শুক্রবার,২৯,মার্চ,২০২৪
24 C
Dhaka
শুক্রবার, মার্চ ২৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়মুক্তমতপ্রসঙ্গ: ভাষানীতি

প্রসঙ্গ: ভাষানীতি

।। সুরজিৎ রায় মজুমদার ।।

দেশে অনেক ‘নীতি’ রয়েছে, যেমন ওষুধনীতি, শিল্পনীতি , রপ্তানিনীতি , আমদানিনীতি, বৈদেশিক মুদ্রানীতি, চামড়ানীতি ইত্যাদি। এই নীতিগুলো জাতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। জাতির জন্যে আর একটা দৃশ্যত ‘গুরুত্বহীন’ নীতি সম্প্রতি প্রণীত হয়েছে, তা হলো শিক্ষা নীতি। গুরুত্বহীন বলেছি এই কারণে যে স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরে একটা শিক্ষানীতি জাতির সামনে আনা হয়েছে। যদি গুরুত্বপূর্ণ বলে অনুভূত হতো, তাহলে অনেক আগেই সেটি প্রণীত হবার কথা ছিল। এই গুরুত্বহীন শিক্ষা নীতির মতো আর একটা ‘গুরুত্বহীন’ নীতি দ্রুত বানিয়ে ফেলা দরকার বলে অনেকে উপলব্ধি করছেন, যেটা হলো জাতীয় ভাষা নীতি।

জাতির জন্যে একটা বড় দুর্ভাগ্য হলো আমাদের একটা পূর্ণাঙ্গ ভাষানীতি নেই। অথচ পৃথিবীতে একটিমাত্র জাতিও যদি থেকে থাকে যাদের একটা ভাষানীতি দরকার, সেটি ছিলাম আসলে আমরা। ভাষার জন্যে রক্ত দেয়ার ঐতিহ্য আছে শুধুমাত্র আমাদের। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্যে জীবন দিয়েছি একমাত্র আমরা। সেই বাহান্নতেই পূর্ববঙ্গের জন্য একটি ভাষানীতি প্রণীত হতে পারতো। সেটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল। সঙ্গত ছিল। বাহান্ন গেলো, একাত্তর গেলো , স্বাধীনতার পঁচিশ বছর গেছে, পঞ্চাশ ছুঁয়েছে। অথচ একটি প্রয়োজনীয় ভাষানীতি নিয়ে বিদ্বজন, অবিদ্বজন কেউই কোনো কথা বলছেন না, এটি সত্যিই আশ্চর্য বটে।

আমরা বেশিরভাগ মানুষ ভাষার প্রয়োগকারী বা ব্যবহারকারী মাত্র। ব্যবহার করার জন্য ব্যাকরণ পর্যন্তই যথেষ্ট। কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা এই দিকটাকে ‘এপ্লিকেশন’ বলতে পারি।  কিন্তু যারা ভাষার ’সফটওয়্যার’ নিয়ে কাজ করেন, তারাই একটি ভাষানীতির অভাব খুব বেশি অনুভব করেন। সফটওয়্যার বলতে আমি ভাষার অন্তরালের একটা বেশ বড় এলাকার বিশেষ কিছু কাজের কথা বোঝাচ্ছি। এর মধ্যে পড়তে পারে মাতৃভাষা এবং দ্বিতীয় ভাষা/বিদেশী ভাষার শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, পেডাগজি নির্ধারণ, সাইকোলিঙ্গুইস্টিক্স এবং সোসিওলিঙ্গুইস্টিক্স -এর ক্ষেত্র নির্ধারণ, ভাষার রাজনৈতিক অর্থনীতি নিরূপণ, ভাষার শৃঙ্খলা রক্ষার কার্যক্রম গ্রহণ, মাতৃভাষা এবং বিদেশী ভাষা ব্যবহারের জন্য রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন ইত্যাদি। এই জাতীয় কাজগুলোর সাথে সরাসরি যুক্ত না হলে একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষানীতির অভাব অতখানি বোঝা যাবে না।

অনেক ক্ষেত্রে জাতির সংবিধান ভাষানীতির বিকল্প হিসেবে একটি স্বতন্ত্র ভাষানীতির অভাব অনেকটা পূরণ করতে পারে। যাদের সংবিধানে ভাষা বিষয়ক বিস্তারিত ক্ষেত্রটির এলাকাগুলো সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে এ কথাটি প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু অসুবিধা হলো আমাদের সংবিধানে ভাষা সংক্রান্ত একটিমাত্র বাক্য রয়েছে। সংবিধানের প্রথম ভাগের তৃতীয় অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা শিরোনামে একটিমাত্র বাক্যে বলা হয়েছে : প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ৷ ব্যাস্ এটুকুই। সুতরাং একটি বিস্তৃত এবং পূর্ণাঙ্গ ভাষানীতি যে ভীষণরকম প্রয়োজনীয়, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হতে পারে। যেমন,  একটা সঠিক ভাষানীতির অভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা যে ইংরেজি আমাদের জন্য বিদেশী ভাষা, নাকি দ্বিতীয় ভাষা। আর এই সিদ্ধান্ত না নিতে পারার কারণে ইংরেজি ভাষার শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে গিয়ে বেশ মুস্কিলে পড়তে হয়। কারণ দ্বিতীয় ভাষার গুরুত্ব আর বিদেশী ভাষার গুরুত্ব কখনও এক হবে না। দুয়ের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। এবং এই তফাতের জন্যে এই দুয়ের শিক্ষাক্রমেও সুস্পষ্ট পার্থক্য থাকতে হবে। পার্থক্য থাকবে পেডাগজিতে, পাঠ্যপুস্তকেও। কিন্তু জাতীয় ক্ষেত্রে ইংরেজির অবস্থান পরিষ্কার না হওয়ায় সর্বস্তরে ইংরেজি নিয়ে একধরনের ধোয়াঁশা কিছুতেই যেন কাটতে চায় না। ইংরেজি নিয়ে যথেচ্ছ চলার বা বলার যথেষ্ট অবকাশ রয়ে গেছে বিধায় দেশের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে বাংলাকে অনেকটা ঝেঁটিয়ে বিদায় করার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও অবস্থা তথৈবচ। এ দুরবস্থা ইংরেজির মর্যাদা নির্ধারণের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, শিক্ষা-শিখনেও।

