকে

টিকা নিয়ে বিশ্ব রাজনীতি : সাবধানে এগোতে হবে বাংলাদেশকে

নতুন কথা প্রতিবেদন ॥ মরণঘাতী ভাইরাস করোনা’কে নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকরী উপাদান হলো টিকা। এটা এখন প্রমাণিত। এ কারণেই টিকা নিয়ে বেশ জমে উঠেছে বিশ্বরাজনীতি। বাজারজাত নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে টিকা আবিষ্কারের দেশ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া। ভারত টিকা অবিষ্কার না করলেও অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদন করে বাজার নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখতে চাইছে। দেশগুলো আসলে টিকার বিনিময়ে অন্য স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে; যা ইতিমধ্যে ‘টিকা কূটনীতি’ অভিধা পেয়েছে। ব্যাপারটা অনেকটা এমন হয়েছে যে, কে টিকা পাবে আর কে পাবে না-তা নির্ভর করছে এই দেশগুলোর সাথে কার কেমন সম্পর্ক তার ওপরে।
করোনা ভাইরাসের টিকা বাজারে আসার আগে থেকেই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ভারত কেন্দ্রিক প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। দেশগুলো অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উদ্ভাবিত করোনা ভাইরাসের টিকা সরবরাহের জন্য ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের ওপরই নির্ভর করেছিল। এর কারণ হচ্ছে-এসব দেশে সুলভে সরবরাহের শর্তে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদনের লাইসেন্স নিয়েছিল সেরাম ইনস্টিটিউট। এর বাইরেও এ দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) গঠিত কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটিতেও টিকা সরবরাহের কথা ছিল ভারতের।
ভারত এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার টিকার বাজারের একচেটিয়াকরণের চেষ্টা করে। দেশটি চীনের টিকাকে আঞ্চলিক বাজার থেকে সরিয়ে দেওয়ার কৌশল নেয়। এক পাকিস্তান বাদে সার্কভুক্ত প্রতিটি দেশকেই তারা বিপুল পরিমাণ টিকা উপহার দেয়। এমনকি চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এমন কিছু দেশকেও তারা উপহার হিসেবে বিপুল পরিমাণ টিকা পাঠায়। একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে তারা সবচেয়ে বেশি ৩৩ লাখ টিকা উপহার দেয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশ আগাম অর্থ দিয়ে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে টিকা কেনার চুক্তি করে বেশ কিছু টিকাও নিয়ে আসে। কিন্তু ভারতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় দেশটি বাংলাদেশে টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এনিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় বাংলাদেশ। বাধ্য হয়েই বাংলাদেশ টিকার জন্য বিকল্প উৎসের সরণাপন্ন হয়েছে।
এদিকে পেটেন্টের কারণেও চাইলেই টিকার উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না। এ নিয়েও আছে রাজনীতি। ওষুধ কোম্পানিগুলো টিকার সূত্র কিনে রেখেছে। সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এদের বাইরে কেউ টিকা উৎপাদন করতে পারছে না। এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া এবং চীন নিজেদের অনুকূলে থাকা পররাষ্ট্রনীতির বিনিময়ে বিভিন্ন দেশে টিকা সরবরাহ ও উৎপাদনের অনুমতি প্রদান করেছে। বাংলাদেশও রাশিয়ার টিকা উৎপাদনের জন্য দেশটির সঙ্গে চুক্তি করার চেষ্টা করছে। কোভিড-১৯ মহামারী এখন বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এ সুবিধাকেই সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে চাইছে চীন ও রাশিয়া। কেবল পররাষ্ট্র নীতিমালা নিয়ে আপসের মাধ্যমে নয়, বরং টিকার বদলে তারা নিজেদের অনুকূলে ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্গঠনেও মনোযোগ দিয়েছে। এই টিকা রাজনীতির কল্যাণেই রাশিয়া তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এমনকি ঐতিহ্যগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশের সাথেও সখ্যতা গড়ে তুলেছে রাশিয়া। একইভাবে মধ্য এবং পূর্ব ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে নিজেদের ভূ-রাজনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যেশ্যে রাশিয়া ভ্যাকসিন সরবরাহ করেছে। অন্যদিকে চীন আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার গরীব ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সিনোভ্যাক টিকা সরবরাহ করছে বা করার চেষ্টা করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এতোদিন চীনা টিকা ব্যবহারের অনুমোদন না দেওয়ায় একটু বেকায়দায় ছিল দেশটি। কিন্তু সম্প্রতি ‘হু’ চীনা টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এতে পরিস্থিতি অনেকটাই চীনের অনুকুলে এসেছে। অনেক দেশ চীনের টিকা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশও চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কিনতে যাচ্ছে। এদিকে নতুন করে ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, টিকা কূটনীতির মাধ্যমে তাইওয়ানের বিষয়ে প্যারাগুয়ের অবস্থান পুনঃনির্ধারণের ক্ষেত্রে সফল হয়েছে চীন।
