বৃহস্পতিবার,১৮,এপ্রিল,২০২৪
27 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮, ২০২৪
Homeজাতীয়লক খোলা লকডাউন!

লক খোলা লকডাউন!

এম এইচ নাহিদ: হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণ। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। লাগামহীন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে করোনা নামক মরণঘাতী ভাইরাস। “আগামী দু’সপ্তাহ সংক্রমণ আরো উর্ধ্বমুখী থাকবে”-এমন ভয়ঙ্কর আভাস দিয়ে বিশেষজ্ঞরা সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে আরো কঠোর হওয়ার তাগিদ দেওয়ার পরেও চলতি সপ্তাহে ঘোষিত ‘লকডাউন’ কড়াকড়ি না করে বরং আরো শিথিল করা হয়। ব্যবসায়ীদের চাপে খুলে দেওয়া হয় শপিংমল ও দোকানপাট। স্বাস্থ্যবিধি মেনে লকডাউনের মধ্যেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের সব সিটিতে চালু করা হয় গণপরিবহন। “নামে লকডাউন কিন্তু বাস্তবে সর্বত্র লক খোলা”-এমনটাই শোনা যায় সচেতন মানুষের মুখে।
“ডাক্তার হয়েও রোগীর সেবা দিতে পারলাম না। চোখের সামনে মারা গেল”-অসহায় আর্তনাদ খোদ চিকিৎসকের। চিকিৎসকরা এতটাই করুণ পরিস্থিতির স্বীকার যে, হাসপাতালে রোগী এলে তাদের কণ্ঠে করুণ উচ্চারণ-“কেউ মারা গেলে তবেই বেড ফাঁকা হবে।” চিকিৎসকদেরই বা কি করার আছে! আইসিউইউ, সাধারণ বেড এমনকি ফ্লোর এবং ওয়ার্ডের করিডোরেও রোগী ধারণের ঠাঁই নেই। রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে দিন-রাত বাড়ছে রোগীর চিকিৎসা না পাওয়া স্বজনদের হাহাকার। এমন হাহাকার দেশের অন্যান্য হাসপাতালেও। কারণ করোনা নামক অদৃশ্য দানবের ছোঁয়া এখন দেশের সর্বত্র। কোভিড-১৯ নামক এই দানবের ধরণ পাল্টেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার নতুন ধরণ আক্রান্ত রোগীর ফুসফুস দ্রুত সংক্রমিত করছে। প্রয়োজন হচ্ছে অক্সিজেন। কিন্তু হাসপাতালগুলোতে ভয়াবহ অক্সিজেন সঙ্কট। ফলে সামনের দিনে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে!
মানুষের দৈনন্দিন জীবন-যাপন ও জীবনাচরণ দেখে মনে হয় তারা করোনাকে মোটেও গরজ করছে না। হাট-বাজার, চায়ের দোকান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাট, সামাজিক অনুষ্ঠান সহ সর্বত্র মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানা এবং অবাধ বিচরণ দেখে মনে হচ্ছে না-দেশে করোনা বলে কোনোকিছু আছে। করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ রুখতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৮ নির্দেশনা জারি করা হয়। তারপর মন্ত্রীপরিষদ থেকে জারি করা হয় ১১ নির্দেশনা। অবশেষে গত ৫ এপ্রিল থেকে সারাদেশে ১ সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু লকডাউনের সময় এবং ধরণ দেখে বিশ্লেষকরা বলেন, ‘এ কেমন লকডাউন’! কারণ পূর্বে বন্ধ ঘোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণপরিবহন, রাইড শেয়ারিং দোকানপাট, শপিংমল, ফুটপাতের কিছু দোকান ছাড়া সবই খোলা ছিল। ঢাকার রাজপথে ছিল-সেই চিরচেনা যানযট। ছিল রিক্সা, সিএনজি ও ব্যক্তিগত গাড়ির দাপট। রাস্তায় ছিল মানুষের ভীড়। আর লকডাউনের সম্ভাবনার কথা শুনে ৩ ও ৪ এপ্রিল তো মানুষের মধ্যে ঢাকা ছাড়ার ধুম পড়েছিল। লঞ্চ, ট্রেন ও বাসে ছিল ঘরমুখী জনস্রোত। এ যেন ঈদযাত্রা! যে স্রোতে গ্রামে গ্রামেও পাড়ি জমিয়েছে করোনা। কারণ যেখানেই মানুষে মানুষে ঠাসাঠাসি, সেখানেই করোনার বসবাস।
সবকিছুই যখন চলবে, তখন গণপরিবহণ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে কেন! এমন দাবিতে রাজধানীর বহু স্থানে বিক্ষোভ হয়, পুলিশের সাথে চলে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এমন পরিস্থিতিতে সরকার খুলে দিয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও গণপরিবহণ। জারি করেছে স্বাস্থ্যবিধি মানার কঠোর নির্দেশনা। কিন্তু তারা কি মানবে! পরিস্থিতি তা বলে না। কারণ ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মানুষের মধ্যে ১০ শতাংশের মুখেও মাস্ক ছিল না। গণপরিবণের শ্রমিকদের মুখেও মাস্ক থাকে না। থাকে না অধিকাংশ যাত্রীর মুখেও। বাসে হ্যান্ডস্যানিটাইজার থাকার কথা, কিন্তু তার কোনো বালাই নেই। অর্ধেক যাত্রী পরিবহণের কথা থাকলেও তাও মানা হচ্ছে না অধিকাংশ বাসে।
ফলে করোনার এই দানবীয় রুপে আত্মপ্রকাশের মধ্যে ঢিলেঢালা লকডাউন এবং স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষের অনীহা কতটা ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনছে তা বুঝা যাবে সামনের দুই সপ্তাহে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, “অবস্থা বড়ই করুণ হবে। করোনার সংক্রমণ ক্রমেই উর্ধ্বমুখী হবে। তাই যেভাবেই হোক সংক্রমণ ঠেকাতে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। সরকার ও প্রশাসনকে আরো কঠোর হতেই হবে। প্রয়োজনে শাস্তি প্রয়োগ করে হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে নিস্তার নেই।”
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন,“ করোনা সংক্রমণ ঠেকাতেই হবে। এর জন্য জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতেই হবে।”
করোনা মোকাবেলায় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, “করোনা চেপে ধরেছে। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানার আদেশ কাগজে-কলমে আছে , বাস্তবে নাই।”
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন,“ আইসিইউ বাড়িয়ে লাভ নেই। লকডাউন কেউ মানছে না। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সবার আগে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে হবে।”
বিশ্লেষকরা আরো বলছেন, “ লকডাউনে গণপরিবহণ চালানোর সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। সংক্রমণ ঠেকাতে যে করেই হোক স্বাস্থ্যবিধি মানাতে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে যেখানে সেখানে মৃত দেহ পড়ে থাকবে। এমন অবস্থায় সব দিক ঠিক রেখে এখন একটাই উপায় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং জনগণকে মানতে বাধ্য করা।”

সর্বশেষ