শিক্ষা-শিখনে একটা বড় অব্যবস্থা লাইসেন্সিং না থাকা।  চলছে সস্তা কোচিং সেন্টারের লোভনীয় অথচ অবৈধ ব্যবসায়। সমাজে এবং কর্মক্ষেত্রে ইংরেজি জ্ঞানের ব্যাপক ব্যবহারিক গুরুত্ব এই ভাষার শিখন-কর্মটিকে বহুল-বিক্রীত পণ্য বানিয়ে ফেলেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এটা দোষণীয় নয়। চাহিদা আছে, বিক্রিও চলছে। শিখন-কর্ম বা সোজাকথায় শিক্ষকতা একটি পেশা। চিকিৎসার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় মোটেই। কিন্তু আমাদের দেশে এই শিক্ষকতা পেশাটিকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। যেমন মর্যাদায়, তেমনই মূল্যায়ণে। কোন মাননিয়ন্ত্রণ কতৃপক্ষ নেই বিধায় দেশের সবচেয়ে অযোগ্য কিছু ব্যবসা-চতুর মানুষ ইংরেজির কোচিং ব্যবসা করে কর্পোরেট কারবারী বনে গেছে। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। দেশে ইংরেজি শিক্ষার বারোটা বেজেছে।

ফেব্রুয়ারি এলেই চারিদিকে মাতৃভাষা মাতৃভাষা রব ওঠে। মার্চে পড়লেই সব শেষ। সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অগ্রগতির অজুহাত আর গোলকায়িত বিশ্বে টিকে থাকার অজুহাত। দৃশ্যত মাতৃভাষা এবং ইংরেজি নিয়ে টানাপোড়েনের কোনো শেষ নেই। চলমান বিতর্ক আরো জটিল হয়ে পড়ে সময়ে সময়ে আমাদের সর্বজ্ঞানে জ্ঞানান্বিত আমলাবর্গের অধ্যাদেশ-প্রজ্ঞাপনের বাহুল্যে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত ডজন ডজন আদেশ জারি হয়েছে ভাষা ব্যবহার নিয়ে। কখনো ইংরেজিকে গুরুত্ব দিয়ে, আবার কখনো মাতৃভাষার পক্ষে। এসবের দরকার হতো না একটা ভাষানীতি থাকলে। একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষানীতিই আমাদেরকে এই ভাষাভিত্তিক জগাখিচুড়ি থেকে মুক্তি দিতে পারে।

ভাষানীতির বিষয়টা জাতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে কি আগাগোড়া অবহেলিত থেকেছে? উত্তরটা সহজ নয়। সহজে সিদ্ধান্ত টানা বোধহয় ঠিকও হবে না। জাতিগতভাবে আমরা অনেকটা একক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী। আর ইংরেজির কথা যদি বলি তো তা আমরা পেয়েছি অনেকটা বাপদাদার উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রিটিশ উপনিবেশের সুবাদে। সুতরাং ভাষার ব্যাপারটা অনেকটা মীমাংসিত বলে অনেকের মনে হয়ে থাকতে পারে বিধায় একটি স্বতন্ত্র  ভাষানীতির প্রয়োজনীয়তা হয়তোবা জাতীয় চৈতন্যে এযাবৎ অনুভূত  হয়নি।  কিন্তু ভাষাগত অতিসাম্প্রতিক উদ্ভুত বিষয়াবলী আমাদের আমলে নিতে হবে। একুশের ঐতিহ্য আমরা বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করতে পেরেছি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। বিশ্বের সকল মাতৃভাষার সংরক্ষণ এবং বিকাশের জন্য দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। কার্যত দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাকে আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। একক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা এখন অতীত প্রসঙ্গ। আর বরাবরের মতোই ইংরেজির গুরুত্ব ক্রমবর্ধমান। তাছাড়া বিশ্বের মাতৃভাষাসমূহের সংরক্ষণ, লালন ও ক্রমবিকাশের মহান দায়িত্ব এখন অনেকটা আমাদের উপর এসে পড়েছে। সুতরাং একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষানীতির প্রয়োজনীয়তা কি বাড়িয়ে বলার অবকাশ আর আছে আমাদের?

লেখক : শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, অনুবাদক গবেষক। 

এই লেখার অভিমত ও বক্তব্য একান্তই লেখকের নিজস্ব। লেখার সাথে নতুন কথার সম্পাদীয় নীতির সাথে মিল নাও হতে পারে।

সর্বশেষ