এখন পর্যন্ত ৭০টি দেশে টিকা পাঠাতে সম্মত হয়েছে রাশিয়া সরকার। চীনও দ্রুত সময়ের মধ্যে ১০০ টি দেশে টিকা পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। যদিও শুরুর দিকে দেশ দুটির টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আগ্রহ ছিল খুবই কম। পশ্চিমা গণমাধ্যমও দেশ দুটির টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে নানা প্রতিবেদন-নিবন্ধ প্রকাশ করে। তবে ভারতে সংক্রমণ বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে সেরাম ইন্সটিটিউটের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দেশ চীন ও রাশিয়ার টিকা রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়া ত্বরান্বিত হয়েছে। দুটি দেশই দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন দেশে টিকা সরবরাহ ও উৎপাদনের অনুমতি দিয়েছে। সম্প্রতি চীনের উদ্যোগে ‘ইমার্জেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কোভিড ফর সাউথ এশিয়া’ নামক একটি প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি হয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
এদিকে জরুর প্রয়োজন মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা উৎপাদিত ৪০ লাখ ডোজ টিকা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার। তবে চীন বা রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র ভাল চোখে নাও দেখতে পারে। ভূ-রাজনীতিতে এই দেশগুলোর অবস্থান পরষ্পরবিরোধী। টিকার মেধাস্বত্ত্ব শিথিল হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বায়োফার্মাসিউটিক্যালস প্রযুক্তি রাশিয়া ও চীনের দখলে চলে যেতে পারে বলে এমনিতেই উদ্বেগে রয়েছে বাইডেন প্রশাসন।
কেবল বাংলাদেশই নয়, ফ্রান্স-স্পেন ও জার্মানির মতো নাক উঁচু পশ্চিমের অনেক দেশই এখন চীন ও রাশিয়ার টিকা নেওয়ার জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম প্রথম দিকে চীন ও রাশিয়ার উদ্ভাবিত করোনার টিকাকে পাত্তা না দিলেও বর্তমানে পরিস্থিতি বদলেছে। কার্যত কোনো উপায় না পেয়েই তারা পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরের টিকা নেওয়ার গরিমা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে চীনও ঘোষণা করেছে যে, তাদের সিনোভ্যাক এবং সিনোফার্ম ভ্যাকসিন দুটো ‘বৈশ্বিক জনসাধারণের সম্পদ’।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, এ দুই রাষ্ট্রের উদ্ভাবিত করোনা ভাইরাসের টিকাও বেশ কার্যকর। রাশিয়ার টিকা স্পুৎনিক এর মানবদেহে পরীক্ষার অন্তর্র্বতী ফলাফল প্রকাশ করেছে শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসা সাময়িকী দ্যা ল্যানসেট। এতে দেখা গেছে, টিকাটি ৯১ দশমিক ৬ শতাংশ কার্যকর। অন্যদিকে টিকাটির প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দাবি স্পুৎনিক-ভি এর কার্যকারিতা আরো বেশি। প্রায় ৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ। সম্প্রতি টিকাটির আরেকটি সংস্করণ এনেছে রাশিয়া। এক ডোজের এ টিকার নাম দেওয়া হয়েছে স্পুৎনিক লাইট। দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, করোনা প্রতিরোধে এক ডোজের এই টিকা ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ কার্যকারিতা দেখিয়েছে।
একসময় টিকা তৈরির সক্ষমতা বাংলাদেশেরও ছিল। মহাখালিতে অবস্থিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ছয় ধরনের টিকা উৎপাদন করত এবং তা বিদেশে রপ্তানিও হতো। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে ২০১১ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এখন আবার সময় এসেছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করে পুনরায় টিকা উৎপাদনে যাওয়ার। তাছাড়া যদি প্রতি বছর টিকার বুস্টার হিসেবে একাধিক ডোজের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে বিশ্বের বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসার সম্ভাবনাই বেশি। তাই চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে টেকনোলজি ট্রান্সফারের মাধ্যমে দেশেই টিকার উৎপাদন বিষয়ে যে আলাপ আলোচনা চলছে এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের জন্য আশার আলো হতে পারে গ্লোব বায়োটেকের উদ্ভাবিত টিকা বঙ্গভ্যাক্স। এই টিকাটির মানবদেহে ট্রায়ালের বিষয়ে দ্রুত পজিটিভ সিদ্ধান্তে আসা উচিত। হবে হবে করেও অনেকদিন ধরেই এটি হচ্ছে না। টিকাটি ৯৫ শতাংশ কার্যকর এবং গুরুতর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। এই কাজগুলো করে ফেলা গেলে আগামী দিনে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে অন্যতম টিকা উৎপাদনকারী দেশ। শুধু নিজেদের জন্য নয়, বিশ্ববাজারের জন্যও।
টিকার প্রয়োজন বহাল থাকবে দীর্ঘদিন, হয়তোবা চিরদিন। পুরনো ভূ-রাজনৈতিক সম্পদের দখলদারিত্ব থেকে যে উপনিবেশবাদ রাজনীতির সূচনা হয়েছিল, করোনাকালে তা এখন রূপ নিয়েছে বৈশ্বিক টিকা রাজনীতিতে। এ রাজনীতির খপ্পরে পড়ে কোন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত যাতে না নেওয়া হয় সে বিষয়েও নীতিনির্ধারকদের সচেষ্ট থাকতে হবে।

সর্বশেষ