সোমবার,২৯,এপ্রিল,২০২৪
30 C
Dhaka
সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতনিজেদের প্রয়োজনে পরিবর্তন দরকার

নিজেদের প্রয়োজনে পরিবর্তন দরকার

আমাদের পৃথিবীর মানব সভ্যতার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। যা প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়ায়। এই পৃথিবীর মানব সভ্যতার বয়স প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরনো। আর বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের বয়স মাত্র ৫০ বছর। এইতো সেদিন পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে সুদীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়। এদেশের নিপীড়িত সাধারণ মানুষ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রুখে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিল। সে আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে সুদীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের নিকট হতে স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে ঐতিহাসিক সরোয়ারদী উদ্যানে ৭ ই মার্চের কালজয়ী ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মূল মন্ত্রই ছিল এই বঙ্গে শোষিত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের বার্তা। তিনি বলেছিলেন এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। এই মুক্তি ও পরিবর্তনের নেশায় দেশের দামাল ছেলেরা নিশ্চিত মৃত্যু জেনে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।


তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শোষিত জনগণ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের নানাবিধ আগ্রাসন থেকে মুক্তি পেতেই হবে। ৩০ লক্ষ জীবনের তাজা রক্ত ও ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে সেই মুক্তিলাভ সম্ভব হয়েছিল। যে স্বপ্ন নিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা যেন অধরাই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও সেই কাঙ্খিত মুক্তি মনে হয় এখনও মিলেনি। এ দেশের খেটে খাওয়া গরিব কৃষক মেহনতী জনতাকে বঙ্গবন্ধু যে অর্থনৈতিক মুক্তির দিশা দিয়েছিলেন তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। কাগজে কলমে  আমাদের অসম্ভব অগ্রগতি হলেও বাস্তবিক অর্থে এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি মেলেনি। যেন অর্থনৈতিক বৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ধনী-গরীবের এইযে অসমতা তাই প্রমাণ করে। এদেশের মানুষের সামগ্রিক মুক্তির শপথ নিয়েই স্বাধীনতা যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ‌তবে একবারে যে আমাদের মুক্তি মেলেনি এমনটি নয়। পরাধীনতার শিকল ভেঙ্গে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র পেয়েছি। নিজেদের অধিকার আদায় করে নিয়েছি। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রয়াস নিয়ে এই দীর্ঘ ৫০ বছর চেষ্টা করে চলছি। যার ফলাফল ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ পেতে শুরু করেছে। নানা রকম মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে। নিশ্চয়ই তা প্রশংসার দাবিদার।


স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে অনেক দেশ বাংলাদেশকে তাচ্ছিল্য করে তলাবিহীন ঝুড়ির সাথে তুলনা করেছিল। সেই অপবাদের মুখে চুনকালি মেখে বাংলাদেশ আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির প্রচেষ্টায় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত কিছু মানুষ অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর। বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভূক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। এই স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে হতে হলে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। প্রথমবারের মত ২০১৮ সালে বাংলাদেশ শর্তগুলো পূরণ করে। সেই সঙ্গে  বাংলাদদেশ ২০২১ সালেও ৩টি শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয়তা দক্ষতা দেখিয়েছে। জাতিসংঘের ৩টি শর্তের প্রথমটি হচ্ছে, মাথাপিছু আয়। দ্বিতৃীয়ত অর্থনৈতিক ঝুঁকি এবং সবশেষে মানবসম্পদ উন্নয়ন। যে পরিক্ষায় বাংলাদেশ খুব ভালো ভাবেই উত্তীর্ণ হয়। যে কারণে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে কৃষির মূল অবদান থাকলেও আশির দশক থেকে শিল্পখাত অবদান রাখতে শুরু করে। অর্থনীতিতে ব্যাপক ভাবে শিল্পের প্রসার ঘটায় ও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় অগ্রগতির জন্য মাথাপিছু আয় অনেক বৃদ্ধি পায়।


বাংলাদেশের অর্থনীতি বদল এর একটি চিত্র উঠে  এসএসসি বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে। বিবিএস এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব সূচকের প্রথম যে তথ্য পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিলো মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেসময় জিডিপি’র আকার ছিলো ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার।দারিদ্রের হার ৭০ শতাংশ। পঞ্চাশ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে রফতানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসেবে যা ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।জিডিপি আকার ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে বেড়েছে ৩৬৯ গুণ। পরিমাণে যা প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা।মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ। অর্থাৎ ২,০৬৪ ডলার। দারিদ্রের হার কমে হয়েছে ২০.৫ শতাংশ। কিছু গবেষণা বলছে, করোনাকালীন সময়ে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশে। একসময় যে দেশটি তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো এখন বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই দেশটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। নিশ্চয়ই টি আমাদের জন্য স্বস্তির সংবাদ।


