শনিবার,২৭,এপ্রিল,২০২৪
31 C
Dhaka
শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়স্মরণার্ঘ্য“বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু“ -জন্মশতবর্ষের আলোচনায় অমর্ত্য সেন - বঙ্গবন্ধুকে...

“বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু“ -জন্মশতবর্ষের আলোচনায় অমর্ত্য সেন – বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় নজর দিতে হবে -রেহমান সোবহান

নতুন কথা ডেস্ক: “তারা (খুনিরা) বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গেছে, তাঁর আদর্শ ও চিন্তাকে নয়। ভারতীয় উপমহাদেশ যে আদর্শের সঙ্কটে ভুগছে তা থেকে উত্তরণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তা দিশা দিতে পারে। কারণ বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু।”-বললেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন। আর অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বললেন, “বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকার অর্থে সম্মান জানাতে হলে আমাদের সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় নজর দিতে হবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরো বলেন, “বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা ঠিক নয়। তিনি সমাজবাদেও বিশ্বাস করতেন।” জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত ভার্চুয়াল সেমিনারে প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
গত ২৭ জানুয়ারি ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড ভিশনস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই সেমিনারের যৌথ আয়োজক ছিল লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের (এলএসই) সাউথ এশিয়া সেন্টার ও লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন। সেমিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনীম। সভাপতিত্ব করেন এলএসই’র সাউথ এশিয়া সেন্টারের পরিচালক ডেম মিনুশে শফিক। সঞ্চালনায় ছিলেন আলনুর ভিমানি।
‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের রূপকল্প’-শিরোনামে ড. অর্মত্য সেন তার বক্তবে আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষতা, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সব মানুষের মানবাধিকারের স্বীকৃতি।
তিনি বলেন, সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিতিষ্ঠা যে সম্ভব, শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রমাণ সমগ্র পৃথিবীর সামনে তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উৎসাহ শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার সাবলীল চিন্তাধারার সঠিক মূল্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীও স্বীকার করবে। বঙ্গবন্ধু ধর্মভিত্তিক নয়, বরং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রজ্জ্বালন ঘটিয়ে অন্ধকারের শক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে নিধন করে সবার ঐক্যবদ্ধতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গ্রহণের দিনটিতে বঙ্গবন্ধুর একটি বক্তব্য তুলে ধরেন অমর্ত্য সেন বলেন, বঙ্গবন্ধু মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না বলে তিনি বলতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়নের ওই ভাষণে স্পষ্ট বলেছিলেন,‘এটা এমন নয় আমরা ধর্মপালন বন্ধ করব। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সবাই তার ধর্ম পালন করবে। কেবল ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ থাকবে।”
তিনি বলেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সংখ্যালঘুদের জন্য সমান সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি সামনে আনতে ভয় পান নি।“সমতাবাদী এই নীতিতে আওয়ামী লীগের সেক্যুলার অবস্থান ভোটে জিতে আসতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কারণ এর পেছনে ছিল জনমত গঠনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ ক্ষমতা।” এখান থেকে শেখা উচিত যে সত্য ও যুক্তিসংগত কথা বলতে কখনো পিছপা হওয়া উচিত নয়।
প্রবীণ এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, সেক্যুলার রাষ্ট্র আমরা সবাই চাই। ভারতেও এটা প্রয়োজন। যেখানে মাঝে মাঝে ধর্মের কারণে সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত তৈরি হয়। ভারতে মুঘল রাজা আকবর থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত ধর্ম স্বাধীনতা চর্চা করে আসছে। তবে এই স্বাধীনতার নামে কখনোই অন্য ধর্মকে আঘাত করা যাবে না। ভারতে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবেও ব্যবহার করা হয়। তাই ভারতের রাজনৈতিক আদর্শের সঙ্কট নিরসনে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার বাস্তবায়ন জরুরি। জরুরি ইউরোপ-আমেরিকা সহ সারা দুনিয়ায়। কারণ স¤্রাট আকবর ও বঙ্গবন্ধুর চিন্তা কেবল ধর্মীয় দিক থেকে নয়, বর্ণবাদ ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অধিকারের আলোচনায়ও আসতে পারে।
তিনি বলেন, মাতৃভাষা ব্যবহারের ব্যাপারে শেখ মুজিব ছিলেন খুবই সচেষ্ট। তার সংবিধানের অনেক কিছুই ভারতকে অনুপ্রাণিত করেছে। দাপ্তরিক ভাষা, রাষ্ট্রীয় ভাষা নিয়ে তার পরিকল্পনা এখনো ভাবায় ভারতবাসীকে। পশ্চিমবঙ্গেই একাধিক ভাষায় কথা বলা হয়। ভারতের দক্ষিণ প্রদেশগুলোতে ভাষা আলাদা।
বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে এসে ড. অমর্ত্য সেন বলেন, ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু সেই কঠিন সময়েও সেক্যুলারিজম ও ধর্মকে সম্মান করতে ভোলেন নি। সবাইকে সমান অধিকার নিশ্চিত করার কথা দিয়েছিলেন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম বেশি হলেও সংখ্যালঘু হিন্দুরা কখনোই বৈষম্যের শিকার হয় নি। তাই বলছি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও রাজনীতি কোটি কোটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি তার আদর্শ ও বাংলা ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন।
সেমিনারে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধু চাইতেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিতে ‘ইগালেটেরিয়ান’ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক। সেখানে পাকিস্তানের মতো অভিজাত শ্রেণি তৈরি না হোক, যারা সকল সুবিধা ভোগ করবে, আর সাধারণ মানুষ পিছিয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু চাইতেন, বাংলাদেশে বঞ্চিতরা হবে রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী।
বর্তমান বাস্তবতা তুলে ধরে তিনি বলেন,“আমাদেরকে এমন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই হবে সম্পদ তৈরি এবং উপকারভোগী হওয়ার ক্ষেত্রে অংশীদার ও শাসক। এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল এজেন্ডা।”
রেহমান সোবহান বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধু যদি সত্যিকার সম্মান জানাতে চাই, তাহলে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের নজর দেওয়া উচিত। অথনীতিবিদ শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি আশপাশ ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে বৈষম্য বাড়ছে, সেই সব দেশের জন্যও প্রযোজ্য।’অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধু যদি সত্যিকার সম্মান জানাতে চাই, তাহলে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমাদের নজর দেওয়া উচিত। শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি আশপাশ ও বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে বৈষম্য বাড়ছে, সেই সব দেশের জন্যও প্রযোজ্য।’

সর্বশেষ