সোমবার,২৯,এপ্রিল,২০২৪
31 C
Dhaka
সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
Homeসম্পাদকীয়স্মরণার্ঘ্যবেগম রোকেয়া মুক্তিপিয়াসী নারীর নিত্যদিনের অনুপ্রেরণা

বেগম রোকেয়া মুক্তিপিয়াসী নারীর নিত্যদিনের অনুপ্রেরণা

॥ ইয়াতুননেসা রুমা ॥

ইয়াতুননেসা রুমা

এদেশের নারী জাগরণের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর এক সাহসী নারীর নাম বেগম রোকেয়া। পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে নানা সমস্যা থাকার পরেও আজকে নারীর যে অবস্থান তা এই মহীয়সী নারীর অনন্য অবদান। তিনি নারী শিক্ষা, নারী জাগরণ, নারী অধিকার ও নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। বাঙালি মুসলমান সমাজে নারী-পুরুষের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রথম আওয়াজ তিনি’ই তুলেছিলেন। নারীর স্বাধীনতা ও আত্মমর্যদা রক্ষার লড়াইয়ের পথও তিনি দেখিয়ে গেছেন। ৯ ডিসেম্বর সাহিত্যিক ও শিক্ষানুরাগী বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামের এক সমভ্রান্ত মুসলিম জমিদার পরিবারে তার জন্ম। তিনি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর। উনবিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যু একই তারিখে হওয়ায় দিনটিকে ‘বেগম রোকেয়া দিবস’ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। গত ৯ ডিসেম্বর ছিল সেই ঐতিহাসিক দিন। এ দিন সমগ্র বাঙালি তাকে বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন। কিন্তু মুক্তিপিয়াসী বাঙালি নারীরা তাকে নিছক আনুষ্ঠানিকতায় নয়, স্মরণ করেছেন নিজেদের সংগ্রামী হৃদয় থেকে। কারণ, আজ থেকে এক শতাব্দী আগে তিনি যেভাবে নারী মুক্তির কথা বলে গেছেন, মুক্তির পথ দেখিয়েছেন, নারীদের জেগে ওঠা ও জেগে থাকার তাগিদ দিয়ে গেছেন, তা আজো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তার বাণী ও কর্ম এখনো আমাদের পথ দেখায়। আর ব্যক্তিগতভাবে বেগম রোকেয়াকে আমি অন্তরে লালন করি। বেগম রোকেয়া কেবল দিবস উপলক্ষ্যে নয়, নিত্যদিনের অনুপ্রেরণা। নারীর ক্ষমতায়তনের প্রতীক।
রোকেয়া ছিলেন স্বাধীন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির অনুসারী। নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তার রচনায় পর্দা প্রথার নামে নারীর প্রতি সেকালের সমাজের কঠোর রক্ষণশীল আচারণ ও অসহিষ্ণুতার হৃদয় বিদারক চিত্র ফুটে উঠেছে। তিনি তার লেখা প্রবন্ধ ও রচনাসমূহের মধ্যে নারীবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তার অনন্য সৃষ্টি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যের একটি মাইলফলক ধরা হয়। তার লেখা প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তিনি হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবহেলিত ও অসম অবস্থান তুলে ধরেছেন। লেখনীর মাধ্যমে সৃষ্টি করেছেন সামাজিক সচেতনতা। তিনি সমাজ সংস্কারকের দায়িত্বও পালন করেছেন। নারীর অলংকার কে আখ্যা দিয়েছেন দাসত্বের প্রতীক হিসেবে। তাই নারীদের অলংকার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধ উজ্জীবিত হওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন। নারীদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও উৎসাহ যুগিয়েছেন। বেগম রোকেয়ার স্পষ্ট উচ্চারণ “ আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসীত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। ক্রমে পুরুষরা আমাদের মনকে পর্যন্ত দাস করিয়া ফেলিয়াছে।… তাহারা ভূস্বামী গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে আমাদের ‘স্বামী’ হইয়া উঠিয়াছেন।… আর এই যে আমাদের অলঙ্কারগুলি-এগুলি দাসত্বের নিদর্শন।”
তিনি ধর্ম গ্রন্থগুলো পুরুষের দ্বারা লিখিত বলে মনে করতেন। যা কিছু লেখা হয়েছে সবই নারীর বিপক্ষে। নীতি, প্রথা, দৃষ্টিভঙ্গি, আইন সর্বত্রই নারীর পক্ষে যে খুব কম কথা বলা হয়েছে সেটা তিনি তার লেখায় তুলে ধরেছিলেন। পুরুষশাসিত সমাজের আচার অনাচার কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। মুসলিম মেয়েদের গ্রগতির জন্য তিনি সারা জীবন কাজ করেছেন।
বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা ও সামাজিক নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, বেগম রোকেয়া সেই সময় বাঙালি নারী সমাজের মাঝে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন। নারী শিক্ষার ব্যাপারে তার পরিবার ছিল খুবই রক্ষণশীল। সে সময় মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর প্রচলন ছিল না। তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের ঘরের বাইরে গিয়ে শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ ছিল না। সামাজিক ও পারিবারিক বাধার কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও বেগম রোকেয়া প্রথম জীবনের শিক্ষা লাভ করেন বড় ভাই ইব্রাহিমের কাছে। বাবা-মা ঘুমানোর পড় গোপনে মোমবাতির আলোতে ভাইয়ের কাছে পড়তেন। আরবি, ফারসি, উর্দু ও বাংলা আয়ত্ত্ব করেছেন। তার আগে শিশু বয়সে কলকাতায় মায়ের সঙ্গে বসবাসের সময় তিনি লেখাপড়ার সামান্য সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু সমাজ ও আত্মীয়স্বজনের সমালোচনায় বেশিদূর এগোতে পারেন নি। দুই ভাই কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। বলা যায় বেগম রোকেয়ার শিক্ষার হাতেখড়ি ও শিক্ষালাভ এবং মূল্যবোধ গঠনে তার বড় দুই ভাইয়ের অবদান রয়েছে।
তবে পড়ালেখা ও সাহিত্য চর্চার আসল ধাপ শুরু হয় বিয়ের পর স্বামীর সহচর্যে এসে। স্বামী সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হলেও তিনি ছিলেন প্রগতিমনা উদার ও সংস্কৃতি মনের মানুষ। ছিলেন শিক্ষানুরাগী। ফলে তার সাহিত্য চর্চা ও নারী জাগরণের কাজ আরো সহজ হয়।
বেগম রোকেয়ার শিক্ষাগ্রহণ ও নারী জাগরণের সংগ্রামী ইতিহাস কারো অজানা নয়। তবে স্বার্থক হয়ে উঠবে না, যদি আমরা তাকে শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য কেবল একটি দিবসকেই বেছে নেই। রোকেয়া দিবস যেমন আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয়, তেমনি তার পাশাপাশি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মাদ্রাসায় লেখা ও সাহিত্য, তার জীবন ও কর্ম, তার সংগ্রাম সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের শেখানো দরকার। পাঠ্যবইয়ে বেগম রোকেয়ার জীবনী ও তার নারী জাগরণের সংগ্রামী ইতিহাস আরো বিস্তৃত আকারে অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। রোকেয়ার পাশাপাশি অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা, ইলা মিত্রদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানানো জরুরি। তাহলেই নারীর মুক্তির পথ সহজ হবে, রোকেয়ার স্বপ্নপূরণ হবে। তখনই রোকেয়া দিবস পালন তখন আরো অর্থবহ হয়ে উঠবে।
আমি মনে করি প্রতিটি নারীর মাঝেই বেগম রোকেয়া সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। আর নারী শিক্ষার মাধ্যমে একেকজন বেগম রোকেয়ার জন্ম ও বিকাশ হবে। এভাবেই বাঙালি নারীর জীবন আলোকিত হবে। বিশেষভাবে নতুন প্রজন্মকে বেগম রোকেয়ার জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা গ্রহণ করতে হবে। বেগম রোকেয়া মুসলিম পরিবারের একজন ধর্মপ্রাণ নারী ছিলেন। ঘোমটা ছাড়া তার কোনো ছবি আমরা দেখিনি। কিন্তু ধর্মবিশ্বাস তার মুক্তচিন্তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। তিনি ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন। কেবল কথা দিয়ে বা বুদ্ধিজীবী মহলে নিজের চিন্তাচেতনার কথা ছড়িয়ে দিয়েই থেমে থাকেন নি। সমাজ গঠনে মাঠে নেমেছিলেন। নারী শিক্ষা ও নারী জাগরণের লক্ষ্যে সংগঠন গড়ার প্রচেষ্টা করেছিলেন। সাধারণ মেয়েদের মাঝে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ছিলেন কৌশলী ও বাস্তব-বোধ সম্পন্ন। যখন দেখলেন স্কুলে মেয়েদের আনতে গেলে তারা বে-পর্দা হয়ে যাচ্ছে, মুসলিম পরিবারগুলো মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চাইছে না, তখন তিনি নিজেই পর্দার আড়ালে থেকে কাজ করেছেন। সমাজের অনেক প্রচলিত রীতিনীতি মেনেই তিনি তার কর্মযজ্ঞ চালিয়েছিলেন। সেই সময়েই তিনি নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং শুধুমাত্র শিক্ষাগত মুক্তি নয়, সার্বিক মুক্তির কথা চিন্তা করেছেন। তিনি বলেছেন, “ মেয়েদের সাবলম্বী হবার পথে, মুক্তির পথে, শিক্ষার বিকাশই আসল রাস্তা।” আসুন তার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে নারীর আত্মমর্যাদা সমতা বিধানের লড়ায়ে ঐক্যবদ্ধ হই-এটাই হোক এবারের রোকেয়া দিবসের অঙ্গীকার।
লেখকঃ সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী।

সর্বশেষ