এত অগ্রগতির মধ্যেও কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাংলাদেশকে পাড়ি দিতে হবে অসংখ্য বাধা বিপত্তি। পুঁজিবাদের আগ্রাসনে অর্থনৈতিক যে অসমতা তৈরি হয়েছে তা নিরসন করতে হবে। ধনী-গরিবের আয়ের যে বৈষম্য তৈরী হয়েছে তা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অর্থনীতিতে ধারাবাহিক অগ্রগতি ধরে রাখতে হলে দুর্নীতিকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ গত কয়েক দশকে বেশ কয়েকবার দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। দেশের এমন কোন সেক্টর বাকি নেই যেখানে দুর্নীতির কালো থাবা পড়ে নাই। স্বাধীনতার ৫০ বছরে যেটুকু অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছে দুর্নীতি না থাকলে চিত্রটি হয়তো ভিন্ন রকম হতে পারতো। প্রতিটি সেক্টরে যদি নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যেত তাহলে হয়তো অর্থনৈতিক অগ্রগতি হত অন্যরকম। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা বাস্তবায়ন অনেকাংশেই এগিয়ে যেতাম। কিন্তু পূর্বে আমরা শোষিত হচ্ছিলাম ১৭০০ মাইল দূরের পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। আর বর্তমান নিজ দেশের মানুষের হাতেই শোষিত হচ্ছে। দেশের কিছু অসাধু দুর্নীতিবাজ ও পুঁজিবাদের আগ্রাসন সাধারন মানুষদের শোষণ করছে। যারা দেশের অর্থকে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করছে। যে অর্থনৈতিক মুক্তির লাভের আশায় বাংলার মানুষ অপেক্ষা করছে তাই এই দুর্নীতিবাজদের কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।


অর্থনৈতিক মুক্তি লাভের অন্যতম শর্ত হলো বর্তমান যে সিস্টেমে অর্থনীতি চলছে তা পরিবর্তন করা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে যে সংবিধান রচিত হয়েছিল তার আলোকে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ৭২ এর সংবিধানের মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করা। গণতন্ত্র,সমাজতন্ত্র,ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ে দেশের শাসন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। দেশের শাসন ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলেও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সমাজতান্ত্রিক হওয়া খুবই জরুরী। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এদেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির দিশা হতে পারে। বর্তমান বিশ্বব্যাপী যে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তা মোটেও গরিব মেহনতী মানুষের অধিকার রক্ষা করতে পারছে না। একটি উদার গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চর্চার মধ্য দিয়ে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে এই ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। এখন পশ্ন হলো— বর্তমান বিশ্বব্যাপী যে গণতন্ত্রহীনতার চর্চায় শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, সেখানে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যে শ্রেণিটি সব চেয়ে বেশি বঞ্চিত ও নির্যাতিত, সেই সমাজের বাস্তব অবস্থার পরিবর্তন সাধনেই তো একটি সমাজের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। অনেকেই মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণি পূর্ণভাবে বিকশিত না হওয়া পর্যন্ত, সামাজিক বিপ্লব সম্ভব নয়। আগে শিল্পায়িত হবে, শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যা বাড়বে, তারা সত্যিকার সর্বহারায় পরিণত হবে, গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করার সুযোগ আসবে, তারপর সামাজিক পরিবর্তনের সংগ্রাম শুরু হবে। পরিবর্তনের সংগ্রাম শুরু করতে হলে আমাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে সমাজের কোন অংশকে দিয়ে আমরা আন্দোলন শুরু করব। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী এবং উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর লেজুড়ে পরিণত হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে যখন কৃষকদের মধ্যে তীব্র অভাববোধ তৈরি হবে, শ্রমিকদের মধ্যে শ্রমের ন্যায্যতার চেতনা জাগ্রত হবে, নালিশ থাকবে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করবার স্পৃহা থাকবে এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবে আর শোষিত হওয়া যাবে না এবার মুক্তিলাভ করতেই হবে। তখন যদি সমাজের অধিকাংশ মানুষ চাই তাহলেই পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। তা ছাড়া কোনভাবেই সামাজিক বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে না। তাই নিজেদের প্রয়োজনে পরিবর্তন সম্ভব। যদি সেই পরিবর্তনের জন্য আমরা সম্মিলিত প্রয়াস চালাই। আমলাতান্ত্রিকতা নির্ভরতা পরিহার করে একটি অর্থনৈতিক সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রের বাংলাদেশ পরিণত হোক এমনটিই প্রত্যাশা।

লেখকঃ আব্দুর রউফ্‌,সভাপতি,বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।

সর্বশেষ